চাঁদ দেখছি গাছের আড়ালে
রাতটি ঘুমুতে যাবে এখন
এখন এ গ্রামীণ রাতে
দশটা মানে ভয়ানক রাত।
চাঁদটি ডুবে গেলে আমিও—
কালের আয়নায় মুখ ঢেকে
নেবো। সত্যি বিরহী আমি
এখন এ চুপিসারে রাতে
কেউ যদি নাড়ে কড়া
ফেরাবো না তাকে।
রাত গাঢ় হয়, এ গ্রামীণ
রাতে, মশারা ঝাঁক বেঁধে
রক্ত চুষে নেয় আমার
আগুনে অগ্নিকে সাক্ষী রেখে
রাতটি ঘুমিয়ে যাবে
গাছগুলোও ঘুমোবে এবার
পাতারা থেমে গেছে
মুখভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে
সবাই লাফিয়ে উঠবে রাতে।
রাত দেখছি, রাতের
চোখে দেখছি চশমা নেই
নিপাট নক্ষত্রের মতো রাতে
আমাকে অন্তরীণ হতে হতে
নিজস্ব ভাবনায় ডুবে গিয়ে
আমার আবাল্য নকশায় রাত
রাত দেখছি, রাতের ঘুমন্ত মুখে
চুমুরেখা এঁকে দিচ্ছি সারল্যে
মুখভর্তি ধোঁয়ায়িত মিথ।
লাবণ্য দেখছি, ঘরে-আলোতে
লাবণ্য দেখছি, বেঁচে থাকায়
চাঁদের চোখে দেখছি চশমা।
দেখো বিভাজিত, মাধুরী রাত
কেমন আলাভোলা দূরত্বপনায়
আসলে তো দূরত্ব মানেই প্রাপ্তি
এ নিদারুণ বিষ, সত্যি
অবলা রাতে, ঘোমটাবধু বধূ
প্রকৃতির রূপ জেগে উঠে
কথা বলে ফুলন্ত ঝরঝরে
বর্ষায়, ভেজা রাতে
যে ঘুম চাঁদপ্রহরীয়া সে মৃত।
আকাশকে অসীম ভেবে,
প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতার বিবরণে
বয়স্ক কলমের মুখ লুকায় লজ্জায়
এ বিরহে, এ জলঘুমের মুখে
পিয়ানোর সুর কি বলা হলো
রাত্রির বাতাসে বাতাস?
নাকি বিবর্ণ নয়, নাকি সত্যি?
কোনটা তবে খোয়াব, কোনটা
কালোঘুমের ধ্বংসাত্মক লীলা?
বলো, শূন্যপুরে রওনার সময়
যে পথে আরব দাঁড়িয়েছে ফুল হাতে
মুখরা রমণীর মতো রাতে
তার হাত তুমি ফেরাতে পারো না
এ রাত্রিকে, এ মহাকালের
সারথি সজ্জায় তুমি ঘুমমুখ।
হায় অন্ধকার জমাটবদ্ধ জনপদে
দশটার অতিরিক্ত কিছু, অথবা
এগারোটা বাজে এখন বড়জোর
নাহয় বারোটাই বাজলো অনর্গল
অর্গল খুলে দিয়ে ভ্রমরা
ডাকে আয় আয় চিতামুখী।
হে ভ্রমরা বিশ, হে কালোমুখু রাত
দিনের পর্দাভেদ করে
মানুষের অস্থিসন্ধিতে আঁকো কালো
কালের অক্ষরের মতো, ঝর্নার
ছন্দের মতো বিহ্বল পায়ে এসো রাত
এসো মোলাকাত করি স্পর্শের
ছুঁয়ে দেখি স্বপ্ন বিরাতে, ঘুম ভেঙে
এখন যদি কারো কড়া নাড়া শুনি
দরজা খুলে দিতে হবে জানি।
এ রাতের প্রার্থনায়, এ নিমজ্জিত
সত্যের দামামা বাজিয়ে নীরবে
গভীর নৈঃশব্দ্যের মতো রাত নামে
ঝুমকো বালিকার নেশা হেসে
গাছের ফোঁকরে ফোঁকরে
চাঁদ নামে, পড়ে আলো ছায়া।
পাখিদের ডানায় লাগে আলো
ঘুমন্ত তুলতুলে পালকে
চঞ্জুর কথাগুলো মন্দ্রিত ধ্বনি
জয় গোস্বামী, এ রাতের
কালো পর্দা ভুলে গায় ঊষা
সুবর্ণ দিবসের অভিধায়।
অন্তরীক্ষে পাপাত্মা পুঞ্জীভূত রেখে
কালো রাতের আঁধারে গত হলো
গতকাল মৃত হরিণ শাবকের দল
যেনো বেহায়া এ রাতে, চোখের
শাণিত তরবারি চিলিক দিয়ে উঠে
যেনো ঢেউ ভাযে আঁধারে আঁধারে
ইথারে ইথারে রাত ছড়িয়ে পড়ে
রথের চাকাটির নির্দেশ জেনে
মাইকেল রবীন্দ্রনাথ অমীয় রাত।
রাত থেকে রাতে, নিজস্ব ভাবনায়
বিচিত্র জগতের তন্দ্রাভুত মাতাল
অলক্ষ্যে এঁকে চলে খেয়া পারাপার
নীল খামে রাত নেমে, এখন রাত
বারোটা পনেরো মিনিট বেজে
আরেকটু কাবু হলে ঘুমিয়ে যাবে।
রাত নামে, গাঢ় হয় রাতের আঁধার
জ্যোৎস্নার জোয়ারে ভেসে যায়
সাম্পানের ঢেউ ও মুদ্রা সমুদয়
তারপর রাত আবার ঘুমে, বেহুশে
বিবরের দরোজায় তালা দেখে
জোনাকি পাঠায় নাক্ষত্রিক সেক্সপিয়র
অপরাজিতার নীল নয়নের জলে
রাতের বিরহ পূর্ণ হয়ে উঠে
যেনো বা আষাঢ়ের খামে চিঠিতে।
রাত থেকে রাতে, যেমন রাত
ধূসর কুয়াশার মতো বিছায় চাদর
পরম আত্মীয়তায় বুকে নিয়ে।
বুঝে শুনে হরফকে কায়দায়
দিকশূন্য অন্তরায় রেখে, যেভাবে
নির্ণয়ে আদুনিস, নাগিব মাহফুজ
আমাকে আরেকটি জ্বলন্ত কয়লায়
ঈশাণে বিষাণের সুর তুলে তুলে
ঘুমন্ত প্রজাতির স্বপ্ন বিভঙ্গে।
রাত বাড়ে, হারিয়ে যায় দিনের
অবশিষ্ট চিহ্নরেখাগুলি। পাথরের
নীরবতায় খুলে কাঁকন—রূপসী।
উর্বশী বালারা নৃত্য ভুলে গিয়ে
মাদুরে হেলিয়ে পিঠ, ডাকে
নিজ নিজ সখের নাগর, আধুনিক
সাময়িক জ্যোৎস্না ঝরা রাতে
কি দেখে কম্পিত হতে পারে কীটস
পার্শিবিশি শেলী কেনো ঘুমে?
আমাকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে রাত
নীল মণি রত্নাকরের মতো
রাতের পূর্ণিমায় আঁকা ভেষজ।
নীরালোকে দিব্যরথের মতো
ছরিয়ে ছিটিয়ে পড়া নুন পূর্ণিমায়
মেঘ তার ছুঁয়ে থাকে মুখরায়।
নবীন অস্তরাগের মতো লোহিত
সন্ধার মৃতভাষা, মুক কোলাহল ভুলে
এখন গ্রামের পথে কতো রাত!
যে রাতের শেষ নেই, নির্ঘুম
কালির দোয়াতে সে রাতের
সৈয়দ শামসুল হক অনন্য নক্ষত্র।
তারাদের ফাঁক গলে, জ্বলন্ত কয়লার
মতো ভেসে আসে মনসুর হাল্লাজ
ওমর খৈয়াম, রুমি, শেখ সাদী আসে
তারাদের বিচিত্র হরকতে
যেমন রাতের শেষে আসে রাত
উত্তরাধিকার সূত্রে আসে ভোর।
আগমনী শিহরণে, কাঁপা কাঁপা হাতে
চায়ের পেয়ালায় রাত গাঢ়-নীল
অবিমৃষ্য মৃতের সংবাদে
সংক্ষুব্ধ রাতের চিৎকারে, অস্বীকার
বিলুপ্ত কল্পনায় মরে গিয়ে
হারানো গোমস্তার তল্লাট-তটে
হায় নিস্তব্ধ নিঝুম জনহীন ক্ষণ
শ্যাওলার মতো ভেসে ভেসে, এখন
যদি কড়া নাড়ে, ফররুখ, আল মাহমুদ
আমাকে দরজা খুলে দিতে হবে
বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ, নির্মলেন্দু গুন
শামসুর রাহমান দেখে এ রাতের ঝর্না
ধারায় ধারায় তা ভাসায়, চকিত চশমায়
সৈয়দ আহমাদ তারেক কেনো
নাগরদোলায়, সুইট সিক্সটিনে?
এ রাত, এ চোখের চশমায় রাত
দখলদার নৃত্যে দক্ষিণা বাতাস
যেনো কোজাগর মরুভূমি এক।
তুমি যে শূন্যপুরে যাত্রায়, আরব
বন্ধুকে কাছে পেয়েছিলে, দিক চিহ্নের
নির্ণায়ক অ্যালগরিদমে।
শারীরিক অক্ষমতা ভেবে
ডিভাইসের অসত্য কলহতে
উড়ে পোকা, উড়ে উড়ে চোখে পড়ে।
রাত বাড়ে, রাতের শেকড়ে লেখা
থাকে সফোক্লিসের নাম, জন ডান
ও হেনরি, টমাস ট্রান্সট্রোমারের নাম
তারপর রাত থেকে, চাঁদ থেকে
অবিরত ঝরতে থাকে ছন্দ সুকোমল
যেনো বা দুপুরের উজ্জীবিত সভা
রাতের গ্রহণ পথে, একজন আরব
মশালের দীপ্তি ধরে রাখে
এখানে এ গ্রামের রাতে
রাত হয়, জমকালো আয়োজনের
মাঝে জেগে থাকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়
আবুল হাসান, আবু হাসান শাহরিয়ার।
তারপর তারাদের রাত, মানুষের রাত
কর্মজীবী নারীদের রাত, জঘন্য
ঘিনঘিনে এঁদো পাকে রাত।
বিছানার আয়েশের টানে, মস্তকে
ধরে জ্যোৎস্না, অনেক নাবিক ঘুমিয়ে
পড়ে মৃত্যুকে সামনাসামনি রেখে।
যে ঘুমায়, তার বালিশের পাশে
পড়ে থাকে কানা ঘুঘু—অমৃতের
একাকিত্বে সে ছোট হতে থাকে
যাকে বলে পৌরুষে সেয়ানা
যেনো রং বাহানা এসব, সুধীন্দ্রনাথ
কিংবা আব্দুল মান্নান সৈয়দ
যেনো রাতের আঁচল ভরা ফুল
যেনো ফুলের সাজিতে ভরা রাত
গ্রামের দশটা অথবা বারোটা একটা
একটি রাত, হতে পারে নিজের
সাথে বর্ণবাদ নিয়ে আলোচনায়
কালোদের আক্ষরিক বঞ্চনায়
যেমন রাত হতে পারে স্বার্থহীন
নির্মোহ, নির্লোভ যেমন চাঁদ
বন্দিত্বের অমাবস্যার তিথিগামী।
যেমন রাত হতে পারে তলস্তয়,
ভলতেয়ার, দস্তয়ভস্কি, গালিব
রাত হতে পারে হাবিবুল্লাহ সিরাজী
রাতের বিনির্মাণ কলা মুখোমুখি
চৌকাঠে, কড়িকাঠে, জ্যোৎস্নায়
গ্রামীণ জনপদের রাত মিল্টনের
মতো প্রচণ্ড রকম আত্মবিদ্রোহী
মার্কেজ, পাবলো নেরুদা, কিংবা
মো ইয়ানের মতো রাত অবশ্যই
হারুকি মোরাকামির মতো।
রাত হতে পারে সুন্দর, হতে পারে
শ্রবণ ও স্তুতির গোপন আরাধনা
যেমন সচরাচর রাত হয় যাযাবর
রাতের আগমনী এ জ্যোৎস্নায়
বিলীয়মান মেঘের মুখোমুখি রেখে
যে আরব অতিক্রান্ত পথে পথে
যেমন গ্রামের রাত, দশটার
পর থেকে জসীম উদ্দিন, ঘুঙুরের
সুরে সুরে নজরুলের মাভৈ মাভৈ।
রাত বাড়ে, গাছের ফাঁকে আর
চাঁদের রূপশ্রীতা নেই, নির্জনে
একলা জেগে জেগে রাত দেখে মন
এ জাগার ক্ষণ, এ মাহেন্দ্র লগনে
দ্বারে এসে যদি কেউ কড়া নাড়ে
আমি অবশ্যই দ্বার খুলে দিবো।
চাঁদ দেখছি গাছের আড়ালে, চাঁদটিও
দেখছে আমাকে চুপিসারে। চাঁদ
ডুবে গেলে, আমিও ঘুমিয়ে যাবো।
• কুমিল্লা