অমৃতের দিকে

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ও দুর্দান্ত চীনা শিল্পী, আই ওয়েই ওয়েই তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, being an artist is more about a lifestyle and attitude than producing some product–a way of looking at things.

আজ আমাদের বরেণ্য লেখক সৈয়দ শামসুল হক সম্পর্কে লিখতে বসে প্রথমেই মনে পড়ল কথাটি।

আমি দেখতে পাচ্ছি শিল্পীত জীবনধারা ও জীবনাচরণের এক অনন্য উদাহরণ আমার স্মৃতিতে বিচরণকারী আপাদমস্তক শিল্পী সৈয়দ শামসুল হককে। পরাণের গহীন ভেতর থেকে বিচ্ছুরিত হত যেন তাঁর শিল্পপ্রভার স্ফূলিঙ্গ। এমনকি আমার ধারণা, যখন তিনি লৌকিক শিল্পচর্চায় রত নন, তখনো।

তাঁর রচনাকালীন ভঙ্গিমা আমার কখনো দেখবার সুযোগ হয়নি। কিন্তু তাঁকে দেখেছি, তাঁর রচনা বা রচিত নাটক পড়তে—কী ভীষণ তীক্ষ্নতা আর শুদ্ধতার সঙ্গে। তিনি বসেছেন আমাদের মতো অতি সাধারণ থিয়েটার পাগল উটকো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এক কাতারে,  নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের রিহার্সাল রুমের পুরোনো কার্পেটের ওপর। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি তাঁর শব্দ-বাক্য-সংলাপ-কাহিনি। তাঁর কন্ঠে উচ্চারিত সংলাপ তীরের ফলার মতো বুকে এসে বিঁধছে। মনে পড়ে যায় ইনিড মহাকাব্যে পিতা এয়নিয়াসের বীরত্বগাঁথার বর্ণনা ভার্জিলের রচনায়। তাঁর রচনাশৈলীতেও আমি মহাকাব্যের ঘ্রাণ পাই।

আমি অতি ক্ষুদ্র মানুষ। একজন সৈয়দ হকের লেখা নিয়ে কিছু বলবার মতো মেধা ও যোগ্যতা আমার নেই। তবু মনে হয়, ‘আহা একটি মহাকাব্য যদি পেতাম তাঁর কাছ থেকে’। মহাকাব্যের সকল প্রকরণ ও উপকরণ তো তাঁর লেখায় আছে। উপলক্ষ কি কখনো তৈরি হয়নি, নাকি আমরা এই অমর কথাশিল্পীর জন্যে তেমন পরিবেশ বা সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করে দিতে পারিনি যা মহাকাব্য রচনার অনুকূল?

নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে আমার প্রথম মঞ্চঅভিনয় ছিল পথ নাটক ’ আমাদের জন্ম হল’। একুশের চেতনায় রচিত নাটকটিতে অভিনয় করেছিলাম ১৯৮৫ সালে। রচনা—সৈয়দ শামসুল হক। পরিচালনা—নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান। কী ভীষণ উৎসাহ আর ভীত হৃদয়ে হয়ে উঠতে চেয়েছিলাম নাট্যকারের সৃষ্ট চরিত্র। আমি নিশ্চিত—পারিনি। তবু নাটক শেষে তিনি চমৎকার হেসে বলেছিলেন, ‘ভালো করেছিস’। তাঁর চশমার আড়ালে দু’চোখে এক অপূর্ব দ্যুতি দেখতে পেয়েছিলাম। এ দ্যুতি তাঁর অন্তরের অসামান্য শিল্পমননের, যা সৃষ্টি করেছে অনর্গল ধারালো অন্তর্ভেদী শব্দমালার ভাস্কর্য। বাংলাভাষা যেন তাঁর কলমের চলমানতায়—স্রোতস্বিনী বেনুমতী, কখনো নির্ঝরিণী অথবা উত্তাল তরঙ্গ¯্রােত। তাঁর কণ্ঠে উচ্চারিত বাংলা শব্দাবলী যেন সজীব হয়ে নূতনতর রূপ পেত। আমি লক্ষ্য করেছি, বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে হাস্যরসাত্মক কোন বিষয়ে যখন তিনি মেতে উঠেছেন, তখনো প্রতিটি বাংলা শব্দ তাঁর ঠোঁটে সর্বোচ্চ প্রমিত ও শুদ্ধতম। পরিশীলিত শব্দচয়ন। যেন হাজার বছর ধরে তিনি বাংলাভাষার অগ্নিশিখা বয়ে চলেছেন, বিন¤্রচিত্তে তাঁর উত্তরসূরিদের কাছে পৌঁছে দেবেন বলে। কি এক অমোঘ নির্দেশে যেন তিনি বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়ে গেছেন তাঁর স্বর্ণলেখনীগুচ্ছ।

তবু আক্ষেপ হয়—সৈয়দ শামসুল হকের মহাকাব্য পেলাম না কেন আমরা? তাঁর যোগ্য মর্যাদা এ জাতি দিতে পেরেছিল কি তাঁর জীবদ্দশায়? মহাকাব্যের আভাস তো তাঁর বহু রচনায়। কি অবলীলায় বিশাল সব দৃশ্যপটের অবতারণা। বিশাল ক্যানভাসে মহানায়কসম চরিত্রাবলী। কাব্য কারুকার্যে দখলদারিত্ব আকাশচুম্বী।

আমি মনে মনে আজ তাঁকে জিজ্ঞেস করি,

—কেন লেখেননি আপনি মহাকাব্য? 

—শীঘ্রই লিখব বুঝলি। আমাদের দেশ বিভাগ থেকে শুরু করে ভাষা  আন্দোলন থেকে একাত্তর নিয়ে এক মহাকাব্য। কাব্য গাঁথুনির ছক কাটা হয়ে গেছে। শুরু করে দেব। 

—কিভাবে লিখবেন? আপনার কাছে কাগজ-কলম আছে? প্রিয় টেবিল-
 চেয়ার ?

—আমি এখন মনে মনে লিখি বুঝলি। এ বড় আনন্দময় অভিজ্ঞতা। কত শত লেখা লিখে ফেলেছি এ’কদিনে জানিস? 

—কী করে জানব? আপনার কোনো লেখাই তো আর আমাদের পড়বার উপায় নেই। 

—সত্যি করে বল্ তো, যে লেখাগুলো তোদের জন্যে রেখে এসেছি, সেগুলো ক’জন পড়ে? ক’জন আমার নাটক থিয়েটারে গিয়ে দেখে?

—অনেক অনেক মানুষ। বাংলাদেশ ভর্তি মানুষ। তারা আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে।

—হা হা হা

—হাসছেন ?

—কেন মিথ্যে বলছিস্? এদেশের মানুষ এখন আর বই পড়ে না। আমি কী
 লিখে এসেছি, তাতে কার কী এসে যায় ?

—আমি বই পড়ি। আমি আপনার মহাকাব্য পড়ার আশায় রইলাম। আপনার নতুন লেখাগুলোও আমি পড়তে চাই।

—এতো লেখা কি করে পড়বি? আমি তো অনন্তকাল ধরে লিখে চলব। আমার জন্ম হয়েছিল লিখব বলে, আমার অনন্ত যাত্রাও লিখব বলে।

আমি আর কথা বাড়াই না। তিনি লেখক। আষ্টে-পৃষ্ঠে তাঁকে জড়িয়ে রেখেছে নিত্যনতুন ভাবনা আর বোধ। তিনি শুধুই লিখবেন। তিনি নিজেই তাঁর নিয়তির নিয়ন্তা। মাথায় তাঁর লেখনীর রাজমুকুট। তাই হয়তো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শেক্সপিয়ারকে। বাংলা অনুবাদে শেক্সপিয়ারের স্বকীয়তার সম্পূর্ণ প্রকাশ আর  কোন বাঙালি লেখক কি করতে পেরেছেন?

শুনেছি, লন্ডনে তাঁর ক্যান্সার চিকিৎসার সময়ও হাসপাতালের শয্যায় তিনি নির্মলচিত্তে অনুবাদ করেছিলেন শেক্সপিয়রের হ্যামলেট।

হ্যামলেট

এত বিষণ্নতা তুমি কোথায় দেখছ, মা আমার?
এই কালো জামা, শোকের এই আলখাল্লা, বুক ঠেলে
দীর্ঘশ্বাস, চোখ ঠেলে চোখের জলের ধারা, কষ্টে
ভেঙে যাওয়া মুখ, আর যা যা তারপর হতে পারে— 
সব, দুঃখের যাবৎ ভঙ্গি, ইশারা, চাহনি, ভাব,
এইসব দিয়ে বোঝা যাবে না আমাকে। এসব তো
সামান্য অভিনেতাও ফুটিয়ে তুলতে পারে কত
সহজে!  আসলে এসবের ঊর্ধ্বে আমার ভেতরে
এমন এক অনুভব চলছে যা, এই কালো জামা
ভেদ করে সাধারণ চোখ দিয়ে দেখাই যাবে না।

অনুবাদটি পড়তে পড়তে বার বারই মনে হয় পৃথিবী থেকে নির্বাসনের পথে হ্যামলেট যেন তাঁর এক অপূর্ব দোসর। অবলীলায় সে বহন করেছিল লেখকের মৃত্যু-মনোভার। যা সত্যিই তাঁর ‘জামা ভেদ করে সাধারণ চোখ দিয়ে দেখা যাবে না’

কিন্তু সৈয়দ হকের চোখ সাধারণ নয়। আমরা যা দেখি, তিনি তা দেখেছেন, কিন্তু তিনি যা দেখেছেন তাঁর গভীরতর দৃষ্টি ও মনন দিয়ে, আমরা তা দেখতে পাই না। এমনকি তাঁর আত্মজীবনী ‘প্রণীত জীবন’ও যেন কোন তৃতীয় চোখের তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণ।

তাঁর ছবি ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম তিনি পাখির চোখে বা চোখের সমান্তরালে পৃথিবীকে দেখেননি। তাঁর চাউনি সর্বদা ঊর্ধ্বমুখী। যেখানে সবাই শূন্যতায় বাঁধা পায়, সৈয়দ হকের মতো লেখক হয়তো খুঁজে পেয়েছিলেন অসীম সব জগতের সন্ধান। অথবা সেই শূন্যতায় তিনি নিজেই নিঃশব্দে সৃষ্টি করে চলেছিলেন শব্দের কারুকাজে নতুন পৃথিবী। যে অভিনেতা তাঁর শব্দের কারুকাজের বাহক হয়েছে কোনকালে, জীবদ্দশায় সে সেসব সংলাপ বিস্মৃত হবে না। আমি বহু টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছি। কিন্তু কেউ সংলাপ আওড়াতে বললে তাঁর লেখা মঞ্চ নাটকের সংলাপই ঠোঁটে চেপে বসে। নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে নাট্যজন আলী যাকেরের পরিচালনায় সৈয়দ হকের লেখা ‘খাট্টা তামাশা’ নাটকে আমি ‘সোনা’ এবং প্রয়োজনে ‘রুপা’ দুটি চরিত্রে অভিনয় করতাম। প্রায় একুশ বছর আগের কথা। তবু মনে পড়ে যায় সংলাপ—আমি আন্দোলিত হই। অনুপ্রাণিত হই। 

‘আসিবে, আসিবে ছাত্র।
 বিদ্যাশিক্ষা করি তারা বড় হইবে।
 ব্রিটিশের হাত হতি উদ্ধার করিবে দ্যাশ।
 জননী যে দ্যাশ।
 জননীর জিঞ্জির কাটিবে তারা। 
 আবার সোনার দ্যাশ, সন্তানের রাজ্যপাট আবার হইবে।’ 

এই নাটকটিতে অভিনয়ের পাশাপাশি জীবনের প্রথম মঞ্চপরিকল্পনা ছিল আমার। প্রথম দর্শকসারিতে বসে সস্ত্রীক নিজের নাটক দেখতেন। যেন তিনি কেবলই সাধারণ দর্শক, নাটকের পুরোটা রস আস্বাদন করছেন। তাঁর রচিত নাটকগুলির মহড়াতেও প্রায়ই তিনি নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমাদের অভিনয় পর্যবেক্ষণ করতেন। কিন্তু পরিচালকের ওপর কোনদিন একটি শব্দ দিয়ে কর্তৃত্ব করতে দেখিনি। বা কোনো অভিনেতাকে বলেননি, ‘এভাবে নয়, ওভাবে বল’। এই তো প্রকৃত শিল্পীর জীবনাচরণ। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ। আমার মতো ক্ষুদ্র এক মঞ্চকর্মীকেও বলেছেন , ‘চমৎকার করেছিস মঞ্চটি’।

তবু আমি অভিমান করি, ‘কেন মহাকাব্য লিখলেন না?’ তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল এক নৈশভোজে। একটু নিষ্প্রভ ছিলেন। চিরাচরিত মৃদু হাসিটি স্তিমিত ছিল। সোফায় বসেছিলেন নিভৃতে। আমি কাছে গিয়ে বললাম

—কেমন আছেন আংকেল? 

—আরে তুই? খুব ছবি আঁকছিস, না?

কেমন যেন গুটোনো লাগল আমাদের সব্যসাচী লেখককে। হয়তো তখন তাঁর অসুখের প্রাথমিক ধারণাটি তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর প্রয়াত হবার সংবাদে, বিষন্নতায়, বহুবছর পূর্বে লেখা তাঁর সংলাপই বারবার নিজেকে শোনালাম। 

‘জন্মিলে মরিতে হয়, কোন কালে এই সত্য মিছা হয়?’

কিন্তু তাঁর প্রস্থানের ক’মাস পর হ্যামলেট প্রকাশিত হলে পেয়েছি তাঁর শেষ বার্তা—হ্যামলেটের শেষ দৃশ্যে, হ্যামলেটের পিতার প্রেতাত্মার সংলাপে। সেখানে শেক্সপিয়র এবং সৈয়দ শামসুল হক একাকার। 


হ্যামলেটের পিতার প্রেতাত্মা—

হ্যামলেট! আমার হ্যামলেট! কলুষিত এ পৃথিবী থেকে 
এখন তুমি দিব্যলোকযাত্রী। এসো, বৎস!
আমি তৃপ্ত। পিতৃহত্যার দণ্ডদান করেছে পুত্র।
রইল এ সন্ত্রাসের বিশ্বে আজ দ্বিতীয় যুদ্ধটা— 
নতুন প্রজন্ম সেটি গ্রহণ করুক। তারা আসুক
নিরাশা থেকে আলোয়—বিষ থেকে অমৃতের দিকে। 
এসো, পুত্র, এসো বৎস, এসো ॥ 

সৈয়দ শামসুল হক তাঁর শেষ লেখা শব্দটি পর্যন্ত নিশ্চিত প্রমাণ করে গেছেন, তাঁর রচনা দেশ-কালের সীমাতীত। কালজয়ী।

menu
menu