হোসেনউদ্দীন হোসেনের উপন্যাস ‘সোনালি জলের কাঁকড়া’ : বিত্তের বাঁধনে বাঁধা ফাঁপা মানুষের আখ্যান

হোসেনউদ্দীন হোসেন বাংলাদেশের উপন্যাসের একজন ব্যতিক্রমধর্মী শিল্পী। ১৯৪১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম। তিনি হতে পারতেন একজন সম্ভ্রান্ত কৃষিজীবী, সাংবাদিক, সৈনিক কিংবা অন্য পেশাজীবী, কেননা উল্লেখিত ঐসব পেশার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন, কিন্তু এগুলোর কোনো কিছুই তিনি হতে চাননি। এসবের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস দ্রষ্টার জীবনবীক্ষা নিয়ে প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে হোসেনউদ্দীন হোসেন হয়ে উঠলেন সাহিত্যিক। সমাজেতিহাস কিংবা জীবন-বীক্ষণে তিনি আগ্রহী এবং উপন্যাসে তা বর্ণনেও থেকেছেন অকপট। ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, কবি, মননধর্মী গবেষক ইত্যাদি নানা অভিধায় তাঁকে অভিহিত করা যায়। ষাটের দশক থেকে সাহিত্য-সাধনায় ব্রতী থাকলেও তিনি লিখেছেন অল্পÑপাঁচটি উপন্যাস, একটি ছোটগল্প গ্রন্থ, একটি কাব্যগ্রন্থ এবং কিছু গবেষণাগ্রন্থ। ‘উপন্যাস তাঁর প্রথম ভালোবাসা। তাঁর উপন্যাসে ছড়িয়ে আছে সমগ্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষ, সমাজ, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পটভূমি, সর্বোপরি এ দেশের সংস্কার-বিশ্বাস, আচার-আচরণ সব মিলে বাংলাদেশের আত্মাকে তুলে ধরার আন্তরিক ও সনিষ্ঠ প্রয়াস রয়েছে তাঁর উপন্যাসে।’১ 
    তাঁর উপন্যাসগুলো হলো : ‘নষ্ট মানুষ’ (১৯৭৪), ‘প্লাবন এবং একজন নূহ’ (১৯৭৯), ‘সাধুহাটির লোকজন’ (২০০১), ‘ইঁদুর ও মানুষেরা’ (২০০৮) এবং ‘সোনালি জলের কাঁকড়া’ (২০১১)। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘বনভূমি ও অন্যান্য গল্প’ (২০১৩)। তাঁর একমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘শেষ বিদায়ের আগে’ (২০১৫)। এছাড়া রয়েছে তাঁর গবেষণাগ্রন্থ। উল্লেখযোগ্য গবেষণাগ্রন্থ দুই খ-ে প্রকাশিত ‘যশোর জেলার কিংবদন্তী’ ১ম খ- (১৯৭৪), ২য় খ- (১৯৭৯), ‘যশোরাদ্য দেশ’ (১৯৭৪), ‘অমৃত বৈদেশিক’ (১৯৭৫), ‘ভলতেয়ার-ফ্লবেয়ার-তলস্তয় : ত্রয়ী উপন্যাস ও যুগ মানস’ (১৯৮৮), দুই খ-ে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাঙলার বিদ্রোহ’ প্রথম খ- (২০০৩), দ্বিতীয় খ- (২০০৬), ‘ঐতিহ্য আধুনিকতা ও আহসান হাবীব’ (১৯৯৪) এবং ‘বিশ্বমানব : ভলতেয়ার’ (২০১৫)। এছাড়া রয়েছে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘রণক্ষেত্রে সারাবেলা’ (২০১২)। হোসেনউদ্দীন হোসেনের উপন্যাস ‘প্লাবন এবং একজন নূহ’ ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে ‘ঋষড়ড়ফ ধহফ ধ ঘড়ড়য’ নামে ব্রিটেনের মিনার্ভা প্রকাশনীর দিল্লি শাখা থেকে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থের জন্য তিনি ২০০৬ সালে ইংল্যান্ড থেকে ঞড়ঢ় ১০০ ডৎরঃবৎং স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। ‘ইঁদুর ও মানুষেরা’ উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে গরপব ধহফ গবহ নামে। এই উপন্যাসটি কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ‘বাংলাদেশের সাহিত্য’ কোর্সে পাঠ্য। ষাটের দশকে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। পরবর্তিতে তিনি বাঙালি রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ছিলেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধেও তিনি ছিলেন বীর গেরিলা যোদ্ধা।
    রচনাকাল বিবেচনায় হোসেনউদ্দীন হোসেনের তৃতীয় উপন্যাস ‘সোনালি জলের কাঁকড়া’। উপন্যাসটি ১৯৮০ সালে রচিত হলেও পা-ুলিপিটি হারিয়ে যাওয়ায় এটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১১ সালে। ‘সোনালি জলের কাঁকড়া’ উপন্যাসটির কাহিনি সরল এবং একরৈখিক। পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তির বিত্তের প্রতি মোহ এবং এক অসম প্রতিযোগিতায় নেমে তার হৃদয়বৃত্তিক সংকট, টানাপোড়েন, অবিশ্বাস, দ্বিধা, দ্বন্দ্ব উপন্যাসটিতে প্রতীকায়িত হয়েছে। পুঁজির মোহ ব্যক্তি-চেতনাকে এমনভাবে গ্রাস করে যে তা থেকে সে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারে না। ‘ব্যক্তিচৈতন্যের সঙ্গে সমাজ-পরিবেশের সম্পর্ক ওতপ্রোত।’২ 
    সে যখন তার চারপাশে বিত্তবানদের দৌরাত্ম, আধিপত্য, গুরুত্ব দেখতে পায় তখন বিত্তের অধিকারী হতে সে-ও মরিয়া হয়ে ওঠে। তখন ব্যক্তি কেবল রুদ্ধশ্বাসে দৌঁড়াতে থাকে পুঁজির পাহাড় গড়তে। তারই অন্তরালে তার মানবিক তথা হৃদয়বৃত্তিক সম্পর্কগুলো আলগা হতে থাকে। এভাবে চলতে চলতে একসময় সে ফাঁপা মানুষে পরিণত হয়। অর্থ তাকে প্রকৃত সুখ দিতে পারে না। অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, অবিশ্বাস, সন্দেহ, নৈঃসঙ্গতা তাকে গ্রাস করে ফেলে। শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি হয়ে ওঠে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ‘সোনালি জলের কাঁকড়া’ উপন্যাসে হোসেনউদ্দীন হোসেন কতিপয় চরিত্রের মাধ্যমে ব্যক্তির সেই আত্ম-সংকটকে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটির স্থানিক পটভূমি হিসেবে উঠে এসেছে কলকাতা শহর এবং বাংলাদেশের কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত। আর এর কালিক প্রেক্ষাপট হলো অবিভক্ত ভারত তথা বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ, অর্থাৎ যখন সারা বিশ্বে ঘটে যায় প্রথম মহাযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘটনা। আর এই দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের জন্য সংঘটিত হতে থাকে নানা আন্দোলন-সংগ্রাম। আবার ‘উৎপাদন সম্পর্কের নিরিখে সমাজ পরিবর্তন হয়, আর এ প্রেক্ষিত থেকেই গড়ে ওঠে আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো।’৩ 
    সামাজিক রূপান্তরের দিক থেকে সামন্ত সমাজব্যবস্থা বিদীর্ণ করে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার ঘটে উত্থান। সেই কালিক প্রেক্ষাপটে বিত্তের মোহে আবিষ্ট ব্যক্তি-চৈতন্যের যে সংকট, ঔপন্যাসিক একজন সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে এখানে তা তুলে এনেছেন। বলা যায় ‘উপন্যাসে চরিত্রই ঘটনার উদ্বোধক ও উত্তেজক।’৪ 
‘সোনালি জলের কাঁকড়া’ উপন্যাসের কাহিনিও চরিত্রকেন্দ্রিক। উপন্যাসটির প্রাধান চরিত্র শরাফী। শরাফীর বিত্তের উত্থান এবং হার্দিক সম্পর্কের সংকট উপন্যাসটির মৌল উপাদান। শরাফীর পুঁজির প্রতিভূ হয়ে ওঠার যাত্রারম্ভ হয়েছিল অবশ্য তার প্রপিতামহের সময় থেকে। তার প্রপিতামহ জুনায়েদ যখন ব্যবসায়ের জন্য পুঁজি বিনিয়োগ শুরু করেছিলেন তখন ভারতীয় উপমহাদেশে দেশীয়দের পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ ছিল না। তখন এদেশে কেবল বেসরকারি ব্রিটিশ একচেঞ্জ ব্যাংকের মাধ্যমেই সব লেনদেন হতো। সেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই তিনি ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে কলকাতায় খুলেছিলেন জয়েন্টস্টক ব্যাংক। সেটাই ছিলো শরাফীদের পারিবারিক বিত্তের বুনিয়াদ গড়ে তোলার প্রথম পদক্ষেপ। সেই সঙ্গে সময় এবং পরিস্থিতিও সহায়ক হয়েছিল তাদের। জয়েন্টস্টক ব্যাংক খোলার কয়েক বছরের মধ্যেই শুরু হয় প্রথম মহাযুদ্ধ। আর তাতেই ভাগ্যের পালে হাওয়া লাগে জুনায়েদ সাহেবের। ইউরোপের যুদ্ধ যতো তীব্র হয়, ভারতের বাজার ততোই চলে যায় আমেরিকা ও জাপানের দখলে। ফলে ব্রিটিশরা ভারতের বাজারে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগান দিতে ব্যর্থ হয়। সেই বাতাবরণে দেশীয় পুঁজির বিকাশের পথ হয় প্রশস্ত। ঐ সময় যখন কাপড়ের অভাব দেখা দেয় তখন জুনায়েদ গড়ে তোলেন কাপড়ের মিল। একদিকে ছিল বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ, অন্যদিকে ব্রিটিশ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলন। বিদেশি দ্রব্য বর্জনের যে ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল সারা দেশে সেই আবহে জুনায়েদ সাহেবের পুঁজি দেখতে দেখতে ফুলে ফেঁপে ওঠে। সেই থেকে তিন পুরুষানুক্রমে শরাফীর বর্তমান অবস্থা।
    ব্রিটিশদের শোষণ-বঞ্চনা আর পক্ষপাত নীতিকে মোকাবিলা করে এ দেশীয়দের ব্যবসা করতে হতো। ইংল্যান্ডের শিল্পজাত দ্রব্যকে তারা ভারতীয়দের নিতে বাধ্য করেছে। সেই সঙ্গে তারা ভারতীয় পুঁজি তথা শিল্পজাত দ্রব্যকে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ এবং ভারতে স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে। দেশীয় পুঁজি বিনিয়োগ তথা দেশীয় পণ্য উৎপাদনের জন্য গড়ে ওঠা মিল-কলকারখানাগুলোতে নতুন শর্ত আরোপ এবং উৎপাদিত পণ্যের ওপর অত্যধিক শুল্ক বসিয়ে মূলত ব্রিটিশরা দেশীয় পুঁজিকে নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছিল। অন্যদিকে বিলেত থেকে আমদানিকৃত পণ্যের জন্য কোনো শুল্ক দিতে হতো না। দেশীয় বিনিয়োগ যাতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারে ব্রিটিশ সরকার তার যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিল। জুনায়েদ সাহেবের মন্তব্যে সেই সত্যই প্রতিফলিত হয়েছে : 
আমাদের উপর সরকারের কোনো ফেথ নেইÑএকটুও সুদৃষ্টিতে দেখছে না। এই     দেখ, কাপড়ের কলের উপর কয়েকদিন আগে আবার নতুন এক্সাইজ ডিউটি     বসিয়েছে।...উইভিং অ্যান্ড স্পিনিঙের উপর ওদের কড়া শ্যেন দৃষ্টি। আবার শোনা     যাচ্ছে সাহেবরা যে সব বিলেতি কাপড় এদেশে আমদানি করছে তার নাকি শুল্ক দিতে     হবে না। আসলে কথা হলো, আমরা যাতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারি,     এটা তারই ষড়যন্ত্র।৫ 
তবুও ঐ প্রতিকূলতার মধ্যেও জুনায়েদ সাহেব আশার আলো দেখেছিলেনÑস্বদেশি আন্দোলন দিন দিন বেগবান হতে দেখে। আশাবাদী হয়েছিলেন ব্রিটিশদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে দেশীয় শিল্পের বিকাশের সম্ভাবনায়। জুনায়েদ সাহেবের উক্তিটি উল্লেখযোগ্য : 
‘এখন সাগর পারের ব্যাটাদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। কবে যে পাততাড়ি     গুটাবে, সেই ব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে জোরদার হচ্ছে। চলে যাবার আগে ওরা একটা কামড়     দিচ্ছেÑমরণ কামড়।’৬ 
ঐ প্রেক্ষাপটেই শরাফী পিতার ব্যবসায়ের হাল ধরে। স্বদেশি আন্দোলনের প্রবল জোয়ারের মধ্যে সে ব্যবসায়ের উন্নতিকে অব্যাহত রাখার চ্যালেঞ্জ নেয়। স্বদেশি আন্দোলনের বাতাবরণে দেখা দেয় শ্রমিক বিদ্রোহ। শরাফী স্বদেশি আন্দোলন তথা বিদেশি দ্রব্য বর্জন সমর্থন করলেও শ্রমিক ধর্মঘটকে সমর্থন করতে পারে না। কেননা যে কোনো শ্রমিক আন্দোলনই বুর্জুয়াশ্রেণির স্বার্থ বিরোধী। তাই সে তা মেনে নিতে পারেনি। বরং তাদেরকে যারা প্রশ্রয় দিয়েছে তাদের প্রতিও বিদ্বেষ পোষণ করতে ছাড়েনি সে। শ্রমিকদের নিয়ে ব্যারিস্টার চমনলাল ও জোসেফ ব্যাপ্টিস্টা যে সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, এই শ্রমিক বিদ্রোহ তারই ফল বলে মনে করে সে। এই জন্য শরাফী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা মহাত্মা গান্ধীকেও মনে মনে দোষারোপ করতে বাকী রাখে না। এক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় শরাফী বুর্জুয়াশ্রেণির স্বার্থের বাইরে কিছু ভাবতে পারেনি। এখানে বুর্জুয়াশ্রেণি এবং শ্রমিকশ্রেণির যে নিরন্তর মনস্তাত্তিক দ্বন্দ্ব তারই প্রতিফলন ঘটেছে। সে বিশ্বাস করে শ্রমিকদের এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করা উচিৎ নয়। কেননা তারা লাগাতার ধর্মঘট করলে দেশীয় কলকারখানা অচল হয়ে পড়ে। ফলে ক্ষতি হয় দেশীয় শিল্পেরÑশিল্পপতিদের। আবার শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের অন্তরালে তারা যে জাতীয় রাজনীতিতেও একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে তা বুঝতেও শরাফীর অসুবিধা হয় না। যে কারণে, তাদের উত্থান ভারতে ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির জন্য অশনি সংকেত হলেও উঠতি বুর্জোয়াশ্রেণির জন্য শুভ হবে না বলেই শরাফী মনে করে।
    দেশব্যাপী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মুখে পড়ে সুতার কলকারখানাগুলো ইংরেজরা বিক্রি করে দিতে থাকে। শরাফীও সেই সুযোগে একের পর এক অনেকগুলি কলকারখানা ক্রয় করে নেয়। বিশ্বজুড়ে যখন যুদ্ধের দামামা, মন্দা, বাজারভিত্তিক অর্থনীতি যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে তখন শরাফী নিজের উত্থানে নিজেই বিস্ময়বোধ করে। যে যুদ্ধ মানুষের জন্য বয়ে আনে অকল্যাণ, সেই যুদ্ধ তার জন্য বয়ে এনেছে সুখ ও সমৃদ্ধি। এভাবেই লেখক শরাফীর পুঁজিপতি হবার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে তার মানসিক সংকটের দিককেই নির্দেশ করেছেন। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে যেমন পুঁজির ভারসাম্য থাকে না, তেমনি থাকে না হৃদয়বৃত্তিক সম্পর্কের ভারসাম্য। পুঁজির ভারসাম্যহীনতা থেকে সমাজের অবক্ষয় যেমন সূচিত হয় তেমনি ব্যক্তির উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও যায় বেড়ে। 
    উপন্যাসটির প্রথম অংশ থেকে দ্বিতীয় অংশের মধ্যে বেশ কিছু সময়ের ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। প্রথম অংশে যুবক শরাফীর ব্যবসায়ে বিশেষ মনোযোগ ও কেবল কলকারখানা, শ্রমিক, দেশ-বিদেশ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা যায়। তার ব্যবসায়ীক উন্নয়নে পটভূমি হিসেবে লেখক দেশকালের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় অংশে সম্পূর্ণ ভিন্ন আবহে কাহিনির সূত্রপাত ঘটেছে। এখানে ষাটোর্দ্ধ প্রৌঢ় ভগ্ন শরীরের শরাফী বড় ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। জীবনের এই পর্যায়ে একাকীত্ব তাকে গ্রাস করতে চায়। স্ত্রী লীনার সঙ্গে তার সম্পর্কের শিথিলতাও পরিলক্ষ্যযোগ্য। শরাফী ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করতে চায়। যেখানে আছে কেবল ব্যস্ততা আর শূন্যতা। শারীরিক অবসন্নতা কাটাতে এবং স্ত্রী লীনাকে কিছুটা সময় দিতেই শরাফী কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে আসে। বিত্তের হাত ছানি থেকে দূরে প্রাকৃতিক পরিবেশে সে কিছুটা স্বস্তিবোধ করলেও তার সেই অনুভূতি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। কিছু দিন যেতে না যেতেই তার মনে বিরোক্তির উদ্রেক করে এবং ঐভাবে সময় কাটানোকে সে অর্থহীন বিবেচনা করে। শরাফীর উপলব্ধিতে :
আমি একজন মাল্টিমিলিয়ানার। মিল আছে। কারখানা আছে। হাজার শ্রমিক খাটছে।     গাড়ি আছে। বাড়ি আছে। জীবনে সে বহু কিছু উপভোগ করেছে। নিষ্কর্মা,    অপদার্থ     ব্যক্তিদের মতো, বেহেড, মাতালের মতো কেন এভাবে নিজেকে ধ্বংস করা? ঘরে     বসে বসে কারখানার ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনতে পায় শরাফী। শব্দটা ক্রমান্বয়ে     জোরালো হয়ে ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে লাট্টিমের মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে যায় তার     মাথার ভেতরে।৭ 
বিষয়, সম্পদ, মিল-কলকারখানার চিন্তা তার মধ্যে কেবল কাজ করতে থাকে। অভ্যস্থ জীবনাকাক্সক্ষা তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে। কখনো ভেবেছে এভাবে প্রকৃতি তথা সমুদ্রের সান্নিধ্যে তার আসা হয়নি, কিংবা স্ত্রী লীনাকে এভাবে পাওয়া হয়নি। আবার পরক্ষণেই তার পেশাগত দায়িত্ব তাকে তাড়িত করেছে। সেই কর্তব্যের কাছে স্ত্রী লীনা কখনো গুরুত্ব পায়নি। আর এভাবেই অবহেলা আর উপেক্ষার শিকার হয়ে লীনার সাথে তার মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয় তার অজ্ঞাতেই। লীনার প্রতি শরাফীর এই উদাসীনতা হঠাৎ গড়ে ওঠেনি। তার স্বভাবের ঐ পরিবর্তন ঘটেছে ধীরে ধীরে। শরাফীর চেতনা জুড়ে লীনার যে জায়গাটি ছিল তা দখল করেছে সম্পদের মোহ। ঐ মোহ ক্রমান্বয়ে লীনার পৃথিবী থেকে তাকে পৃথক করে দিয়েছে। লীনা তার ঐ পরিবর্তন উপলব্ধি করেছে কিন্তু প্রতিকার চায়নি। বরং শরাফীকে ভুলে থাকতে লীনা বৃত্তাবদ্ধ জীবনে লব্ধ স্মৃতি সন্ধানে সুখ খুঁজে নিয়েছে। আসলে এভাবে সুখী হওয়া কল্পনা মাত্র। লীনার জীবনে সুখী হওয়ার ঐ প্রয়াস কল্পনায় পর্যবসিত হয়েছে। তার স্বপ্ন-সাধ-ইচ্ছাগুলোকে সে কেবল অবদমিত করে গেছে।
    শরাফী এভাবে বদলে গেলেও আসলে সে বদলে যেতে চায়নি। তার বাস্তবতাই লীনা থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কেননা 
    ‘বাস্তবতাবোধের সঙ্গে সমাজবোধ তথা জীবনবোধ ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।’৮ 
একের পর এক নতুন নতুন মিল কলকারখানা ক্রয়, দেশে-বিদেশে ব্যবসায়ীক সম্পর্কের উন্নয়ন ও পরিচর্যা নিয়ে শরাফী এতটায় ব্যস্ত থাকে যে, সে পিছনে ফিরে তাকাতে পারেনি। কিন্তু পরনারী আসক্তি কিংবা বিশেষ কারো প্রণয় শরাফীর চরিত্রকে কলুষিত করতে পারেনি। কেবল বিত্তের মোহ তাকে পারিবারিক বন্ধন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আবার শরাফী অর্থ সরবরাহ ছাড়া পুত্র-কন্যার প্রতিও পিতা হিসেবে তার কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারে না। এটাই হয়তো শরাফীর মতো ধণিকশ্রেণির জীবন বাস্তবতা। শরাফী সেই জীবনবাস্তবতায় অভ্যস্থ হতে হতে দাম্পত্য সংকটের মুখে পতিত হয়েছে। শুধু তাই নয় পারিবারিক সম্পর্কের সকল বন্ধনগুলিই তার ভেঙে গেছে। তার  অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বসেছে।
    শরাফীর অসুস্থতার অবকাশে লীনা-শরাফী কক্সবাজার এলে, লীনা এই প্রথম প্রকৃতির কাছাকাছি এসে সে নিজেকে প্রকৃতির কাছে উজাড় করে দেয়। তার পুঞ্জিভূত কষ্ট যেন সমুদ্র অবগাহনে ধুয়ে মুছে ফেলতে চায়। তারই সমান্তরালে শরাফীর সঙ্গে লীনার বোঝাপড়ারও সুযোগ যেন এই সমুদ্র যাত্রা আয়োজন করে। অসুস্থ-দুর্বল-বিপর্যস্ত শরাফী উপলব্ধি করতে পারে লীনার সঙ্গে তার দাম্পত্যের বন্ধন আজ বড় শিথিল। এতটাই নাজুক যেন একটু নাড়া দিলেই ভেঙে পড়বে। বাস্তবিক হয়েছেও তাই। প্রকৃতির সান্নিধ্যে উচ্ছ্বল ও বেসামাল লীনা এখানে শরাফীর ওপর নির্ভর করেনি। বরং সৈকতে পরিচিত হওয়া আয়াজের সঙ্গে সে ঘুরে সময় কাটিয়েছে। শরাফীর অনুপস্থিতে অন্ধকার ঘরে সাদিকের মুখোমুখি বসে লীনা স্বামীর অবহেলার গ্লানি ধুয়ে মুছে ফেলতে চেয়েছে। আর এসব অবস্থা দৃষ্টে লীনার প্রতি শরাফীর অবিশ্বাস ও সন্দেহ জনিত ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে। যদিও লীনা চূড়ান্তভাবে তাদের দাম্পত্য সম্পর্কের অবমাননা করেনি। কিংবা নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়নি। ঐসব সম্ভাব্য পথে লীনা ইচ্ছে করলে অনেক আগেই পা রাখতে পারতো। কেননা শরাফী তাকে প্রাচুর্য-সমৃদ্ধি ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। এমন অবস্থায় লীনার মতো নারীর পক্ষে নতুন করে বন্ধু জুটিয়ে নেওয়া বিচিত্র ছিল না। ওসব কিছু না করা সত্ত্বেও শরাফী তার প্রতি অবিশ্বাস স্থাপন করে শুধু হৃদয়হীনতার পরিচয় দেয়নি, দিয়েছে অমানবিক ও বিকৃত মানসিকতার পরিচয়।
    লীনা চার দেয়ালের মাঝে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে ওঠে। তার মনের অব্যক্ত কষ্ট বা একাকীত্বের বেদনা শরাফী কখনো বুঝতে চায়নি। শরাফী তাকে প্রাচুর্য দিয়ে সুখী করতে চেয়েছে, কিন্তু প্রাচুর্য স্বস্তি দিলেও মানসিক সুখ দিতে পারে না, সেটা শরাফী বুঝতে চায়নি কিংবা বোঝার অবকাশ করতে পারেনি। লীনা শরাফীর সঙ্গে সমুদ্র সৈকতে অবকাশ যাপনে আসলে শরাফীর মাঝে সে সুখের সন্ধান করেনি, বরং স্বল্প পরিচিত আয়াজ কিংবা সাদিকের সান্নিধ্যে নিজের না পাওয়া সুখের সন্ধান করতে চেয়েছে। এক পর্যায়ে শরাফী থেকে লীনা মানসিকভাবে এতটাই দূরে অবস্থান করে যে তার সান্নিধ্য লীনার জন্য হয়ে ওঠে বিষময়। যদিও শরাফীকে সে কখনো তা বুঝতে দেয়নি। বরং সে শরাফীকে করুণা করে গেছে তাকে পরিত্যাগ না করে। অবকাশ যাপনে শরাফীর সঙ্গে লীনার রাত্রি যাপনের উপলব্ধিতে সেই সত্যই উদ্ভিন্ন হয়েছে। ঔপন্যাসিকের ভাষায় : 
লীনা ওকে নিয়ে আর একটুও ভাবতে চায় না। ভাবতে একটুও ভালো লাগে না ওর।     কিছুতেই ঘুমুতে পারে না সে। ঘুমের ভান করে চোখ বুঝে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই     সে টের পায় শরাফী জেগে নেইÑঘুমিয়ে পড়েছে। নাকের ছিদ্র দিয়ে ঘোত ঘোত     আওয়াজ বেরিয়ে আসে। বিশ্রী শব্দ। গাল হা করা। ফুরফুর করে বাতাস ঢুকছে     ভেতরে। এভাবে শুয়ে থাকা অসহ্য লাগে ওর। মাথার ভেতর মনে হয় কে যেন     হাতুড়ি পিটিয়ে চলেছে। বসে বসে হাপাতে থাকে লীনা। রাতটা কখন শেষ হবেÑ     তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে সে।৯ 
স্বামীর সঙ্গহীনতার যন্ত্রণায় লীনার মন এমনভাবে বিষিয়ে ওঠে যে, এক সময় তার সঙ্গ লীনার কাছে অপ্রত্যাশিত হয়ে পড়ে। শরাফী নয় বরং আয়াজ কিংবা সাদিকের সান্নিধ্য লীনা উপভোগ করেছে। ক্লান্ত-অবসন্ন শরাফী তাকে সঙ্গ দিতে ব্যর্থ হলে, অল্প দিনেই আয়াজের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। লীনা তাকে নিয়ে প্রকৃতির মাঝে খুঁজে ফিরেছে তার যৌবনের ফেলে আসা দিন। কিংবা সাদিকের চোখে চোখ রেখে তার অব্যক্ত কথা যেন ব্যক্ত করতে চেয়েছে। শরাফী লীনাকে ভালোবেসে বিয়ে করলেও লীনার মনের কথা সে কখনো জানতে চায়নি। কিসে লীনা সুখ পায় সেই কথাও ভেবে দেখিনি। লীনাকে সঙ্গ দিতে না পারার শূন্যতাকে গহনা, শাড়ি, দামি গাড়ি দিয়ে ভরিয়ে দিতে চেয়েছে শরাফী। কিন্তু লীনা এসব নিয়ে কখনো মশগুল থাকতে পারেনি। প্রাচুর্য নয় বরং সে প্রকৃতির মধ্যে তার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। লীনার জবানিতে : 
    ‘সত্য কথা বলতে কী এই যান্ত্রিকতা আমাকে ক্লান্ত করে দিচ্ছে। বার বার মনে হয়,     আমরা অর্থাৎ এই মানুষেরা নিসর্গ থেকে যতই দূরে চলে এসেছি, ততই আমাদের     অন্তর বিষময় হয়ে উঠেছে।’১০  
লীনা শরাফীর মধ্যে নিজের স্বপ্ন-সুখের সন্ধান না পেলেও তাকে কখনো ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি, কিংবা দ্বিচারিণী হয়নি। আয়াজ কিংবা সাদিকের সান্নিধ্য উপভোগ করলেও তাদের নিয়ে জীবনের বাকি পথ পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দ্যাখেনি। লীনাকে বুঝতে না পারার ব্যর্থতা থেকে শরাফীর মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস, সন্দেহ দানা বাঁধে। সে বার বার লীনাকে সন্দেহ করে লীনা এবং তার মানসিক দূরত্বকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। আবার ঐ অবিশ্বাস এবং সন্দেহ অনর্থক বিবেচনা করে শরাফী অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছেÑ নিজের মনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করেছে। শরাফীর উপলব্ধিতে : 
    কেন এত সন্দেহ আর অবিশ্বাস। আমি কেন এত নির্মম পাষাণের মতো হৃদয়হীন     হয়ে গেলাম। অনেক নিষ্ঠুর হয়েছি     আমি। কেন আমি সবকিছু সহজভাবে ভাবতে     পারি না। নিজের প্রতি ধিক্কার দিতে থাকে শরাফী।১১  
অপরিসীম সম্পদলিপ্সা শরাফীকে অতৃপ্ত করে তোলে। সে কোনো কিছুতে তৃপ্তি পায় না। কারো প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে নাÑএমনকি নিজেকেও নয়। লীনার মন্তব্যে তারই প্রতিফলন লক্ষ্যযোগ্য : 
তুমি দিনে দিনে যান্ত্রিক হয়ে উঠেছ। তোমার মন অতৃপ্ততার বেদনায় ভরা। মানুষের     মনের ভেতরেও একটা মন     আছে। তোমার সেই মনটুকু তুমি হারিয়ে ফেলেছ। এই     মোহ থেকে তুমি কোনো দিন মুক্তি খুঁজে পাবে না।১২  
ঐ যান্ত্রিকতায় শরাফী এবং লীনার সম্পর্ককে শিথিল করে তোলে এবং শেষ পর্যন্ত দাম্পত্য সম্পর্কের ভাঙনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। তাদের এত দিনের সংসার, সম্পর্ক, পুত্র-কন্যা কোনো কিছুই তা রোধ করতে পারে না। লীনা হয়তো আপ্রাণ চেষ্টা করেছে নিজেকে শরাফীর জীবনে মানিয়ে নিতে। তার ব্যস্ততা, অবহেলা, উপেক্ষা সহজভাবে গ্রহণ করার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত শরাফীর অবিশ্বাস, সন্দেহ তাদের সম্পর্কের পরিণতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। যে পরিণতি শরাফী কিংবা লীনা কারো কাছেই কাক্সিক্ষত নয়, তবু সেই অনিবার্য বিচ্ছেদ থেকে যেন মুক্তি নেই তাদের। তাই লীনা শরাফীর কাছ থেকে মুক্তি চায়। শরাফীও তার মুক্তির পথে আর বাধা হতে চায়নি। কেননা সে জানে তাতে তাদের ঐ আলগা সম্পর্ক আর জোড়া দেয়া সম্ভব নয়। বিত্তবান শরাফী বিত্তবৈভবে তাকে আর বাঁধতে পারে না। সর্বগ্রাসী অসহায়ত্ব নিয়ে সে তার অনিবার্য পরিণতিকে বরণ করে নেয়। লীনাও একাকীত্ব আর অসহায়ত্বকে সঙ্গী করে অনিশ্চয়তার গহ্বরে নিপতিত হয়েছে। শরাফী, লীনা এবং বিদেশে অধ্যয়নরত তাদের দুই পুত্র-কন্যা এক একটি ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপের মতো হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদী জীবনাকাক্সক্ষা তাদের এই বিরূপ বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
    পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে দাম্পত্যের ভাঙন একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হয়। এ থেকে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা, হতাশা, নৈরাশ্য, নৈঃসঙ্গতা সৃষ্টি হয়। পারিবারিক অস্থিরতা, পারস্পরিক সম্পর্কহীনতা তথা বিচ্ছিন্নতা থেকে জন্ম নেয় হতাশা। হতাশা থেকেই বিভিন্ন ধরনের সামাজিক অপরাধমূলক কর্মকা-ে ব্যক্তি উদ্বুদ্ধ হতে পারে। পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রিক এমনকি বৈশ্বিক অস্থিরতা, অবক্ষয়, সন্ত্রাসবাদে তারা জড়িয়ে পড়ে। হোসেনউদ্দীন হোসেনের পর্যবেক্ষণ শক্তির অমিত সম্ভাবনাসূত্রে ‘সোনালি জলের কাঁকড়া’ উপন্যাসটিতে পুঁজিবাদী জীবনে ব্যক্তির অস্তিত্বকে বিপন্নকারী সমস্যার রূপ উদ্ভিন্ন হয়েছে। আধুনিক জীবনের এমন একটি অনুষঙ্গকে উপন্যাসের বিষয় করে হোসেনউদ্দীন হোসেন নিঃসন্দেহে মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। যদিও উপন্যাসটি শিল্পগুণসম্মত হয়ে ওঠার কিছু অন্তরায় সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না। তারপরও বিষয় ও জীবন-ভাবনার অভিনবত্বে ‘সোনালি জলের কাঁকড়া’ বাংলাদেশের উপন্যাসে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। 
    হোসেনউদ্দীন হোসেন বাংলাদেশের উপন্যাসের একজন স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের উপন্যাস নিয়ে যাঁরা উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছেন তাঁদের বিবেচনায় তিনি বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছেন। যদিও রচনার সংখ্যা উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু তাঁর উপন্যাস রচনার ব্যাপ্তিকাল প্রায় চার দশক। তিনি কেবল লেখার জন্য লেখনি ধারণ করেননি। জীবনাভিজ্ঞতা ব্যক্তের অদম্য স্পৃহা থেকেই তাঁর লেখক হয়ে ওঠা। 
    ‘জীবনের অভিজ্ঞতা খুব আশ্চর্যজনকভাবে শিল্পে রূপান্তরিত হয়। একে প্রচলিত     অর্থে নিছক প্রতিফলন বলে ভাবা চলে না।’১৩ 
সেই অভিজ্ঞতা বা জীবনবোধ প্রকাশে তিনি হয়ে উঠেছেন অকপট, সাহসী এবং আপোষহীন। এ প্রসঙ্গে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের অঘোষিত দলিল ‘ইঁদুর ও মানুষেরা’ উপন্যাসের কথা উল্লেখ করা যায়। তাঁর জীবনভাবনার বাতাবরণে নির্মিত আরেক উপন্যাস ‘সাধুহাটির লোকজন’। লেখক হিসেবে এসব উপন্যাস তাঁর সামর্থ্যরেই পরিচয়বাহী। তাঁর বৈচিত্র্যময় জীবন-জিজ্ঞাসা থেকে উত্থিত উপন্যাস ‘সোনালি জলের কাঁকড়া’। এখানে তিনি ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাসকে উপন্যাসের অনুষঙ্গ করে ব্যক্তির আত্ম-সংকটের রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। উপন্যাসটির নামকরণ সেই ইঙ্গিত দেয়। এখানে সোনালি জল হলো বিত্তবৈভব এবং কাঁকড়া ঐ বিত্তের মোহে আচ্ছন্ন হৃদয়বৃত্তি-আবেগ-অনুভূতি হারানো মানুষ। আবার চরিত্র সৃষ্টিতে তাঁর মুন্সিয়ানার পরিচয় মেলে। ‘সোনালি জলের কাঁকড়া’তে কিছু আঁচড়ে তিনি মূর্ত করেছেন কয়েকটি চরিত্র। যারা স্বভাবসুলভভাবে উপন্যাসে তাদের স্বরূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। হোসেনউদ্দীন হোসেন পরিবর্তনশীল সমাজবাস্তবতার রূপান্তরের স্বরূপ-সন্ধানে ব্রতী হনÑবিশ্লেষণ করেন দ্বন্দ্ব-মুখর সমাজ ও তার পরিবর্তন। তাঁর অন্তর্দৃষ্টি যে সমাজ অসংলগ্নতাকে চিত্রিত করে সেখানে তিনি হয়ে ওঠেন বিবেকী শিল্পী, তাত্ত্বিক কিংবা সংস্কারক নন। এসবের মধ্যে উন্মোচিত হয় তাঁর সাহিত্যিক দায়বদ্ধতা। তাঁর জীবন চেতনা প্রগতি-ভাবনা দ্বারা চালিত। যে কারণে একজন যথার্থ প্রগতিশীল কথাসাহিত্যিক হিসেবে হোসেনউদ্দীন হোসেনকে চিহ্নিত করা যায়। 
 

menu
menu