চন্দন আনোয়ারের গল্পে নিঃসঙ্গচেতনা
বিশ্বসাহিত্যে গল্পের ইতিহাস অনেক পুরোনো। সেই তুলনায় বাংলাসাহিত্যে শিল্পমানসম্পন্ন গল্পের সূচনা হয় আধুনিক যুগে। বাংলাসাহিত্যে ছোটগল্পের যাত্রা ঠিক ছোটগল্পের আঙ্গিকে হয়নি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসধর্মী কিছু লেখায় [যুগলাঙ্গুরীয় (১৮৭৪), রাধারাণী (১৮৮৬)] ছোটগল্পের লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়। তারপর গল্পগোত্রের লেখা হিসেবে চিহ্নিত হয় পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মধুমতি’। ‘মধুমতি’ কথাদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১২৮০ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। তারপর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বর্নকুমারী দেবী, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রমুখ কথাশিল্পীর হাতে ছোটগল্পের প্রাথমিক ভিত্তি নির্মিত হয়। মূলত রবীন্দ্রযুগেই বাংলা গল্প আলাদা পরিচয়ে শিল্পযাত্রা শুরু করে। রবীন্দ্রনাথই প্রথম গল্প ও উপন্যাসের মধ্যে একটি ভেদরেখা টানেন। এর ফলেই গল্প ও উপন্যাস আলাদা আঙ্গিক লাভ করে।
ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক ঘাত-প্রতিঘাত, আত্মনির্মাণ, আত্মবিসর্জন, সামাজিক সংকট ও সামাজিক শাসনে ব্যক্তিস্বাধীনতার বিনষ্টি এবং এর ফলে মানবাচরণের সামূহিক পরিবর্তন বাংলা গল্পের জগতকে করে তোলে বহুবর্ণিল। বাংলা গল্প ক্রমশ জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। জীবনের জটিলতা, মনোজাগতিক দ্বন্দ্ব, প্রথাবিরোধী মনোভাব, ব্যক্তি ও সমাজের বিরুদ্ধ অবস্থানজনিত সংকট রবীন্দ্রযুগে শুরু হলেও রবীন্দ্রপরবর্তী গল্পেও এই সংকট এসেছে প্রবলভাবে।
রবীন্দ্র পরবর্তীকালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ, সুবোধ ঘোষ, কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার, দীপেন্দ্রনাথ প্রমুখ ছোটগল্পকার গল্পের জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন। কথাসাহিত্যে গল্পের পাশাপাশি দাপটের সাথে এগিয়েছে উপন্যাস। প্রথম পর্যায়ের অনেক গল্পই ছিল উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত। পরবর্তী সময়ে গল্প ও উপন্যাসের পার্থক্য স্পষ্ট হলে উপন্যাসের জনপ্রিয়তা হেতু অনেক গল্পকার উপন্যাস লিখতে শুরু করেছেন এবং উপন্যাস লিখেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তাই অনেক গল্পকার পাঠকমহলে ঔপন্যাসিক হিসেবেই অধিক পরিচিতি লাভ করেছেন।
যাহোক, বাংলাসাহিত্যের আধুনিক আঙ্গিক হিসেবে ছোটগল্পের অগ্রযাত্রাও ঈর্ষনীয়। স্বল্পায়তন ও আখ্যানভাগ ব্যাপক-বিচিত্র না হওয়ার কারণে ছোটগল্প পাঠককে হয়রান করে তোলে না। উপন্যাসের কিছুটা স্বাদও লাভ করতে পারেন পাঠক। গল্প ও উপন্যাসের একই নির্মাণশৈলী, একই ভাষাকাঠামো। পার্থক্য হলো একটি ক্ষুদ্রায়তন ও অপরটি বৃহদায়তন বিশিষ্ট। গল্প যেখানে পুত্তলিকা, উপন্যাস সেখানে প্রতিমা। যাহোক গল্পের স্বরূপ নিয়ে কথা বলেছেন অনেক সাহিত্যবিশ্লেষক। রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা’র পরও ছোটগল্প নিয়ে নানা নিরীক্ষা হয়েছে। এসব নিরীক্ষা ছোটগল্পের শরীরে নতুন পালক যুক্ত করলেও ছোটগল্পের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ফলে ছোটগল্প হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের একটি প্রধান অংশ। ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য বা স্বভাবধর্ম বিষয়ে সৈয়দ আজিজুল হক তাঁর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প : সমাজচেতনা ও জীবনের রূপায়ণ শীর্ষক গবেষণাগ্রন্থে বলেন :
বিপুল রাষ্ট্রীয়-সামাজিক সংঘাত কিংবা ব্যক্তিজীবনের অতৃপ্তিজনিত যন্ত্রণা তথা আধুনিকতম জীবনভাবনার ফসল এই ছোটগল্পকে জীবনের বিশ্ব রূপদর্শনের খণ্ড দর্পণও বলা যায়। প্রতীতির সমগ্রতা বা ঐক্যসাধন একক জীবনখণ্ড অবলম্বনে ভাবের একমুখিতা ও সকল উৎকণ্ঠাকে ধারণকারী একটি চরমক্ষণ বা শীর্ষমুহূর্তের অবতারণা, স্বল্পতম ব্যাপ্তির মধ্যে বৃহত্তম সত্যের প্রতিবিম্বন প্রভৃতি ছোটগল্প সৃষ্টির অনিবার্য উপাদান। অপ্রয়োজনীয় বর্ণনাবিলাস পরিহার, দৃঢ়-সংবদ্ধ ভাবের সংহতি, নিদিষ্ট-নিয়ন্ত্রিত ব্যঞ্জনাধর্মী পরিণতি এবং সংকেতপুষ্ট ইঙ্গিতগর্ভ ভাষা- এগুলোই একটি সার্থক ছোটগল্পের জন্য আবশ্যকীয় শর্ত। খণ্ডিত জীবনের সীমায় অখণ্ড জীবনের দ্যোতনাসৃষ্টি, কিংবা বলা যায়, একটিমাত্র কাহিনী, বোধ বা আবেগের বৃন্তমূলে শিল্পীর জীবনানুভবের গভীরতাকে পরিস্ফূটিত করে তোলাই ছোটগল্পের স্বভাবধর্ম।
ছোটগল্পের এই স্বভাবধর্মই ছোটগল্পকে ক্রমশ জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলছে। যাপিত জীবনের অসঙ্গতি, সংকট, স্ববিরোধিতা ব্যক্তির স্বভাবধর্মকে বদলে দেয়। ফলে ব্যক্তিসম্পর্কের অবক্ষয় ঘটে। এই অবক্ষয় থেকেই একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরে ব্যক্তিজীবনকে। প্রবলভাবে জীবনঘনিষ্ঠ শিল্পমাধ্যম হিসেবে ছোটগল্পে ব্যক্তিজীবনের এই সংকটগুলোকেই তুলে আনেন একজন গল্পকার। একজন গল্পকার ব্যক্তিসংকটকে নিরীক্ষণ করেন নির্মোহভাবে; সমাজকে নিরীক্ষণ করেন সামগ্রিকভাবে; চলমান সময়কে নিরীক্ষণ করেন অতীত ও ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। গল্পকার তাঁর নিরীক্ষিত বিষয়ের শিল্পিত প্রকাশ ঘটান গল্পে। তাই আধুনিক গল্প মূলত সামগ্রিক জীবন ও জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলির নির্মোহ নিরীক্ষা। বর্তমান প্রসঙ্গ আলোচনার পূর্বে বাংলা ছোটগল্পের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে ছোটগল্পের গতি-প্রকৃতি তুলে ধরা প্রয়োজন।
ছোটগল্পের প্রথম বাঁকবদল বা গতিপথের পরিবর্তন ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ছোটগল্প ছিল প্রধানত চিত্তবিলাসী ও নান্দনিক। কল্পকাহিনি বা ফ্যান্টাসি ছিল তখনকার গল্পের মূল আকর্ষণ। গল্পের ভাব, ভাষা ও বিষয়বস্তুতে বড় ধরনের কোন পরিবর্তন ঘটেনি বলে সে সময়ের গল্প ছিল একমুখি। চিত্তসুখ বা আনন্দ লাভ করাই ছিল তখনকার গল্পপাঠকদের মূললক্ষ্য। গল্পলেখকগণ পাঠকের সে চাহিদাই পূরণ করতেন। সমাজবাস্তবতা ও জীবনের জটিলতা তখনও অতটা স্পর্শ করেনি গল্পের শরীর। তবে সময় সবকিছু বদলে দেয়। আর এই বদলে যাওয়াটাকেই গ্রহণ করেন একজন সময়সচেতন গল্পকার। সেটা করতে গিয়ে ধীরলয়ে পরিবর্তিত সমাজচিত্রও তুলে ধরেন অনেক গল্পকার। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকেই বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও সামাজিক প্রথাকে অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করার শক্তি অর্জন করে বাংলা ছোটগল্প। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮ খ্রি.) ও রুশ বিপ্লব (১৯১৭) বিশ্বের সাথে চিরায়ত ভারতীয় সমাজকেও প্রভাবিত করে। সমাজবদলের বৈশ্বিক ঢেউ ভারতীয় সমাজকেও নাড়িয়ে দেয়। বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন সংকট নিয়ে, ভিন্ন ভাব-ভাষা-বিষয়বস্তু নিয়ে বাংলা ছোটগল্প তার গতিপথ বদলায়। এই বদলে যাওয়া সমাজমানসের প্রতিনিধিত্ব করেন তিরিশ ও চল্লিশের একঝাঁক গল্পকার।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ব্রিটিশবিরোধী এই রাজনৈতিক আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে এক নতুন ধারার প্রতিবাদী সাহিত্যের উন্মেষ ঘটে। বিপ্লবীচেতনায় সমৃদ্ধ এই মানবতাবাদী সাহিত্য ব্যক্তিস্বাধীনতা ও জাতীয়মুক্তির কথা বলে। শ্রেণিবৈষম্য, শ্রেণিশোষণ, ব্যক্তিসংকট, সামাজিক ক্ষয়-অবক্ষয় ব্যক্তিচিন্তাকে করে তোলে বিক্ষুব্ধ। এই বিক্ষুব্ধ চেতনাই মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দেয় এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ত্বরান্বিত করে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির নানামাত্রিক সংকট, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, কুসংস্কার ও টিকে থাকার সংগ্রামকে উপজীব্য করে ছোটগল্প নির্মাণ করেছেন আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আবুল মনসুর আহমেদ, মাহবুব উল আলম, আবুল ফজল, আবু জাফর শামসুদ্দীন, সিকান্দার আবু জাফর, আবু রুশদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, শাহেদ আলী, সরদার জয়েনুদ্দীন, আবু ইসহাক প্রমুখ গল্পকার। মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, শোষণ-নির্যাতন, সামাজিক শোষণ, শিল্পায়নের প্রভাবে সামাজিক ভাঙন, যাপিত জীবনের বাঞ্চিত-অবাঞ্চিত পরিবর্তন, হতাশা-গ্লানি-অস্থিরতা ইত্যাদির চিত্রও উঠে আসে এই কালপর্বের গল্পে।
সাতচল্লিশের দেশভাগ ব্রিটিশভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি নির্মম ঘটনা। দেশভাগের ফলে দেশত্যাগ একটি মানবিক বিপর্যয়ের দলিল। সাতচল্লিশ পরবর্তী এই দিখণ্ডিত বাংলার বিকলাঙ্গতা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিকেও বিকল করে তোলে। বাংলাসাহিত্যের ইসলামিকরণ করার প্রচেষ্টা এপার বাংলার (পূর্ব পাকিস্তান) বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশকে থমকে দেয়। সেই জাতীয় সংকট থেকে জন্ম নেয় এক ভিন্ন সমাজমানস। এপার বাংলা ও ওপার বাংলার ছোটগল্প এই সমাজমানস ও ব্যক্তিসংকটকে ধারণ করে আর একবার গতিপথ পরিবর্তন করে। এই দ্বিখণ্ডিত বাংলার উভয় অংশের অনেক মানুষ নিজবাসভূমে পরবাসী হয়ে যায়। কেউ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
কেউ নিজ দেশেই দেশহীন হয়ে পড়ে। উভয় বাংলায় যারা দেশত্যাগের শিকার হয় তাদের মর্মবেদনা সাহিত্য ও ইতিহাসের পাতায় কালো অক্ষরে অক্ষয়মূর্তি লাভ করে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নীতি-আদর্শিক বিচ্যুতি, অস্তিত্বের সংকট ও রক্ষণশীল মনোভাব দেশভাগপরবর্তী গল্পে প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়। ভাষা আন্দোলন, শাসনতন্ত্র আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয়দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান- এ সব রাজনৈতিক আন্দোলনে সমাজবদলের সুর ধ্বনিত হয়। সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- এই কালপর্বে ছোটগল্প নতুন সমাজনিরীক্ষার মুখোমুখি হয়। বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থা, স্বৈরশাসন, অর্থনৈতিক শোষণ, মানবিক মর্যাদার বিনষ্টি এ কালপর্বের সাহিত্যকে করে তোলে প্রতিবাদী চেতনায় সমৃদ্ধ।
এ সময় এপার বাংলায় আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদুল্লাহ কায়সার, জহির রায়হান, হাসান হাফিজুর রহমান, রাবেয়া খাতুন, আনিস চৌধুরী, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, আবদুল মান্নান সৈয়দ, রশীদ হায়দার, সেলিনা হোসেনসহ আরো অনেকেই বাংলা ছোটগল্পের জগতকে শিল্পিত ও বহুবর্ণিল করে তোলেন। এ সময়ের গল্পকারগণ অনেকে ঔপন্যাসিক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। আঙ্গিক সচেতনতা, নতুন ভাষাকাঠামো ও নিরীক্ষা প্রবণতা এ সময়ের গল্পকে ভিন্নমাত্রায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তোলে।
একাত্তর পরবর্তী ছোটগল্প আর এক নতুন বাঁকে চলে আসে। এই বাঁকবদলের ফলে বাংলাদেশের ছোটগল্প যে গতিপথ লাভ করে সে পথেই চলছে সমকালীন ছোটগল্প। নতুন দেশ প্রাপ্তির স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ নিয়ে শুরু হলেও পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা যুগমানসকে পাল্টে দেয়। পাল্টে দেয় রাষ্ট্রব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের চরিত্র। রাজনীতির নতুন বিন্যাসের ফলে সাহিত্যও ধারণ করে নতুন মেজাজ। নতুন নিরীক্ষায় সাহিত্য হয়ে ওঠে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের হাতিয়ার। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ফলে নব্বইপরবর্তী সাহিত্য আবার গণমুখি হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অনেকেই ছোটগল্প লিখেছেন। এই কালপর্বে হুমায়ূন আহমেদ, মইনুল আহসান সাবের, ইমদাদুল হক মিলন, মঞ্জু সরকার, মনিরা কায়েস, জাফর তালুকদার, আতা সরকার, শাহরিয়ার কবীর, মামুন হোসাইন, শহীদুল জহির, নাসরিন জাহান, অদিতি ফাল্গুনী, আহমাদ মোস্তফা কামাল, আকমল হোসেন নিপু, আকিমুন রহমান, জাকির তালুকদার, পাপড়ি রহমান, আফরোজা অদিতি, রাশেদ রহমান, প্রশান্ত মৃধাসহ আরো অনেক গল্পকার ব্যক্তিসংকট, যৌনচেতনা, সাম্প্রদায়িকতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তির মনোজাগতিক দহন ও নিঃসঙ্গতার চিত্র এঁকেছেন। চন্দন আনোয়ার (জ. ৮ জানুয়ারি ১৯৭৮ খ্রি.) এঁদেরই সমগোত্রীয় গল্পকার। এ পর্যন্ত প্রকাশিত চন্দন আনোয়ারের মৌলিক গ্রন্থ সংখ্যা ১৭টি এবং সম্পাদিত গ্রন্থ দশাধিক। বাংলাদেশের শীর্ষ প্রকাশনীর পাশাপাশি কলকাতার একুশ শতক প্রকাশনী থেকে গল্পসংকলন ‘নির্বাচিত ৩০’ ও উপন্যাস ‘অর্পিত জীবন’ প্রকাশিত হয়েছে। দুই বাংলায় বরণীয় কথাসাহিত্যের পত্রিকা ‘গল্পকথা’ সম্পাদনা করেন দীর্ঘ একযুগ।
তাঁর গল্পগ্রন্থ : ১. প্রথম পাপ দ্বিতীয় জীবন; ২. অসংখ্য চিৎকার; ৩. পোড়োবাড়ি ও মৃত্যুচিহ্নিত কণ্ঠস্বর; ৪. ত্রিপাদ ঈশ্বরের জিভ ; ৫. ইচ্ছামৃত্যুর ইশতেহার; ৬. আঁধার ও রাজগোখরা; ৭. নির্বাচিত ৩০; ৮. বিশেষ ৫০। তাঁর দুটি উপন্যাস ১. শাপিতপুরুষ; ২. অর্পিত জীবন। এছাড়া কথাসাহিত্য-বিষয়ক প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক হিসেবেও তিনি বিদগ্ধমহলে সমাদৃত। বাংলাদেশের এই প্রতিশ্রুতিশীল কথাসাহিত্যিকের গল্প সম্পর্কে পশ্চিমবাংলার খ্যাতিমান কথাশিল্পী সাধন চট্টোপাধ্যায়ের মূল্যায়ন নিম্নরূপ :
চন্দন আনোয়ার প্রায় সকল গল্পের শুরুতেই আখ্যানে চাপা একটি টেনশন তৈরি করে। কাহিনির কোন ঘনঘটা থাকে না। পাঠককে টেনশনের সুতো ধরে ক্রমশ কৌতূহলকে মেলাতে মেলাতে, শরীরের সম্পসারিত অংশ হয়ে নিয়ে ক্রমশ দেশ হয়ে ওঠে।...
চন্দন আনোয়ারের আখ্যানের ভাষায় কাব্যময়তা নেই, পেলবও নেই। পড়তে পড়তে মনে হয় কাঁটা গাছ ছড়ানো খটখটে কোনো খরা অঞ্চলের লাল চাঁদের জ্যোৎস্নার আভা।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার গৌরব এনে দিয়েছে। হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতির প্রথম মুক্তি ঘটে একাত্তরে। তাই একাত্তর পরবর্তী বাঙালি বিশ্বের বুকে স্বতন্ত্র পরিচয়বাহী একটি জাতিসত্তা। একাত্তর পরবর্তী প্রজন্ম পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত প্রজন্ম।
গল্পকার চন্দন আনোয়ার এই প্রজন্মের প্রতিনিধি। যে কোন সময়সচেতন সাহিত্যপ্রতিভার মতোই চন্দন আনোয়ারের জীবনবোধ তাঁর যুগমানসকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ পথচলার অর্ধদশক না পেরুতেই হারায় স্বাধীনতার স্থপতিকে। এই ক্ষতচিহ্নকে বুকে ধারণ করেই জন্ম নিয়েছেন এবং বেড়ে উঠেছেন চন্দন। দেখেছেন কীভাবে জাতীয় চেতনার পালাবদল ঘটে। কীভাবে স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য লাভ করে। ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর শরীরে কীভাবে লেপ্টে দেওয়া হয় ধর্ম ও পুঁজিবাদের লেবাস। কীভাবে নতুন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে বহির্বিশ্বের সাথে।
চলমান ঘটনাপ্রবাহ, সমাজ-সংস্কৃতি, মানুষের স্বপ্ন, আশা-নিরাশার চিত্র চন্দন আনোয়ার তাঁর গল্পে তুলে আনেন সচেতনভাবেই। সামগ্রিকভাবে সমাজ, দেশ, রাজনীতিন দুর্বৃত্তায়ন, মানুষের মুল্যবোধের অবক্ষয় গল্পকারকে ভীষণভাবে পীড়া দেয়। যে-বিষয়গুলো তাঁর মনে রেখাপাত করে- সে-বিষয়কে কেন্দ্র করে আন্তর্তাগিদেই তিনি গল্প লিখতে বাধ্য হতেন। মানুষের স্বপ্ন, মানুষের বিশ্বাস ভাঙতে দেখলে লেখক স্বপ্নভঙ্গ কিংবা বিশ্বাসহারা মানুষের পক্ষ নিয়েই লিখতে শুরু করেন। চলমান বাস্তবতায় অবক্ষয় আর বিনাশে বিনষ্ট মানুষ-সমাজ-দেশ-সভ্যতার পঁচনধরা বিষয়ে চন্দন কলম-চালান চাবুকের রূপকল্পে। তাঁর সব গল্পই এ-ধরনের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।
নব্বই পরবর্তী নতুন শাসন ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী চেতনা আরো বেশি ঝেঁকে বসে জাতির পিঠে। একদিকে নগরায়ন অন্যদিকে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের নামে বিদেশ গমন- দুটোই বাড়তে থাকে। নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় আবহমান বাংলার যৌথ পরিবার ভেঙে পড়ে। একটি যৌথ পরিবার বিভক্ত হয়ে অনেকগুলো অণুপরিবার সৃষ্টি হয়। এই অণুপরিবারগুলো স্ব স্ব কর্মস্থলকেন্দ্রিক বাসস্থান গড়ে তুলে। যৌথ পরিবারের মানুষগুলো এভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়। এতে কর্মহীন প্রবীণদের জীবন সবচেয়ে বেশি নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে। এই নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, আক্ষেপ ও অস্তিত্বসংকট আধুনিক গল্পে প্রবলভাবে এসেছে। বিচ্ছিন্নতা থেকে নিঃসঙ্গতাবোধের এই মনোজাগতিক সংকটকে নিরীক্ষা করেছেন চন্দন আনোয়ার। নিঃসঙ্গচেতনা ও অস্তিত্বসংকট গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে চন্দন আনোয়ারের ‘স্কাইপ ও দুটি মৃত্যুমুখ’, ‘জীবনপাঠের সারাংশ’, ‘পরদেশি জরায়ু’, ‘মৃত্যুবিষয়ক কবিতাপ্রেমী’ ও ‘আদিম কাব্যকার’ গল্পে।
চন্দন ব্যক্তিচিন্তা ও ব্যক্তির নানামাত্রিক সংকটকে খুঁজে বের করেন ব্যক্তির ভেতর থেকেই। চরিত্রগুলো নিজেই উন্মুক্ত হয় স্বরূপে। সংকটগুলোর বয়ান করেন নির্মোহভাবে। অনেকক্ষেত্রে নিজেকেই দায়ী করেন নির্মমভাবে। জীবনের হিসেব মেলাতে চান সহজভাবে। কিন্তু বারবার জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খান। পারিপার্শ্বিকতাকে আঁকড়ে ধরেন। এক সময় নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই খুঁজে পান না নিজের অস্তিত্বের মধ্যে। অস্তিত্বসংকট ও একাকিত্বকে সঙ্গী করে জীবনকে বয়ে চলেন। জীবন শুধু প্রাণসর্বস্ব হয়ে ওঠে। উপভোগ্য হয় না। বিচ্ছিন্ন হতে হতে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে শেষে। তখন মৃত্যুই সঙ্গী হয় জীবনের। এই ধরনের বিক্ষত, বিপন্ন ও প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া জীবনের নির্মম চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় ‘স্কাইপ ও দুটি মৃত্যুমুখ’ গল্পে। গল্পের শুরুতেই জজ হাসান নিঃসঙ্গ ও মৃত্যুতাড়িত :
স্ত্রী শায়লার মৃত্যুর পরে ভয়ানক বিষণ্ণতায় মজে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত জজ হাসান। বুকের ব্যথায় ঘুম হয় না রাতে। মধ্যরাতের দিকে আকস্মিক কেঁদে ওঠে বিরহিনী কেউ। এই কান্নার শব্দ নিচের কোনো একটি রুম থেকে পরকীয়া প্রেমিকার মতো জড়সড় হয়ে নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে জজ হাসানের বেডরুমে, কিছুক্ষণ বেডরুমে ঘোরাফেরা করে, তারপর কখন যে মগজে ঢুকে আচ্ছন্ন অসার করে ফেলে শরীর! মৃত্যু-ক্লান্ত চোখে নিজের দিকে তাকিয়ে জজ হাসান আবিষ্কার করেন, মৃত্যুর চিহ্ন চোখ থেকে সংক্রামিত হয়ে ছড়িয়ে গেছে তার শরীরের সবখানে। চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে অসংখ্য মৃত্যু ব্যাঙাচির মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। লোমকূপের গোড়ায় গোড়ায় মৃত্যু। নিশ্বাসের গরম বাতাস মৃত্যুচিহ্নিত।
অবসরপ্রাপ্ত জজ হাসানের এই নিঃসঙ্গ জীবনের গল্পই হলো ‘স্কাইপ ও দুটি মৃত্যুমুখ’। এই নিঃসঙ্গতাকে নিজেই ডেকে এনেছেন তিনি। বড় ছেলে আলাদা ফ্ল্যাটে থাকে। ব্যস্ত জীবনে বুড়ো বাবার খোঁজ নেওয়ার সুযোগ হয় না খুব একটা। দ্বিতীয় ছেলে প্রবাসী। থাকে ভার্জিনিয়ায়। মেয়েও কানাডায় স্থায়ী হয়েছে। সন্তানরা স্কাইপিতে বাবার মুখ দেখে। শরীরের খবর নেয়। এতে সন্তানরা তৃপ্ত হয়। কিন্তু বিপত্নীক অবসরপ্রাপ্ত জজ হাসানের একাকিত্ব ঘুচে না। নিঃসঙ্গতা আরও বেশি চেপে বসে মনে। নিঃসঙ্গ জীবনে তার একমাত্র সঙ্গী হয় মৃত্যুচিন্তা।
একদিন তারই জানালার শিক আঁকড়ে ধরে ঝুলে থাকা একটি কুকুরশাবককে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচায় জজ হাসান। শুধু বাঁচায় না, তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রেহাই পায় একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা থেকে। আর একটি সন্তানের মতোই কুকুরশাবকটির সুখদুঃখের ভাগীদার হয়ে ওঠে জজ হাসান। নিজের সন্তানদের নামের সাথে মিলিয়ে কুকুরশাবকটির নাম রাখে সুজন। সুজনকে ঘিরে জজ হাসান স্মৃতিকাতর হয়। সন্তান বাৎসল্যে আলোড়িত হয়ে ওঠে দেহমন। নতুন করে জীবনের হিসেব কষতে শুরু করেন।
কারণ অন্ধকার, মৃত্যু আর একাকিত্বকে ভয় পাওয়া জজ হাসানের নিঃসঙ্গ যাপিত জীবনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়েছে সুজন। এক পর্যায়ে সুজন তার অস্তিত্বের সাথে এতোটাই একাকার হয়ে যায় যে, জজ হাসান সুজনকেই তার উত্তরাধিকার করে যেতে চায়। কারণ সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ জীবনে সুজনই জজ হাসানকে পিতৃসুখ দিয়েছে। সুজনের জন্য জীবনের শেষ কটা দিন বেঁচে থাকার আনন্দ পেয়েছে হাসান। সুজন মারা গেলে বাড়িটা যেন কাজের মেয়েটা ও তার সন্তানরা পায় সেভাবেই লিখে দেওয়ার কথা ভাবে জজ হাসান। কতটা মর্মপীড়া অনুভব করলে একজন পিতা তার সন্তানদের বদলে একটি কুকুরকে উত্তরাধিকার বানাতে চায়।
একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা একজন মানুষকে আপনজন থেকে কতটা দূরে ঠেলে দেয় সে বিষয়টিই তুলে ধরা হয়েছে গল্পে। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিপত্নীক বৃদ্ধের বেঁচে থাকার অবলম্বন হলো তার সন্তান-সন্ততি। কিন্তু জীবিকা তথা নিরাপদ জীবনের আশায় যখন সন্তানরা বিদেশে চলে যায় তখন ঐ বৃদ্ধের বেঁচে থাকাটা দুঃসহ হয়ে ওঠে। এভাবেই সম্পর্কের পালাবদল ঘটে। জীবনসংকটের এই নতুন নিরীক্ষা চন্দনের গল্পকে করে তুলেছে আরও বেশি জীবনঘনিষ্ট।
যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নয়নের ফলে বিশে^র যেকোন প্রান্ত থেকে যেকোন ব্যক্তির সাথে কথা বলা ও পরস্পরের ছবি দেখা সম্ভব হয়েছে। তাই শারীরিকভাবে কাছে থাকার আবেগ এখন অনেকটাই দুর্বল হয়ে গেছে। তাই কানাডা থেকে মেয়ের কাতরোক্তি ‘বাবা তোমার স্কাইপ খোল। তোমার মুখটা দেখব।’ এই দেখায় কোন বাবার নিঃসঙ্গতা কাটে না। এই দেখার মাধ্যমে সম্পর্কের বাঁধন দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখা যায় না। আবেগকে প্রবল করে রাখা যায় না।
তবু এই যান্ত্রিক যোগাযোগই এখন প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ফলে রক্তসম্পর্কও দুর্বল হয়েছে। রক্তসম্পর্কের অবনতি পরিবারস্থ ব্যক্তিদের মনস্তত্ত¡কে আমূল বদলে দিয়েছে। ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে পারিবারিক বন্ধনের দিকে ফিরে তাকানোর সময় ও মানসিকতা কোনটাই ব্যক্তিচিন্তায় স্থান পাচ্ছে না খুব একটা। তাই বৃদ্ধ বাবাকে দেখতে আসার জন্য নয়, বৃদ্ধ বাবার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয় প্রবাসী সন্তানেরা। অসুস্থ বাবাকে দেখতে আসার সময় নেই সন্তানদের। বাবার মৃত্যুই শুধু পারে সন্তানদের দেশে আনতে। তাই নিশ্চিত মৃত্যুর সংবাদেই তারা দেশে আসতে চায়। এর অন্যথা হলে স্বস্তিবোধ করে না। এমন এক নির্মম জীবনচিত্র এঁকেছেন চন্দন তাঁর ‘জীবনপাঠের সারাংশ’ গল্পে। গল্পের শুরুতেই উকিল সাইদুর রহমানের বেঁচে থাকার বিড়ম্বনার কথা বলেছেন গল্পকার এভাবে:
অশীতিপর বদ্ধ উকিল সাইদুর রহমান আরও ১৭ বছর বেঁচে সেঞ্চুরি পূর্ণ করার স্থির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলে এ নিয়ে তৃতীয়বার দাফন-কাফনের পূর্ণপ্রস্তুতি নিয়ে আসা তার প্রবাসী দুই ছেলে এক মেয়ে ভয়ানক বেকায়দায়-ই পড়ে গেল। এভাবে কী কেউ মৃত্যুকে অস্বীকার করে! তৃতীয় বিশ্বের হা-ভাতের দেশে তো বটেই, উন্নত বিশ্বের উচ্চমানের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষানীতির কড়াকড়ির মধ্যেও আশির বাউন্ডারি অতিক্রম করে ক’জন! বাংলাদেশের মতো মৃত্যুপরাকীর্ণ দেশে, যেখানে জীবন ও চিকিৎসার সুরক্ষা নেই, গোলাগুলি, ক্রশফায়ার-হরতাল, জঙ্গি আক্রমণ, সড়ক দুর্ঘটনা বিবিধ রূপ নিয়ে মৃত্যু মানুষের পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ায় পোষা বিড়ালের মতো, সেখানে উকিল সাইদুর রহমান এখন তিরাশিতে!
উকিল সাইদুর রহমান শুধু অশীতিপর বৃদ্ধই নয়, বিপত্নীকও। বড় ছেলে রাহাত রহমান মন্ট্রিলে, ছোট ছেলে আনিফ রহমান নিউইয়র্কে এবং কন্যা সাকিরা রহমান পুত্রজায়ায় বসবাস করে। কাজের বুয়া পরিজাবানুর মাধ্যমে ছেলেমেয়েরা বাবার খবর পায়। দুইবার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে দেশে এসে বাবাকে জীবিত পায়। এতে সন্তানরা খুশি হতে পারে না। কারণ আবার আসার ঝামেলা পোহাতে হবে। কাজের বুয়া পরিজাবানুকে এবার নিশ্চিত মৃত্যু হলেই ছেলেমেয়েদের খবর দিতে হবে। এমতাবস্থায় নিজের মৃত্যু কামনা করাই এখন উকিল সাইদুর রহমানের একমাত্র কাজ।
নিজের মৃত্যুই এখন পারে সন্তানদের শেষবারের মতো দেশে আনতে। একদিন সাইদুর রহমানকে মৃতপ্রায় অবস্থায় দেখে পরিজাবানু মন্ট্রিল, নিউইয়র্ক ও পুত্রজায়ায় সন্তানদের খবর দেয়। সন্তানরা বাবার মৃত্যু ও সৎকারের প্রস্তুতি নিয়ে দেশে আসে। কিন্তু সন্তানদের দেখে সুস্থ হয়ে উঠেন বাবা। এতে সন্তানরা খুশি হতে পারে না। বাবা এবার সন্তানদের নিশ্চিন্তে প্রবাসে থাকতে বলেন। এক’শ বছর বেঁচে থাকবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিরাশি বছরের বাবা। এই হলো গল্পের মূল কাহিনি।
উকিল সাইদুর রহমানের নিঃসঙ্গ জীবন এতোটাই অসহনীয় হয়ে উঠেছে যে, সে নিজে পেশাদার কিলারের মাধ্যমে নিজেকে খুন করতে চায়। কাজের বুয়ার বালিশ চাপায় মৃত্যু কামনা করে। কিন্তু এর কোনটাই নিরাপদ নয়। আইনি সমস্যা হতে পারে। তাই বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এই বেঁচে থাকা মানে নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্বে ডুবে থাকা। সাইদুর রহমানের সন্তানরা আর দেশে ফিরবে না। প্রসঙ্গত দেশের দুরবস্থা বিষয়ে সাইদুর রহমানের আক্ষেপোক্তি :
আইনশৃঙ্খলার বালাই নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই, ক্ষমতা যার অর্থবিত্ত, পুলিশ, আইন সবই তার,খাদ্যখাবারে ভেজাল, মানুষে পথঘাট গিজগিজ করে, দূষিত পরিবেশ, মান্ধাতার আমলের পরিবহন, ধর্মান্ধ-জঙ্গিদের অভয়ারণ্য, দুর্নীতিতে হ্যাট্টিক, বাঙালিপনার আদিখ্যেতা, পুরনো সব ফালতু ভ্যালুজ আঁকড়ে আছে এখনো! উন্নতবিশে^র দেশগুলো যখন মঙ্গলগ্রহ দখলের লড়াইয়ে ব্যস্ত, এখানকার পলিটিক্যাল পার্টিগুলি বানরের পিঠা ভাগ করার মতো যাকাতের টাকা, এতিমের টাকা, বন্যার্তদের পোশাক-খাবার-টিন, রাস্তা মেরামতের পারসেন্টেজ এ সব নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরে। জন্ম নিয়েছে বলে এতো দায় পড়েনি যে, এ দেশে থেকে মূল্যবান জীবন নষ্ট করবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে। এতো বোকা ওরা নয়! ওদের সন্তানেরা বাংলা বর্ণমালা চোখেই দেখেনি, বাংলাদেশ নামটিই ওদের উচ্চারণে বাঙ্গালাড্যাস হয়ে গেছে।
নব্বই পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সাথে আন্তর্জাতিক বিশ্বের নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষা, কর্মসংস্থান, অভিবাসন ও নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ অবারিত হয়। উন্নত, সমৃদ্ধ ও বিলাসী জীবনের প্রত্যাশায় বিদেশ গমনের হার বাড়তে থাকে। অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের উন্নত জীবনের কথা চিন্তা করে বিদেশে পাঠাতে শুরু করে। এতে আর্থিক স্বচ্ছলতা লাভ হলেও আত্মিক দূরত্বের সৃষ্টি হয়। বিদেশে স্থায়ী হওয়া সন্তানদের বাবা-মা বার্ধক্যে এসে চরম নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। কাজের লোক আর পোষাপ্রাণিই তাদের নিঃসঙ্গ জীবনের একমাত্র অবলম্বন হয়। সময়বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে নিঃসঙ্গতার এই নির্মম চিত্রটিকেই গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছেন চন্দন আনোয়ার।
চন্দন আনোয়ার গল্পের সূত্র মেনেই গল্প শুরু করেন, কিন্তু শেষটা হয় যেন প্রত্যাশার চেয়ে অধিক প্রচ্ছন্ন। তাঁর গল্প প্রচলিত ধারা স্পর্শ করে খানিকটা আলাদা, কিছু চমকপ্রদ, বাহুল্যতাবর্জিত, গল্পবাজারে টিকে থাকার মতো।
নিঃসঙ্গ মানুষকে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত করে মৃত্যুচিন্তা। এক পর্যায়ে এই মানুষগুলো মনোবিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে ও মৃত্যুকে নিয়ে খেলা করে। মৃত্যুকে নিয়ে খেলা করা এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের মৃত্যু ও কবরভাবনার এক ব্যতিক্রম চিত্র তুলে ধরেছেন চন্দন তাঁর ‘মৃত্যুবিষয়ক কবিতাপ্রেমী’ গল্পে। মৃত্যুবিষয়ক কবিতাপ্রেমী লোকটির নিঃসঙ্গতা ও কবরভাবনার স্বরূপ হলো :
বিকেলের নাস্তা সামনে নিয়ে সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে হঠাৎ সে বলে ওঠে, এই শহরের প্রত্যেকের নামে একটি করে কবর বরাদ্দ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য, যেন সে মানুষটি তার শেষ আশ্রয়টি দেখে যেতে পারে; এবং নিশ্চিত হয়ে যেতে পারে যে, মৃত্যুর পরে সে একটি কবর পাচ্ছে। সে সরকারি চাকরিজীবী ছিল, এখন অবসরে। প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুয়েটি, পেনশন ইত্যাদি অবসরকালীন সুবিধা থেকে প্রাপ্ত টাকা দিয়ে যা কিছু করবে বলে ভেবেছিল তার মধ্যে একটি কবরের জমি কেনার কথা ছিল। মোটামুটি দীর্ঘ একটি জীবন কেটে গেল আশা-নিরাশা-অনিশ্চয়তা আর দ্বিধার খেলা খেলে। কিছু চাইতে গিয়ে বিব্রত বালকের মতো প্রায়ই হাত গুটিয়ে রেখেছে। এই দ্বিধার কারণে বিয়ে-সংসার-সন্তান কিছুই হয়নি। সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ নিরলঙ্কার একটি জীবন।
এ জীবন ছুটেছে মৃত্যুর পানে। একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে যিনি সংসার করেননি। বার্ধক্যে এসে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন। কিছু সময়ের জন্য তিরিশ/পঁয়ত্রিশ বছরের একটি কাজের মেয়ে আসে বাড়িতে। কাজ শেষে চলে যায়। এই নিঃসঙ্গ মানুষটি পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুয়েটির টাকা দিয়ে যা কিছু করতে চান তার মধ্যে একটি হলো করবের জন্য জায়গা কেনা। সকল মানুষেরই এটা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। কাজের মেয়েটির জন্য কবরের জায়গা আছে কিনা জানতে চাওয়ার পর মেয়েটি আর কাজে আসে না। এরপর মৃত্যুচিন্তা, কবর আর মেয়েটির খোঁজ নেওয়াই হয়ে ওঠে তার একমাত্র কাজ। রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের মত্যুবিষয়ক কবিতাই এখন তার সঙ্গী।
মৃত্যুবিষয়ক কবিতা ও কবরভাবনা লোকটিকে স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে। এই বিচ্ছিন্নতা মানুষকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়। শুধু সম্পদ নয়, মানবজীবনে মানুষেরও প্রয়োজন আছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষই মানবজীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেই একজন মানুষ সেটা বুঝতে পারে। ‘মৃত্যুবিষয়ক কবিতাপ্রেমী’ গল্পের বৃদ্ধ লোকটির মৃত্যু ও কবরভাবনা তাকে একটি অস্বাভাবিক মনোবিকারগ্রস্ত ব্যক্তিতে পরিণত করে তুলেছে।
ব্যক্তিচিন্তার এই বিকার ও বিচ্ছিন্নতাবোধ ব্যক্তিকে করেছে দারুণভাবে সংকটাপন্ন। এই জীবনসংকট এখন সমাজের একটি শ্রেণির মধ্যে এতোটাই ঘনীভূত হয়েছে যে এটা এখন সামগ্রিক সমাজসংকটের কারণ হয়ে উঠছে। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় নিঃসঙ্গতাকে বরণ করেন কখনো কখনো। নিঃসঙ্গতার এই মনোজাগতিক টানাপোড়েন নিয়ে খেলেছেন চন্দন।
চন্দন আনোয়ারের গল্পের আর একটি জীবনসংকট হলো যৌনবিকারগ্রস্ততা। যৌনজীবনে অতৃপ্ত লোকগুলোও নিঃসঙ্গ। মানসিক শূন্যতা ও বিচ্ছিন্নতা সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায় এসব লোকদের। এ ধরণের অতৃপ্ত ও যৌনবিকারগ্রস্ত এক নিঃসঙ্গ চরিত্র নির্মাণ করেছেন চন্দন তাঁর ‘আদিম কাব্যকার’ গল্পে। গল্পে যৌনবিকারগ্রস্ত লোকটি মানসিকভাবে নিঃসঙ্গ। যৌনজীবনে অতৃপ্তিই এই নিঃসঙ্গতার কারণ। কোনভাবেই তৃপ্ত হতে না পেরে লোকটি যৌনসুখের উদ্ভট কিছু উপায় খুঁজে বের করে। যৌনসঙ্গী সুরভিকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে তার আর্তচিৎকার শুনে যৌনসুখ পেতে চায়। লোকটির যৌনঅতৃপ্তিজনিত হাহাকার :
আজ চাবুক নয়, সুরভি। দড়িও নয়। ওইসব সুখ আমি পেয়েছি। ধন্যবাদ তোমাকে। আমি আরও নতুন সুখ চাই। নেকড়ের দাঁতের মতো ধারালো শক্ত হিংস্র চাকু এনেছি। প্রাণভয়ে ছুটন্ত শিকারকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে নেকড়ে যে সুখ পায়, সেই সুখ আজ আমাকে দেবে। চাকু উঁচিয়ে আমি ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো তাড়া করবো তোমাকে। তুমি প্রাণভয়ে দৌঁড়াবে। চিৎকার করবে। বাঁচাও বাঁচাও করবে। অতঃপর তুমি ক্লান্ত হয়ে পরাস্ত হয়ে লুটিয়ে পড়বে মাটিতে। আমি হালুম হালুম করে তোমার লুটিয়ে পড়া শরীর প্রদক্ষিণ করবো। নেকড়ের থাবার মতো আমার দুটি হাত দিয়ে ফুটবলের মতো তোমাকে সযত্নে ওলটপালট করে বিকট গর্জন করে ভয়ানক থাবা মারবো তোমার নরম মাংসের উপরে। ফসলি ক্ষেতে কৃষকের কাস্তে চালানোর মতো চাকু দিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে খুঁচিয়ে নকশাকাটা জালির মতো করবো তোমার শরীর। সেখান থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত বেরোবে। এই রক্ত আমার রক্তকে ক্রুদ্ধ করবে, নেকড়ের মতো হিংস্র করবে। তুমি কি প্রস্তুত, সুরভি?
লোকটির এই আদিম উল্লাস, এই মনোবিকলন তাকে বিচ্ছিন্ন করে সংসার থেকে। স্ত্রীর কামশীতলতা তাকে অস্থির করে তোলে। উদ্ভট যৌনক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করতে গিয়ে অস্বাভাবিক আচরণের এই লোকটি মারা যায় অস্বাভাবিকভাবেই। এখানেই গল্পের শেষ। ‘আদিম কাব্যকার’ গল্পে লোকটির নিঃসঙ্গতা তার অন্তর্গত বিষয়। বাইরের কোন সঙ্গই তার একাকিত্বকে দূর করতে পারেনি। সংসারে থেকেও এভাবে অনেকে নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে পারে। পরিবেষ্ঠিত থাকা মানেই সঙ্গসুখে থাকা নয়। পরিবেষ্ঠিত ব্যক্তিরাও একা, নিঃসঙ্গ হতে পারে; হতে পারে বিচ্ছিন্ন, হতে পারে অতৃপ্ত। গল্পে এই মনোদর্শন বিশ্লেষিত হয়েছে।
নিঃসঙ্গতার আর এক নির্মম চিত্র নির্মাণ করেছেন চন্দন তাঁর ‘পরদেশি জরায়ু’ গল্পে। অশীতিপর বিধবা বৃদ্ধা আলেয়া বেগমের নিঃসঙ্গ জীবনের অলিগলি স্পর্শ করতে চেয়েছেন তিনি। বৃদ্ধা আলেয়া বেগমের দেখা একটি স্বপ্নের বর্ণনা দিয়েছেন চন্দন গল্পের প্রথমাংশে। শেষাংশে আলেয়া বেগমের নিঃসঙ্গ জীবনের সংকটকে তুলে ধরেছেন। নিউইয়র্ক, বোস্টন ও অকল্যান্ডে স্থায়ী হওয়া ছেলেমেয়েদের জন্মবৃত্তান্ত ও বেড়ে ওঠার স্মৃতি নিয়ে আলেয়া বেগম দেশের মাটিতে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছেন।
প্রথম জীবনের স্মৃতি সব সময় তার জীবনকে জড়িয়ে থাকে বলে ঘুমের ঘোরেও সে প্রথম জীবনের নানা সুখ-দুঃখের স্মৃতি স্বপ্নেও দেখতে পান। স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর সাথেও তার যোগাযোগ ঘটে স্বপ্নে। আলেয়া বেগমের কোন অভাব নেই। সন্তানরা নিউইয়র্ক, বোস্টন ও অকল্যান্ড থেকে নিয়মিত মায়ের খবর নেয়। এই যাপিত জীবনে আলেয়া বেগম কেন- কোন বৃদ্ধা মা তৃপ্ত থাকতে পারেন না। এই অতৃপ্তি একাকিত্বের। আলেয়া বেগম চাইলেই এখন সন্তানরা দেশে আসতে পারেন না। একে তো দূরদেশ, তার উপর কর্মব্যস্ততা ও সন্তানদের লেখাপড়া। তাই মাকে দেখা কিংবা মায়ের দেখতে চাওয়ার বিষয়টি খুব বেশি গুরুত্ব পায় না সন্তানদের কাছে। আলেয়া বেগমের জীবনে নিঃসঙ্গতার সাথে যোগ হয় অভিমান :
চারাগাছ যেমন বড় হলে আলাদা গাছ হয়, সন্তানরা বড় হলে আলাদা মানুষ হয়ে যায়। ওরা কী ভুলে গেল এই সত্য, এই বাড়িতেই এই ছোট্ট পেটেই-পেটের উপরে হাত রাখে আলেয়া বেগম-এই ছোট্ট জরায়ু-ই ওদের প্রথম ঠিকানা। এই বাড়ির মাটি, এই বাড়ির চৌহদ্দি, এই গরিব দেশই খাদ্য-খাবার-আলো বাতাস শিক্ষা দিয়েছে ওদের। বোস্টন নিউইয়র্ক অকল্যান্ডের পথগুলো যত মসৃন আর প্রশস্তই হোক, যে রক্তাক্ত পিচ্ছিল পথ দিয়ে পৃথিবীতে এলো আমার সন্তানরা, সেই পথের চেয়ে কী বড়?
ভূমি ব্যবসায়ী লায়েক আলী প্রবাসী সন্তানদের সাথে যোগাযোগ করে আলেয়া বেগমের দীর্ঘদিনের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি কিনে নেয়। বিষয়টি আলেয়া বেগম জানতে পারে না। কারণ আলেয়া বেগমের মৃত্যুর পরই বাড়িটি দখল নেওয়ার কথা হয়। ঘটনাচক্রে লায়েক আলীর এক মাটিকাটা শ্রমিক আলেয়া বেগমের বাড়িতে পানি খেতে আসলে সেই শ্রমিকের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারে আলেয়া বেগম। আশি বছরের আলেয়া বেগম এতে খুব একটা বিচলিত হয় না। কারণ তার মৃত্যুর পর সন্তানরা আর দেশে ফিরবে না। তাই বর্তমান বাড়ির চেয়ে বাড়িকে ঘিরে অতীত স্মৃতিই আলেয়া বেগমের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। নিঃসঙ্গ আলেয়া বেগমের সঙ্গী এখন অতীত স্মৃতি আর স্বপ্নে পাওয়া স্বামীসঙ্গ।
নস্টালজিক এই আলেয়া বেগম শুধু একটি গল্পের চরিত্র নয়, একটি শ্রেণির প্রতিনিধিও। আমরা এমন অনেক আলেয়া বেগমকে খুঁজে পাবো সমাজে যাদের ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত। যারা স্বামীর স্মৃতি, সন্তানদের বেড়ে ওঠার স্মৃতি বুকে নিয়ে বেঁচে আছে শূন্য বাড়িতে। কাজের লোক আর পোষাপ্রাণিই যাদের সামান্য সঙ্গ দেয়। এঁদের নিঃসঙ্গ জীবন নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই। ভরণপোষণের ব্যবস্থা করেই এঁদের সন্তানরা দায়মুক্ত হয়। অনেকে সেটাও করেন না। জজ হাসান ও উকিল সাইদুর রহমান আলেয়া বেগমেরই গোত্রভুক্ত। এঁদের আবেগ মূল্যহীন।
তাই কারো জন্য অপেক্ষা নয়, কেবল মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করাই এঁদের নিয়তি। মৃত্যুচিন্তা ছাড়া আর কারো জন্য চিন্তা করতে হয় না। আবেগী এই মানুষগুলোর কষ্ট বোঝে না কেউ। এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকাটাই যেন অন্যায়। এঁদের মৃত্যুসংবাদই আশা করে সবাই, এমনকি সন্তানরাও। অবসরপ্রাপ্ত বিপত্নীক জজ হাসান, বৃদ্ধ উকিল সাইদুর রহমান, বিধবা বৃদ্ধা আলেয়া বেগম একই শ্রেণির প্রতিনিধি। এঁরা সমাজের চোখে সুখি। কিন্তু নিজভুবনে সীমাহীন দুঃখী। আপনজনের সঙ্গ পাওয়ার জন্য সর্বদা ব্যাকুল। কিন্তু নিরন্তর নিঃসঙ্গ। অর্জিত সম্পত্তিও অনেক সময় এঁদের দুঃখের কারণ হয়। একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা থেকে এঁদের মনে জন্ম নেয় অনেক উদ্ভট চিন্তা। বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন অনেকে।
ব্যক্তির জীবনসায়াহ্নের এই অন্তর্গত সংকটকে উন্মোচন করেছেন চন্দন আনোয়ার। সমাজকে নির্মোহভাবে নিরীক্ষণ করেছেন বলেই সামাজিক এই অসঙ্গতিকে দেখতে পেয়েছেন। ব্যক্তির মনস্তত্ত¡কে উপলব্ধি করেছেন বলেই ব্যক্তিসংকটের এমন স্বরূপ দেখাতে পেরেছেন। আর সময়কে ধরতে পেরেছেন বলেই এমন কালচিত্র নির্মাণ করতে পেরেছেন। গল্পকার হিসেবে চন্দনের বিশেষত্ব এখানেই।