তাসখন্দের সুফি চিত্রকর

(সঞ্জয় দে-র এখন পর্যন্ত পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ভ্রমণ কাহিনি লিখতে পছন্দ করেন। ঘুংঘুর-এর পাঠকদের জন্য তাঁর সময় প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য তাসখন্দের সুফি চিত্রকর গ্রন্থের একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং নির্বাচিত অংশ প্রকাশ করা হলো।)

বইটি সম্পর্কে কিছু কথা

ককেশাস অঞ্চলের দেশ জর্জিয়ার রাজধানী তিব্লিসিতে ভ্রমণের একপর্যায়ে লেখক খুঁজে পান কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এক ছাপাখানা। সোভিয়েত দেশের এক নম্বর মানুষ হবারও বহু আগে এই ছাপাখানা থেকেই স্তালিন লুকিয়ে চুরিয়ে ইস্তেহার ছাপাতেন। ছাপাখানার ছাইচাপা ইতিহাস আবিষ্কারের পর নেহাত দৈবক্রমে লেখকের সাথে পরিচয় হয় এ সময়ের জনপ্রিয় জর্জিয়ান লেখক দাতো তুরাশভিলির। দাতো লেখককে তার বন্ধুসভায় নিমন্ত্রণ জানান। সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে আরও কয়েকজন মানুষের সাথে পরিচয় হবার সূত্রে লেখক জানতে পারেন সাম্প্রতিক সময়ে জর্জিয়ার রাজনৈতিক টানাপোড়ানের ইতিবৃত্ত। এরপর আমরা লেখককে খুঁজে পাই মধ্য এশিয়ায়। উজবেকিস্তানের সমরকন্দ শহরে তৈমুর লং—এর সমাধি আর ইমাম বুখারির মাজার দর্শনের পর বুখারা শহরের সুউচ্চ মিনার আমাদেরকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। সেখানে গিয়ে জাপানি তরুণী সাউরির মুখ থেকে শুনি ভিন্ন দেশের ভিন্ন সমাজের ছিন্নকথা। সাউরিকে বিদায় জানিয়ে রাজধানী তাসখন্দে এলে কুকেলবাসি মাদ্রাসার দুয়ার খুলে অভ্যর্থনা জানান এক রহস্যময় চিত্রকর। মাদ্রাসার ভেতরকার একটি ঘরকেই যিনি বানিয়েছেন চিত্রশালা। তার কাছ থেকে নানা কৌতূহলী প্রশ্নের জবাব মিলবার পর আমরা এবারে পাড়ি জমাই কাজাখস্তানের এক সময়কার রাজধানী শহর আলমাটি-তে, যেখানে নীলনয়না এক জার্মান-রুশি নারী আমাদের জন্যে তার জীবনের আলেখ্য নিয়ে অপেক্ষমাণ।

বুখারার বারো রকমের মানুষ

চাষের পুকুরে খাবারের দলা ছুড়ে দিলে যেমন করে ছুটে আসে লোভী মাছের দল, বুখারা স্টেশনে পদার্পণ মাত্র ঠিক সেভাবেই আমাদের দিকে ছুটে আসে ট্যাক্সিচালকের একটি ছোটখাটো দল। অবশ্য ওদের মূল নিশানা আমি নই, বরং আমার সঙ্গে থাকা জাপানি তরুণী সাউরি। ওদের এভাবে তেড়ে আসতে দেখে সাউরি বেশ খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। দৃষ্টিতে একধরনের আর্তি নিয়ে ও আমার দিকে তাকায়, যার অর্থ হলো আমাকে উদ্ধার করো এখান থেকে। আমি বাঙাল মুলুকের লোক। এমন ট্যাক্সিচালক, মুটে, দালালদের চক্রব্যূহ ভেদ করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রশিক্ষণ আমার বিলক্ষণ আছে। আমি সেই তালিমখানা কাজে লাগিয়ে ওদের দিকে ফিরে বলি, সরুন, যেতে দিন, এখানকার টিকিটঘরে আমাদের কিছু কাজ আছে। অর্থাৎ, এখনই ট্যাক্সি নিয়ে শহরের দিকে যাচ্ছি না। ওতে কিছুটা কাজ হয়। ব্যূহটি ভেঙে যায়। যদিও দু-একজন নাছোড়বান্দার মতো আমাদের নীরবে অনুসরণ করে। আমি কিন্তু মিথ্যে বলিনি। এখান থেকে দুদিন বাদে আমি যাব তাসখন্দে আর সাউরি যাবে পুবের শহর কিভায়। তার জন্য আগেই ট্রেন টিকিট কিনে ফেলে নিশ্চিন্ত হতে চাই আমরা।

সাউরির সঙ্গে আমার পরিচয় সমরখন্দ থেকে বুখারা আসার পথেই। লাগেজ র‌্যাকে মাল রাখার পর খেয়াল করি, পাশের সিটে লেবুপাতা রঙের জ্যাকেট গায়ে দিয়ে যে মেয়েটি বসে আছে, সে হয়তো স্থানীয় নয়। সামনের ট্রে টেবিলে রাখা সিলভার রঙের নাইকন পয়েন্ট অ্যান্ড শুট ক্যামেরাই আমাকে সে কথা জানিয়ে দেয়। মেয়েটির চেহারা প্রাচ্যদেশীয় হওয়ায় আমি কিন্তু প্রথমেই কিছুটা দমে যাই। কারণ, পূর্বাভিজ্ঞতায় দেখেছি, ভাষাগত সীমাবদ্ধতার কারণে যাত্রাপথে এরা সহযাত্রীর সঙ্গে খুব একটা আলাপচারিতায় যুক্ত হয় না। এ মেয়েটিও তেমন কি না কে জানে! আমি তাই ওর প্রতি খুব একটা উৎসাহ না দেখিয়ে ট্রেনের দুলে ওঠার অপেক্ষায় থাকি। ‘তুমিও নিশ্চয়ই বুখারায় চলেছ?’ প্রশ্নটি আমি নই, বরং ছুটে আসে মেয়েটির তরফ থেকে। কয়েক মিনিট বাদে। সেই প্রশ্নেই বুঝতে পারি, দুজনের মধ্যে কথাবার্তায় ভাষা হয়তো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে না।

পথ চলতে গিয়ে পরিচয় হওয়া কারও সঙ্গে সহজ হওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই প্রাথমিকভাবে খানিক কুণ্ঠিত হন। একেবারে শুরুর দিকে সাউরির মধ্যে তেমন একটি বোধের উপস্থিতি আমি ধরতে পারলেও সেই মেঘের আবছায়া কেটে যায় যেন সহসাই। পাকদণ্ডী বেয়ে হিল স্টেশনের দিকে ছুটে চলে হঠাৎ একসময় যেভাবে চোখের সামনে অকস্মাৎ ভেসে ওঠে সতেজ শহর, ঠিক তেমনি আমরাও কথার অলিগলির মাঝে হাঁটতে গিয়ে আবিষ্কার করি দুজনের মাঝের এক আচম্বিক যোগসূত্র। প্রায় দুদশক আগে সাউরি এসেছিল আমেরিকায়। হোটেল ব্যবস্থাপনা পড়তে। মজার ব্যাপার হলো, যে কলেজে ও ভর্তি হয়েছিল, সেই কলেজ হলো আমার বর্তমান নিবাস থেকে মাইল পাঁচেক দূরে। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর সাউরি তাই খুলে বসে স্মৃতির জানালা। সেই জানালা গলে কুয়াশার মতোই হুড়মুড়িয়ে এসে ঢোকে ফেলে আসা সময়ের ছেলেবন্ধুর অকালবিস্মৃত মুখ। কলেজের পাশের ‘হোয়াইট লাইম পাব’-এ সোনালি মদিরায় ডুবে যেতে যেতে যার সঙ্গে সাউরির প্রথম পরিচয়। নিঃশব্দে আরও এসে কড়া নাড়ে সান ডিয়েগো শহরের নানান স্মৃতি, যে স্মৃতিগুলোর কিছু কিছু আজ ম্যাটওয়াশ পেপারে প্রিন্ট হয়ে লুকিয়ে আছে ওর টোকিওর অ্যাপার্টমেন্টে।

‘তুমি সান ডিয়েগো ছেড়ে গেলে কেন? থেকে গেলেই তো পারতে।’  স্মৃতির শহর নিয়ে ওর উচ্ছ্বাস বাস্তবিকভাবেই আমার মধ্যে এ প্রশ্ন নিয়ে আসে।


সঞ্জয় দে, লেখক, তড়িৎ প্রকৌশলী, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র

menu
menu