গুচ্ছ কবিতা ।। চাণক্য বাড়ৈ
নাগলিঙ্গম
ফুটেছ অদ্ভুত ফুল—নাগলিঙ্গম। এই অরণ্য-আড়ালে থোকা থোকা ফুটে আছ সহস্র স্বয়ম্ভূ তারা—নীলাভ অন্ধকারে জ্বেলেছ রূপাগুন—দেহদীর্ণ পুষ্পের প্রদীপ।
এই বিহ্বল বসন্তের দুপুরে ছড়িয়েছ ধূপ-ঘ্রাণ—বনময়—; তপোবন-বালিকার কোলে ছিনিয়ে আনা সরস্বতীর বীণা—কস্তুরিতাড়িত হরিণচঞ্চল হাতে উদারা, মুদারা, তারা... ঝরছে শিবের ফুল—স্বেচ্ছা-সন্ন্যাস নেওয়া রহস্য-রমণী পুরনো আটায় রুটি বেলা রেখে পেতে আছে কামনা-আঁচল—কুষ্ঠিনির্দেশ মেনে কুড়াচ্ছে পাপ ও পুনর্জন্ম। তোমার প্রহরায় রত অনন্ত, বাসুকী, পদ্মা—মাথায় মণি আর মুক্তাওয়ালা সাপ...
রহস্যকুসুম, হরিৎ-পালক পাখিদের দেশে তোমার কিংবদন্তি শোনা যায়।
অনুপ্রবেশ
তোমার ধ্যানের ভেতরে ঢুকে যাই—যেভাবে একটি জোনাকি অথৈ অন্ধকারে জ্বলে ওঠে, অকস্মাৎ—
আমি জানি, তোমার ধ্যানের জগত এক গোলাপি গ্রহ—সেখানে আমি, এক এলিয়েন ছাড়া আর কিছুই নই—আমি তো নীরবে তোমার সামনে বসে থাকি—যেন চোখ খুলতেই আমাকে দেখতে পাওয়া যায়—
অদূরে শিবের মন্দির; থেকে-থেকে শঙ্খনাদ আসে—তোমার ধ্যানভঙ্গ হলে আমাকেই তখন অপরাধী ভাবো—অথচ পাঁচ পাঁচটি মহাসমুদ্র সেঁচে কোনো গোলাপি শঙ্খ পাইনি আজও—
তোমার ধ্যান, তবে কীভাবে ভাঙাব, দেবী?
পিতার হাত
একটি মায়াবী বৃক্ষের সাথে আমার বন্ধুত্ব বেড়ে উঠছে আজকাল—যেভাবে বেড়ে ওঠে গর্ভের সন্তান—দিনে দিনে—রোদ আর বৃষ্টির ভেতর—
তোমাদের অসংখ্য করাতকলের আওয়াজ কেবলই তকে সন্ত্রস্ত করে তোলে—আর এইভাবে আমিও জেনে যাই, কেমন শব্দ করে হেঁটে হেঁটে মৃত্যুরা আসে জীবনের কাছে—
তোমরা তো আবিষ্কার করেছ ড্রোন—পরম আণবিক বোমা—যাবতীয় যুদ্ধের রসদ—এই ভয়ে এই ছোট্ট জীবন নিয়ে আমি সেই বৃক্ষটির কাছে যাই—
প্রিয় বৃক্ষ! আমার বন্ধু—আমাকে উদ্দেশ্য করে একটি পাতা ঝরিয়ে দেয়, অনন্ত স্নেহ আর নির্ভরতা নিয়ে সেটি আমার বুকের ওপর এসে পড়ে—
এমন কোমল স্পর্শ আর নির্ভরতা আমার পিতার হাতেও ছিল—
কৃষক
বহুদিন বেঁচে থাকা হলো পৃথিবীতে—বহুদিন অপুষ্ট চিন্তার বীজ চাষাবাদ শেষে, ব্যর্থ কৃষক আমি—সমুদ্রের কিনারে এসে ভাবি—কেন এই মানুষজন্ম চেয়ে নিলাম—
অথবা নরোম মোমের ভেতর কেন জন্মাইনি আজ মধুভুক মৌমাছি হয়ে—ফুলের সঙ্গ নিয়ে মধুর গুঞ্জরন শুনে শুনে আহা, কেটে যেত দিন—
তবু, এইভাবে বহুদিন বেঁচে থাকা হলো—আমারও জন্মের পর জন্মেছিল যারা, অনেকেই চলে গেছে—আমি তবু স্বার্থের পরাগ মেখে মেলে দিচ্ছি ডানা—অমরতার হে আকাশ, এই তুচ্ছ জীবন-প্রদীপ তোমার ললাটে গেঁথে রাখো, এক অনুজ্জ্বল তারা হয়ে জ্বেলে দিই আলো—
ওই যে পরিচিত মৃতেরা, আমার ডাকনাম ধরে ডেকে যাচ্ছে অবিরাম, তাদের পেছন পেছন হেঁটে চলেছি নিয়মের মহাসড়ক ধরে—অথচ, কোনো দ্বিধাগ্রস্ত মানুষ নয়, আমি এক উত্তাল সমুদ্র হয়ে জন্মাতে চেয়েছিলাম...
• বাগেরহাট