গুচ্ছ কবিতা ♦ গিরীশ গৈরিক
জন্মপদ্ম
একদিন প্রকাশ্যে নগ্ন হবো
ঠিক একদিন নগ্ন হয়ে ঘুম দিবো—নিরবধিকাল।
যে ঘুম শিখেছিলাম মাতৃগর্ভ থেকে—
সেই ঘুম দিবো মাটির গর্ভে।
মা ও মাটির গর্ভ এত মমতাময়ী কেন!
কেন এত নির্জন স্তব্ধ! যেন আঁধারের মতো শীতল...
জননীর জন্মপদ্মে প্রণতি রেখে বলছি :
মানুষ জন্মগত অজ্ঞাতবাসী, ভুলত কবি, মূলত কখনো জানে না নদীর স্বরলিপি।
তবুও জীবনের মহাতীর্থে আমি ও তুমি—
জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি ভুলের মধ্যে বসবাস করি
আর বড় হতে হতে একটি ভুলকে আরেকটি ভুল দিয়ে প্রমাণ করি সত্য।
বাবা। তুমি ট্রেনে তুলে দিয়ে নেমে গেছো
গন্তব্যহীন ট্রেন চলছে--চলেই যাচ্ছে জলে
জলের মাঝে জননী, তার মাঝে জন্মপদ্ম।
জন্মপুরান
মেঘের সাথে সমুদ্রের এতো গভীরতা কেন?
কেন আকাশের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে সাগর?
ঠিক এভাবে, জননীও রঙিন হয়ে ওঠে জন্মদাতার কামের নিমগ্নতায়।
পিতা, তোমার পিতৃত্বের অধিকারের রং কী!
সেটা কি মেঘের মতো—নাকি জলের মতো?
এসব প্রশ্ন তখনই আমার মনে আসে—
যখন দেখি মেঘে বিদ্যুৎ চমকায়
সাগরে ঝড় ওঠে।
সবকিছু কেন যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়?
মেঘের রং ক্ষণে ক্ষণে কেন বদলে যায়?
যেন তোমার মন। তোমার মনমেঘ কেন বদলায়?
আমি তো সাগর হতে পারি না!
পারি না তোমার রঙে রঙিন হতে!
আমি মৃত্তিকা হতে চাই—
আমার মাটির দেহে ধরে রাখতে চাই পৃথিবীর সমস্ত জল।
শুধু, পিতার প্রেমের বেদনায় মায়ের চোখের জল স্পর্শ করতে চাই না!
বৃত্ত
মহাকাশের অন্ধকারে নক্ষত্র যেন জোনাক হয়ে জ্বলে
যেভাবে তুমি ও আমি জীবনের অভিজ্ঞানে আলো হয়ে যাই।
জীবন--তোমার অস্ত হলে
দেহ আগুনে পোড়ালেও কষ্ট হবে না
কবরে পঁচালেও না!
জানি—অনুভূতিহীন নিথর দেহ ক্ষয়ে যাবে আঁধারে
তবুও বৃত্তে ঘুরি, বৃত্তে হাসি, বৃত্তেই কাঁদি।
হয়তো বৃত্ত আঁকতে হলে কেন্দ্রে ফিরে যেতে হয়
কেন্দ্র তুমি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম
তবুও বৃত্ত তোমায় ছাড়া অচল—অতল—শূন্য।
কেন্দ্র তুমি আমার জীবন
তুমিই আমার মরণ—তুমিই প্রকৃতি।
অভিঘাত
পশ্চিম দিক থেকে একটি মিছিল পূর্বদিকে ধেয়ে আসছে
এই মিছিলের কোনো শব্দ নেই
কোনো পদযাত্রা নেই
এমনকী মিছিলের কাউকে দেখতেও পাওয়া যায় না।
তবুও টের পাই মিছিলটি ধেয়ে আসছে
যেভাবে পশ্চিম দিগন্তের অস্তগামী সূর্য—
রাতের অন্ধকারে নীরবে নিভৃতে পূর্ব দিগন্তে উদিত হয়।
কবিতা যেভাবে পবিত্র হয়ে ওঠে
সেভাবে মিছিলটিও ছড়িয়ে যাচ্ছে
তোমার হৃদয় থেকে আমার হৃদয়ে
আমাদের হৃদয় থেকে তোমাদের হৃদয়ে।
সন্ধান
প্রার্থনা সঙ্গীতের সাথে ভেসে আসে—মৃত্যু চিৎকার
আমি শিশুর নরম হাত ধরে বসে থাকি
আর বামকানে শুনি প্রার্থনা সঙ্গীত, ডানকানে মৃত্যু চিৎকার।
ঘাসের গন্ধ প্রাণভরে নিয়ে ভাবি—
চিতার ঘাসগুলো কেন বড্ড সবুজ?
রাতের নির্জনতায় পাখপাখালির শব্দ
এখনও শুনতে পাই।
তাই প্রতিভোরে ঘুম থেকে জেগে
একজন মানুষের ভেতর আরেকজন মানুষকে খুঁজি।