মাহমুদ কচি-র সাক্ষাৎকার

সাহিত্যই জীবনের ধ্যান-জ্ঞান। সময়ের বৈঠায় জীবনের অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে। এ যেন গ্রহণলাগা জোছনায় হেঁটে চলা। নিজের উচ্চায়ত প্রকাশ, খ্যাতিকে ছুটি দিয়ে আপন গহনে ডুবে থাকাতেই আনন্দ। তাদেরকে নিয়ে ঘুংঘুরের নতুন আয়োজন ঘুংঘুরালাপ। এই পর্বে থাকছেন।

[আশির দশকের অন্যতম কবি মাহমুদ কচি কবিতার এক আদিগন্ত পথিক। হেঁটেছেন একাকী, নিজস্ব স্বরে, নিজস্ব জগতে তিনি বিচরণ করছেন। একাকী পথে নিজের সঙ্গেই যার চলা এবং নিজের সঙ্গে বলা কথাগুলো আমাদের কর্ণকুহরে বাক্সময় হয়ে ওঠে। আমাদেরকেও অন্য এক জগতে নিয়ে যায় অপার এক সৌন্দর্যের লীলায়। প্রফেসর মো. খোরশেদ আলম ও মোসাম্মৎ শাহিদা আক্তার-এর সন্তান মাহমুদ কচি জন্মগ্রহণ করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাতুলালয়ে ১৯৬০ সালে। পৈত্রিক নিবাস ঝাউতলা খ্রিস্টান পাড়া। মেট্রিকুলেশন পাশ করেন ১৯৭৫ সালে কুমিল্লা জিলা স্কুল থেকে। ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯৮১ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ]

গ্রন্থনা : মো. আরিফুল হাসান
আলোকচিত্র : শরীফ আহমেদ অলি


ঘুংঘুর : কচি ভাই, আপনি লেখালেখি ব্রত হিসেবে কখন থেকে নিলেন?
কচি : লেখালেখি ব্রত হিসেবে? হ্যাঁ, ব্রত হিসেবেও নেওয়া যায় লেখালেখি। আমি কতটুকু ব্রত হিসেবে নিতে পারছি লেখালেখিকে তা প্রশ্ন থেকে যায়। অবশ্য সেটি আমার কথা না। আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। আপনারা যদি  ওইভাবে দেখেন যে, আমি লেখালেখিকে ব্রত হিসেবে নিয়েছি-তাহলে ঠিক আছে মানলাম। 

ঘুংঘুর : শুরুটা কোথায় হয়েছিল? 
কচি : আমি প্রথম লেখালেখি কুমিল্লায় শুরু করি। প্রথমে আমার বিচরণ ছিল, কবিতা পাঠের আসরে। আমি তখন কবিতা লিখতাম। তো বিশেষ দিনগুলোতে আমি তখন কবিতা পাঠের আসরে অংশগ্রহণ করতাম। আমার এ পর্যায়ে মনে পড়ছে-এক একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম, ‘যে সূর্য প্রতিদিন ওঠে না’। এটা পড়েছিলাম সম্ভবত ঊষশীর প্রোগ্রামে। এটা হয়েছিল ভিক্টোরিয়া কলেজ শহিদ মিনারে, রানীর দিঘীর পাড়। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল, সকালবেলা প্রভাতফেরির পর।

ঘুংঘুর : আপনার লেখালেখির বিকাশের গল্পটা শুনতে চাই।
কচি :  কুমিল্লায় যখন লিখতাম, তখন থেকেই আমার বিকাশটা শুরু। সেটি একটু প্রস্ফুটিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে যখন আমি অধ্যয়ন করি। তখন আবার  দেশজুড়ে আন্দোলনের জোয়ার। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন। আমরা সবসময়ই দেখেছি, আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে; আন্দোলন সংগ্রামের সময়ে কবিতা, বিশেষ করে তখন রাজনৈতিক কবিতার একটা বলিষ্ঠ প্রভাব থাকে। তখন বেশ কিছু রাজনৈতিক কবিতা আমি লিখেছি। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময়ে। এর বাইরেও কবিতা লিখেছি, প্রেমের কবিতা, মানবতাবাদী কবিতা ইত্যাদি।

ঘুংঘুর : চট্টগ্রামে আপনি যাদের সাহচর্য পেয়েছিলেন?
কচি : ওখানে ছিল চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক কবি ময়ূখ চৌধুরী। উনি আমার শিক্ষক ছিলেন। উনার লেখার প্রতি আমার একটা ভালোবাসা ছিল, শ্রদ্ধা ছিল। আমার লেখাও সম্ভবত তিনি পছন্দই করতেন। আবার ছিল মহীবুল আজিজ, গল্পকার। আমরা একসাথেই সাহিত্য চর্চা করেছি। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিল শাহিদ আনোয়ার। খুব নিবেদিত প্রাণ ছিলেন কবিতার জন্য। উমর কায়সার, খালিদ আহসান প্রমুখের সাহচর্য পেয়েছি।

ঘুংঘুর : আপনার দৃষ্টিতে কবিতা কী?
কচি : দৈনন্দিন জীবন যাপনের মধ্য দিয়ে আমাদের যে মুহূর্তগুলো, প্রতিটা মুহূর্তই কবিতা। কিছু মুহূর্ত আমাদেরকে আক্রান্ত করে। অনেক সময় সে আক্রান্ত হওয়াটা বেদনার হতে পারে, আবার আনন্দেরও হতে পারে অথবা বেদনাটাই আনন্দ হতে পারে। ওটার যে প্রকাশ-সেটাই কবিতা। একটা আবেগ, একটা ব্যাকগ্রাউন্ড কাজ করবে। কাব্য শিল্পটা শিল্প হয়ে আসবে তখনই যখন এর ভেতরে কিছু ভাষা, কিছু গল্প, কিছু কথা, কিছু বক্তব্য থাকবে।

ঘুংঘুর : কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখা এবং স্বপ্নপূরণ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
কচি : স্বপ্নতো মানুষ দেখেই। যে বয়সে মানুষ স্বপ্ন দেখে, তখনই আমি এরকম স্বপ্ন দেখেছি। আর স্বপ্ন পূরণ শতভাগ না হলেও কাছাকাছি তো হয়। 

ঘুংঘুর : কুমিল্লায় যাদের লেখা আপনার ভালো লাগে ?
কচি : সৈয়দ আহমাদ তারেক সাহেবের লেখা পড়ি। উনি ভালো লেখেন। কুমিল্লার নিরীখে বললেও মরহুম শান্তনু কায়সারকে সবাই জাতীয়ভাবেই দেখতেন। উনাকে আমি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। তিনি কবিতা লিখতেন না, তিনি ছিলেন সমালোচক। তবে তিনি কবিতা বুঝতেন। ইসহাক সিদ্দিকী এক সময় ছিল, আজকাল অবশ্য লিখছেন না। আলী হোসেন চৌধুরী নিয়মিত লিখেন না, মাঝে মাঝে লেখেন ভালোই লাগে। আরও অনেকেই আছেন, মাঝে মাঝে দেখা যায় তবে ওই রকম সৈয়দ আহমাদ তারেকের নাম যেমন বলার সেভাবে বলার মতো দ্বিতীয় নাম আমি খুঁজে পাচ্ছি না। 

ঘুংঘুর : নতুনদের কী ধরনের সংকট আপনার চোখে পড়ছে?                                                                                                                                        কচি : নতুনদেরকে ভাষাগত দক্ষতা আরও বৃদ্ধি করতে হবে। এর জন্য ব্যাপক পাঠের বিকল্প নাই। 

ঘুংঘুর : কবিতার দর্শন বা আদর্শ-এরকম কোনো শব্দ কী আমরা ভাবতে পারি?                                                                                                              কচি : নিশ্চয়ই। সৎ সাহিত্য হতে হবে। এটা এক ধরনের সমাজসেবা বলতে পারেন। সমাজকে আপনি শুদ্ধ করছেন। আপনার কবিতায় একটা শুদ্ধাচার থাকবে। সেখানে আপনার দর্শন কাজ করবে। এবং এর থেকে একটা পজিটিভ রেজাল্ট বের হয়ে আসতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে যে কবিতাগুলো আছে সেখানে ঐভাবেই। হয়তো কতোটা পারছে সেটা নিয়ে তো বিতর্ক থাকবেই। কিন্তু সেভাবেই তো। কারণ এটা কোমলমতি শিশুরা পড়বে। তরুণরা পড়বে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবারাও পড়বে। এর আলোকে এদের ক্যারিয়ার গঠন করবে। সবকিছু মিলিয়ে সেখানে একটি নির্দেশনা থাকে। একটা সততার ব্যাপার থাকবে। পাঠ্যপুস্তক সেটি কতটুকু দিতে পারে সেটি তো ভিন্ন ব্যাপার। তবে এই সততার বার্তাটুকু দিতে তো হবে। সৎ সাহিত্য যদি পাঠ্য না হয় তাহলে তো একটি জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে, তাই না?

ঘুংঘুর : সাহিত্যে ফলপ্রাপ্তির বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?                                                                                                                                      কচি : আপনি যখন সাহিত্য চর্চা করবেন, যতক্ষণ আপনি সাহিত্য চর্চা করবেন ততক্ষণ আপনি ফলপ্রাপ্তির চিন্তা করবেন না। আপনার ফলপ্রাপ্তি সেটাও হতে পারে যে, আপনি একটি ভালো কবিতা লিখলেন। ভালো কবিতা লেখার একটি আনন্দ আছে। সেটিই মূলত আপনার ফলপ্রাপ্তি। বাকি যেটা যেমন পদক, পুরস্কার, খ্যাতি সেটি আশা করে আপনি সাহিত্য চর্চা করলে আমার মনে হয় না মহৎ সাহিত্য আপনি রচনা করতে পারবেন। আপনার ভেতরে যে তাড়নাটা কাজ করলো সেটি ভেতরে না থেকে যে লেখার মাধ্যমে বেরিয়ে আসলো, সেটিই আপনার ফল। আমি একজন ভালো লেখক, একজন প্রথম সারির লেখক হয়ে যাব এরকম চিন্তা থেকে আপনার সাহিত্য সৃষ্টি হবে না। আপনার তাড়নাটা প্রকাশ করলেন সেটিই আপনার অনেক। লেখাটা শেষ হয়ে গেল-ব্যাস, আমার লেখা হয়েছে-এটিই আনন্দ।  

menu
menu