সরল কথায় করোনা ভাইরাস

কিছুদিন আগেও পৃথিবী অনেক ব্যস্ত ছিল। গাড়ির চাকা আর শিল্পকারখানার মোটর যেন পৃথিবীর গতির সাথে পাল্লা দিয়ে চলত। ব্যস্ত নগরীগুলো আজ সাহারা মরুভূমির মতো শান্ত। পৃথিবীটা নিজেও যেন থেমে যেতে চাইছে। না, বিশাল কোনো এস্টেরয়েড, ভূমিকম্প, সুনামি কিংবা সৌরঝরের কোনো ভগ্ন অংশ এসে পৃথিবীকে আঘাত করেনি। মাত্র ৯০ ন্যানোমিটারের একটা ভাইরাসের কারণে আমাদের গ্রহের এই স্থবিরতা। covid-19 কে WHO মহামারী (pandemic) ঘোষণা করেছে। 

করোনা ভাইরাস হচ্ছে একগুচ্ছ ভাইরাস যা প্রাণিদেহে, পাখি এবং মানুষের মাঝে রোগ সৃষ্টি করে। করোনা ভাইরাস প্রাণিদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া ও পাখির ক্ষেত্রে শ্বাসতন্ত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে। মানুষের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সর্দিজ্বর থেকে শুরে করে SARS, MERS ও COVID-19 এর মতো রোগ সৃষ্টি করে। ১৯৩০ সালে গৃহপালিত মুরগির বাচ্চা থেকে প্রথম করোনা সনাক্ত হয়। পরে ১৯৪০ সালে দুটি ভিন্ন প্রাণিতে MHV ও TGEV নামক করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়। তবে প্রথম মানুষের শরীরে করোনার অস্তিত্ব পাওয়া যায় ১৯৬২ সালে। COVID-19 সনাক্ত হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে। সেখান থেকে ভাইরাসটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পরে। 

করোনা শব্দের অর্থ হচ্ছে ফুলের মালা। ভাইরাসটি দেখতে অনেকটা ফুলের মালা বা মুকুটের মতো। করোনা শব্দের উৎপত্তি হয় ল্যাটিন corona থেকে। সূর্যের করোনার সাথেও এই নামের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। মূলত এই ভাইরাসের আবরণটি তৈরি হয় প্রোটিনের মাধ্যমে। 

ভাইরাসটির নামকরণ থেকে এর গঠন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এটি দেখতে অনেকটা গোলাকার। তবে এটি বহুরূপ ধারণ করতে পারে। রাসায়নিকভাবে এটি নিউক্ললিও প্রোটিন সম্পর্কিত positive-sense RNA ভাইরাস। ভাইরাসটির বহিরাবণ গ্লাইকোপ্রোটিন সমন্বয়ে গঠিত যার সাহায্যে এটি প্রাণিদেহের কোষের সাথে আটকে থাকতে সাহায্য করে। 

প্রাথমিকভাবে সাধারণ সর্দি-কাশির মতোই মনে হয়। এই ভাইরাস মানুষের শ্বসনতন্ত্রে আক্রান্ত করে। COVID-19 এর লক্ষণসমূহ হলো :
o  জ্বর
o  সর্দি
o  গলাব্যথা
o  দ্রুত নিঃশ্বাস
o  নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া
o  বুকে ব্যথা বা চাপ লেগে থাকা
o  পেট ব্যথা
o  ডায়রিয়া
o  নীলাভ ঠোঁট বা মুখমণ্ডল
o  মাথাব্যথা ইত্যাদি

যদি কোনো লোক মনে করে তার করোনা আক্রান্ত হয়েছে, তাহলে তাকে CDC অথবা নিকটস্থ হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে। যে পদ্ধতির সাহায্যে রোগ নির্ণয় করা :

  SWAB test -এই পদ্ধতির সাহায্যে বিশেষ তুলার সাহায্যে নাক বা গলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। 
  Nasal Aspirate- এই পদ্ধতির সাহায্যে বিশেষ এক ধরনের রাসায়নিক নাকে প্রবেশ করানো হয় এবং পরে পাম্প করে তা সংগ্রহ করা হয়। 
  Tracheal aspirate- এটি একটি বিশেষ পদ্ধতি। এখানে একটি চিকন টিউবের মাথায় একটি টর্চ লাগানো থাকে। এই পদ্ধতির নাম হল ব্রঙ্কোস্কোপ। টিউবটিকে মুখ দিয়ে প্রবেশ করিয়ে ফুসফুস থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। 
  Sputum Test- sputum হচ্ছে ফুসফুস থেকে কফের সাথে বের হওয়া এক ধরনের পদার্থ। এই প্রক্রিয়ার কাশির সাথে আসা কফকে ননুনা হিসাবে সংগ্রহ করা হয়।
 Blood test- এই প্রক্রিয়া হাতের শিরা থেকে রক্ত সংগ্রহ করা হয়। 

এই রোগের এখনো কোনো প্রতিকার আবিষ্কার হয়নি। তবে এই রোগ মানে নির্ঘাত মৃত্যু নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা এমনি এমনি ভালো হয়ে যায়। তবে যাদের আগে থেকে নানান জটিলতা রয়েছে তাদের জন্য ঝুঁকিটা একটু বেশি। 

  আগেই থেকেই যাদের বিভিন্ন রোগ রয়েছে
  যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম
  বয়ষ্ক মানুষের ক্ষেত্রে

যেহেতু এই রোগের কোনো প্রতিষেধক নেই তাই সাবধানতা হলো এই রোগের প্রকৃত চিকিৎসা। যে সাবধানতা অবলম্বন করলে এই রোগ থেকে বাঁচা যাবে

  প্রতিনিয়ত খাবার আগে ভালো করে খাত ধুতে হবে।
  হাত দিয়ে কখনো মুখ, নাক ও চোখ স্পর্শ করা যাবে না। কারণ দেহের বেশির ভাগ জীবাণু প্রবেশ করে এই তিনটি অংশ দিয়ে।
  বাহির থেকে আসাব পর ঘরে ঢুকেই ভালো করে হাত ধুতে হবে। 
  কারও সাথে কোলাকুলি, করমর্দন কিংবা কোনো স্পর্শ করে কুশল বিনিময় করা যাবে না। 
  দুই থেকে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলতে হবে। 
  হাঁচি, কাশি বা জোরে হাসার সময় মুখে হাত বা রুমাল দিতে হবে। 
  যেখানে সেখানে থু থু ফেলার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।
  যতটা সম্ভব একসাথে অনেক লোকের সমাগম ত্যাগ করতে হবে। তাই প্রার্থনা ও অন্যান্য কাজ ঘরে বসে করাই উত্তম। জীবন বাঁচানোর জন্য ইবাদত ঘরে বসে করাই উত্তম। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় গোঁড়ামি ত্যাগ করতে হবে। 
  মুখ ও নাক মাস্ক দ্বারা ঢেকে রাখতে হবে। তবে সকল মাস্ক করোনা ঠেকাতে পারেন। বিশেষ মাস্ককে বলে N95।

০৪ এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হলো ১১২,৯৭৩ জন। যেখানে মৃত্যু বরণ করেছে ৫৯,৪০৩ জন। তবে আশার বাণী হলো মোট ২৩০,৩১৬ জন লোক সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। বর্তমান আক্রান্তের শতকরা ৯৫ জন বা ৭৯২,৮১০ জন মৃদু পর্যায়ে অসুস্থ আছে। বাকি শতকরা ৫ জন বা ৩৯,৪৪৪ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সবাইকে ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন ২৭৭,৫৫২ জন লোক নিয়ে করোনা আক্রান্তের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই মারা গেছে ৭৪০৩ জন। তবে মৃত্যুর দিক থেকে ১৪,৬৮১ জন নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আছে ইতালি। এদিকে স্পেনে মৃত্যুবরণ করেছে ১১,১৯৮ জন। এ যেন সূচকীয় হারে মৃত্যুর মিছিল। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাওয়া করোনা আক্রান্ত লোকের সংখ্যা ৭০ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছে ৮ জন। কবে শেষ হবে এই মিছিল তা আমাদের অজানা। 

এই রকম বেশি দিন চলতে থাকলে মৃত্যুর পাশাপাশি বেড়ে যাবে খাদ্যের অভাব। এখন থেকেই আমাদের সাবধান হতে হবে। লকডাউন মেনে চলতে হবে। সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তির পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। দরিদ্র লোকসহ যাদের খাবারের প্রয়োজন তাদেরকে খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। সবাইকে সরকারি নিয়ম ও নির্দেশন মেনে চলতে হবে। 

কিছু সত্য ঘটনা

  ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উপরে অথবা রোদ্রে দাঁড়িয়ে থাকলে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। 
  ১০ সেকেন্ডের বেশি সময় ধরে নিঃশ্বাস ধরে রাখা বা কোনো কাশি বা ব্যথা অনুভূত হওয়া মানে এই নয় যে আপনি COVID-19 থেকে মুক্ত। 
  গরম ও আর্দ্র পরিবেশেও করোনা ছড়াতে পারে।
  শীতল আবহাওয়া ও বরফ করোনা ভাইরাস মারতে পারে না।
  এলকোহল সেবন করলে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না।
  গরম পানিতে গোসল করলে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না।
  করোনা ভাইরাস মশার মাধ্যমে ছড়াতে পারে না।
  Hand dryer করোনা ভাইরাস মারতে সক্ষম নয়। 
  আলট্রাভায়োলেট লাইট দ্বারা করোনা মারতে গেলে তাতে চামড়ার ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। 
  থার্মাল স্ক্যানার দ্বারা কেবল শরীরের তাপমাত্রা পরীক্ষা করা যায় কিন্তু করোনা আক্রান্ত কিনা তা নির্ণয় করতে পারে না। 
  করোনা আক্রান্ত রোগীকে এলকোহল বা ক্লোরিন স্প্রে করলে করোনা থেকে মুক্তি পাবে না। 
  নিউমোনিয়ার ঔষধ করোনা ভাইরাসে কার্যকর নয়। 
   লবণাক্ত পানিদ্বারা নাক ধৌত করলে এই রোগ থেকে বাঁচা যায় না। 
   রসুন খেলে করোনা থেকে বাঁচার কোণো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
   সকল বয়সের মানুষ করোনা দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। 
   এন্টিবায়োটিক করোনায় আক্রান্তে রোগীর জন্য কার্যকর নয়। 
   করোনা ভাইরাস থেকে সম্পূর্ণ আরোগ্য হওয়া যায়। সারা জীবন করোনা ভাইরাস শরীরে থাকে না। 

এন্টিবায়োটিক শুধুমাত্র ব্যাক্টেরিয়ায় কার্যকর তাই করোনা মোকাবেলায় একমাত্র ভ্যাকসিন হতে পারে কার্যকর ঔষধ। বিজ্ঞানীরা নতুন ঔষধ বা ভ্যাকসিনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। হয়তো নতুন কোনো আবিষ্কার এই মহামারীকে পানি করে দিতে পারে। কিন্তু কবে? জানি না। এখন ঔষুধের জন্য অপেক্ষা আর নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। 

menu
menu