শহীদ কাদরীর ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কার উদ্দেশে?

কাব্য সম্পর্কে ইংরেজিতে ‘ইমাজিনেশন’ শব্দটি প্রচলিত আছে। এর বাংলা কী? যে কবির কল্পনা প্রতিভা আছে সে ছাড়া আর কেউ কাব্য সৃষ্টি করবার মতো অন্তঃপ্রেরণার দাবি করতে পারে কি? এবং এ প্রেরণা ছাড়া শ্রেষ্ঠ কবিতা লেখা কী করে সম্ভব হতে পারে?

২৬ ডিসেম্বর, ১৯৫৪ সালে, বরিশাল ‘সর্বানন্দ ভবনে’ বসে কবি জীবনানন্দ দাশ একটি চিঠিতে এই বাক্যগুলো লিখেছেন। আমাদের বিশিষ্ট কবি শহীদ কাদরী এবং একান্ত কাছের মানুষ শহীদ ভাইয়ের প্রতিভাবান কবি জীবনের পক্ষেও এ কথাগুলো অমোঘভাবেই প্রযোজ্য। ষাটের দশকে উজ্জ্বল উত্তরাধিকার-এর কবি সত্তরে আরও দুটো বই আমাদের উপহার দিয়েই অনেক দিনের জন্য হলেন বিদেশগামী এবং কবিতাহীন। উজ্জ্বল প্রতিভা এবং ততোধিক উজ্জ্বল কাব্যিক সততার উদাহরণ বাংলা কবিতার ইতিহাসে খুবই বিরল। কেবলমাত্র সমর সেনের কথাই এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। 

সৌভাগ্যের বিষয় যে শহীদ ভাই কবিতা লেখা একেবারে ছেড়ে দিতে চাইলেও কবিতা তাঁকে ছাড়েনি কখনো। তাই হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো কোনো কোনো সময় সাম্প্রতিক সাহিত্য সাময়িকীর পৃষ্ঠায় আমরা আনন্দিত শিহরণে আবিষ্কার করতাম স্বেচ্ছানির্বাসিত কাদরীর বিদেশ বসে লেখা কিছু কবিতাও।

অনেক  পথ  পার  হয়ে  এসেও মানবিক  অভিজ্ঞতার  এবং  মানবজীবনের  কিছুটা  স্ববিরোধী গভীরতার  কবি  আমাদের  শহীদ  ভাই।  এক বিজনবাসী  কবি  ছিলেন  শহীদ কাদরী।  কিয়ৎ পরিমাণে  ভূতলবাসীও দস্তয়েভস্কির অর্থে-বটে তিনি। চেতন-অবচেতনের মাঝখানে  প্রবল অত্যাচারের  এই  পৃথিবীর  স্নায়ুবিক  বিকার ও  যন্ত্রণা  থেকে  বাংলা  ভাষার  পরিশ্রমী  এই  শ্রমিক  উদ্ধার  করে  এনেছিলেন তীক্ষ্ণ, তীব্র, আত্যন্তিক সৎ সব শব্দাবলি। ‘সিৎসোফ্রেনিয়ার’  কবি শহীদ কাদরী তাই লিখতে পেরেছিলেন গভীর যন্ত্রণাময় এই অবিস্মরণীয় পঙক্তিগুলো :

সংবাদপত্রের শেষ পৃষ্ঠা থেকে বেরিয়ে এসেছে
এক দীর্ঘ সাজোয়া বাহিনী
এবং হেডলাইনগুলো অনবরত বাজিয়ে চলছে সাইরেন। 
একটি চুম্বনের মধ্যে সচিৎকার ঝলসে গেল কয়েকটা মুখ,
একটি নিবিড় আলিঙ্গনের আয়ুষ্কালে
৬০,০০০,০০ উদ্বাস্তুর উদ্বিগ্ন দখল
লাফিয়ে উঠলো  এই টেবিলের ’পর;
বেয়োনেট ছিঁড়ে যাওয়া নাড়ি-ভুঁড়ি চেপে,
বাম-হাতে রেফ্রিজারেটর খুলে পানি খেলো 
যে লোকটা, তাকে আমি চিনি, 
***
তাই আমি মহা-উল্লাসে 
নেমন্তন্ন করলাম তাকে 
আমাদের প্রাত্যহিক ভোজনোৎসবে
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে সুখাদ্যের ধোঁয়া
কেননা এক বাচাল বাবুর্চির  
সবল নেতৃত্বে
আর সুনিপুণ তত্ত্বাবধানে
আমাদের স্বচ্ছল কিচেন
অনর্গল রান্না হয়ে চলছে আপন-মনে
নানা ধরনের মাংস—
নাইজেরিয়ার, আমেরিকার, সায়গনের, বাংলার কালো,
শাদা, এবং ব্রাউন মাংস।

এমন একজন সাংঘাতিক কবিই লিখতে পারেন তাঁর প্রিয়তমাকে—

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
স্টেটব্যাংক গিয়ে 
গোপাল কিংবা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অনন্ত চার লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে
একটি বেলফুল দিয়ে চারটি কার্ডিগান।
ভয় নেই, ভয় নেই

যদিও তাঁর ভাষায় আমরা সবাই—’জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন থেকে নেমে—’ তবুও সচেতনতাই আমাদের একমাত্র সম্বল। তাই তিনি শেষমেশ লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন :

বিপদ-সংকেত জ্বেলে একজোড়া মূল্যহীন চোখ
পড়ে আছি মাঝরাতে কম্পমান কম্পাসের মতো অনিদ্রায়।

চূড়ান্ত বিচারে আত্ম ও সমাজ সচেতন এই বেপরোয়া ও বোহেমিয়ান কবি মানুষেরই কবি। ক্ষোভ ও আত্মপ্রতারণার কোনো বালাই ছিল না শহীদ ভাইয়ের। দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়েও তিনি পলায়নপর হননি। কঠিন সত্যের আবিষ্কর্তা এই কবি তাই এক অর্থে ‘রূপনারাণের কূলে’র সত্যান্বেষী বিশ্বকবির যোগ্য উওরাধিকারী। বেশ কয়েক বছর আগে প্রকাশিত ‘মানুষের জন্য’ কবিতার প্রথম কয়েক লাইন মনে হয় যেন শহীদ কাদরীকে নিয়েই লিখেছিলাম :

মানুষ মানুষের পাশে
খুব কাছাকাছি চলে এলে
পরের মুখে ঘ্রাণে প্রতিফলনে
নিজেরই মুখোমুখি এসে
নিজেরই পাশে নিজেই অক্লেশে
বুঝি বা দাঁড়ায় হেসে।

শহীদ কাদরী সেই ব্যক্তিমানুষের এবং সমাজ সচেতন মানুষেরই কবি। হয়তো একবিংশ শতাব্দীর ব্যস্ত মানুষদের শোকের আয়ু একবছর এর চেয়ে কম। কিন্তু আমরা যারা তাঁর সঙ্গ পাবার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম, তাদের কাছে শহীদ ভাইয়ের স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে থাকবে, আমাদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। যতদিন বাংলা ভাষা ও কবিতা বেঁচে থাকবে ততদিন নতুন পাঠক-পাঠিকাদের নতুন নন্দনে বেঁচে থাকবে শহীদ কাদরীর কবিতা। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে।     

একদা রেনে শার সুরবিয়ালিজমের পরাবাস্তবতাকে বাস্তবের চিত্রকল্প দিয়ে ধরতে গিয়ে মানুষের চেতন-অবচেতনের দুটি অংশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। শারের ভাষ্যানুযায়ী মানবমনের এক অংশের প্রতীক গাছ অন্য অংশের প্রতীক প্রাণী। প্রথম অংশটি শরীরের শিকড়ে রক্তমাংসের মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। আর দ্বিতীয় অংশটি আকাশে ডানা মেলে কল্পলোকে বিচরণ করতেই ভালোবাসে। আমার কেবলই মনে হয় যে শহীদ কাদরীর সবচাইতে গভীর কবিতার ভেতরে শারের এই গাছ ও প্রাণীর দ্বান্দ্বিক সমন্বয়ই লক্ষ্য করা যায়। 

শহীদ কাদরীর শেষ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ, আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও প্রথম বেরিয়েছিল ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে, অবসর প্রকাশনা সংস্থা থেকে। এর পরেও  শহীদ ভাই স্বল্পপ্রজ হলেও আরও কিছু কবিতা লিখেছেন। এখানে আমি তাঁর ২০০৯ সালে প্রকাশিত এ বইটির একবারের শেষের কবিতাটি নিয়ে আলোচনা করেই এ প্রবন্ধের ইতি টানতে চাই। নানা কারণে, যার কিছুটা নিচে আলোচিত হবে, এ কবিতাটি আমার কাছে খুব প্রাসঙ্গিক ও তথ্যপূর্ণ মনে হয়। 

সতর্ক পাঠক, প্রথমেই লক্ষ করবেন যে, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ শিরোনামটি রবীন্দ্রনাথের সোনার তরীর একটি বিখ্যাত কবিতার নাম। শহীদ কাদরীর মতো পড়ুয়া আধুনিক কবির এই নাম ব্যবহার নিশ্চয়ই আকস্মিক নয়। এটা আমার জন্য অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে বিবিধ তর্কের তোড়ে শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে প্রকাশনার পর অনেক আলোচনার সময় তাঁকে এই নামকরণের উদ্দেশ্য এবং তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিতে তাৎপর্য সম্পর্কে সরাসরি প্রশ্ন আমি করিনি। অবশ্যই কবির সচেতন উদ্দেশ্য আর পাঠকের বিশ্লিষ্ট অর্থ এক না হলেও অসুবিধা নেই। আর উত্তরাধুনিক পাঠক প্রতিক্রিয়ায়-প্রত্যুত্তরে—স্ট্যানলি ফিশের সমালোচনার ধারা অনুযায়ী—অথবা ডিকনস্ট্রাকশন বা দেরিদীয় অনির্মাণের যুগে কবি বা লেখকদের উদ্দেশ্য অনেকটা অপ্রয়োজনীয় বলেই অনেক সমালোচক ধরে নেন।

সে যাই হোক আমার ধারণা যে শহীদ কাদরী যা-ই ভেবে এ নাম দিয়ে থাকেন না কেন, একশ বছরেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে একই নামের দুটো কবিতার আধুনিকতার দুরকম মনন ও অনুরণন বিদ্যমান। 

রবীন্দ্রনাথের কবিতার রচনাকাল দেয়া হয়েছে ২৭ অগ্রহায়ণ, ১৩০০। অর্থাৎ মোটামুটি ১৮৯৩ সালের দিকে। সোনার তরী-তে রবীন্দ্রনাথ বিহারীলাল ইত্যাদির গীতিকবিতার ঝোঁক মোটামুটি কাটিয়ে উঠেছেন। তবুও আবহমান কালের বাংলা গীতিকবিতা এবং শেলী-কীটসের রোমান্টিক রহস্যবাদিতা সোনার তরীর প্রায় সব কবিতাতেই লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু এই কবিতায় মিশ্র কলাবৃত্তের আধারেই বিষমপদী পয়ার রচনার সাহস দেখিয়েছেন। সুতরাং আঙ্গিকের দিক দিয়েও সদ্য তিরিশ-পেরোনো রবি ঠাকুরকে সাহসী স্রষ্টাই বলতে হবে।

এ কবিতার প্রথম চার লাইন পড়লেই আমার এ মন্তব্য পরিষ্কার বোঝা যায়; (তৃতীয় ও চতুর্থ পঙক্তি বিশেষভাবে লক্ষণীয়)

আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী? 
বল কোন পার ভিড়িবে তোমার সোনার তরী।
যখনি শুধাই ওগো বিদেশিনী,
তুমি থাকো শুধু, মধুর হাসিনী—।

রবীন্দ্র-ঋণ শোধ করার জন্যই মনে হয় অনেক পরের বয়সের ভারে ন্যুব্জ কিন্তু মানসিকভাবে সমুন্নত বাঙালি কবি তাঁর ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ শুরু করেছেন এভাবে—

আমার মতন ভ্রাম্যমাণ এক বিহ্বল মানুষ
ঘরের দিকেই
      ফিরতে চাইবে
হ্যাঁ, এটাই সবচেয়ে সুস্থ
সহজ এবং স্বাভাবিক।
আমার নিজস্ব ঘরে প্রতিষ্ঠিত হব বলেই
আমি নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়েছিলাম একদা
আমার আজন্ম-চেনা গৃহচ্ছায়া থেকে—
আমার প্রথম কৈশোরের রৌদ্রকরোজ্জ্বল ভোরে।

রবি ঠাকুরের মিশ্র সাধু-চলিত ক্রিয়াপদের সমাহার এবং তুলনামূলকভাবে অল্প হলেও সংস্কৃত সাহিত্যের—অন্তত : জয়দেব ও তার পরবর্তী সময়ে বাংলা কবিতার আদলে কিছু সমাসবদ্ধ তৎসম শব্দের ব্যবহারের সঙ্গে কাদরীর অন্ত্যমিলহীন মুখের কথ্য ভাষার আনেক কাছাকাছি বিচরণের পার্থক্য চোখে পড়ে সহজেই। 

কিন্তু যেখানে কাদরী উওরাধিকারের ঋণ শোধ করেছেন সেটাও লক্ষণীয়। ‘ভ্রাম্যমাণ’, ‘স্বাভাবিক’, ‘প্রতিষ্ঠিত’, ‘গৃহচ্ছায়া’, ‘রৌদ্রকরোজ্জ্বল’—এসব শব্দচয়ন রাবীন্দ্রিকই বটে। অর্থাৎ একই সঙ্গে বোদলেয়ার, র‌্যাবোর বাউণ্ডুলে, ছন্নছাড়া বিচরণ যেটা সরাসরি রবীন্দ্র স্বভাবের বাইরে সেটাও লক্ষ্য করার বিষয়।

রবীন্দ্রনাথে যাত্রার অনিকেত সংকেত নেই বললে সত্যের অপলোপন হবে : 

যখন প্রথম ডেকেছিলে তুমি ‘কে যাবে সাথে’—
চাহিনু বারেক তোমার নয়নে নবীন প্রাতে।
দেখালে সমুখে প্রসারিয়া কর
পশ্চিমপানে অসীম সাগর,
চঞ্চল আলো আশার মতন কাঁপিছে জলে।
তরীতে উঠিয়া শুধানু তখন—
আছে কি হোথায় নবীন জীবন,
আশার স্বপন ফলে কি হোথায় সোনার ফলে?
মুখপানে চেয়ে হাসিলে কেবল কথা না ব’লে।।

তার পরে কভু উঠিয়াছে মেঘ, কখনো রবি—
কখনো ক্ষুব্ধ সাগর কখনো শান্ত ছবি।
বেলা বহে যায়, পালে লাগে বায়,
সোনার তরণী কোথা চলে যায়,
পশ্চিমে হেরি নামিছে তপন অস্তাচলে।
এখন বারেক শুধাই তোমায়—
স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হেথায়,
আছে কি শান্তি, আছে কি সুপ্তি তিমিরতলে?
হাসিতেছ তুমি তুলিয়া নয়ন কথা না ব’লে।।

কিন্তু যেখানে রাবীন্দ্রিক ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ মূলত রোমান্টিক এবং কাল্পনিক—প্রায় ঝুঁকিবিহীন—সেখানে কাদরীর যাত্রা সত্যিই ঘরের প্রতি আকুল আকর্ষণ সত্ত্বেও সচেতনভাবেই গন্তব্যবিহীন এবং এক চুর চুর হয়ে যাওয়া রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক জীবনের সংঘাত-বিক্ষুব্ধ :

তারপর থেকেই—ব’লতে পারো, শুরু
হয়েছে আমার
উথানে-পতনে ভরা (এক পা এগিয়ে যাওয়া এবং
দু’পা পিছিয়ে আসা) এক অন্তহীন নক্ষত্রবিহীন
যাত্রা।

শুরু হয়েছে আমার প্রত্যাবর্তন নানান
আঙ্গিকে। একদা
পদব্রজে
(বলতে পারো)  আমার বাড়ির দোরগোড়া অবধি
পৌঁছে গিয়েছিলাম পা-টিপে
পা-টিপে আমি, আহত জন্তুর মতো নিজস্ব গুহার খোঁজে।
কিন্তু শিকারিদের উল্লাস আর সারি সারি বল্লমের সুতীক্ষ্ণ উল্লাস
বাধ্য করেছে আমাকে ঘরের দোরগোড়া থেকে ফিরে যেতে।

বন্ধনীর ভেতরে লেখা (এক পা এগিয়ে যাওয়া এবং/ দু’পা পিছিয়ে আসা) যেন ফিসফিস করে সেই  ‘অন্তহীন নক্ষত্রবিহীন/ যাত্রা…’ যে যাত্রার শেষ নেই, হয়তো বা সম্পূর্ণই নিরর্থক যে যাত্রা—সেই অন্তবিহীন পথের ক্লান্তির আভাস দিয়ে যাচ্ছে।

প্রায় ফেরা ও প্রত্যাবর্তনের ইমেজ খুবই প্রাসঙ্গিক এখানে। এখানেও কবি নিম্নকণ্ঠ; কবি বন্ধনীতে (বলতে পারো) লিখে পাঠককে সাথী করে নিচ্ছেন খুবই নম্র ভাবেই। কিন্তু তার ঠিক পরেই এক জান্তব আদিম দৃশ্যের সম্মুখীন সে পাঠক।

‘…পা টিপে আমি, আহত জন্তুর মতো নিজের গুহার খোঁজে। কিন্তু শিকারিদের উল্লাস…’ বাধ্য করেছে আমাকে ঘরের দোরগোড়া থেকে ফিরে যেতে। 

ঠিক এর পরেই কবি এর ব্যক্তি-মানসের জ্বলন-দহনকে সামাজিক ঐতিহাসিক জটিলতায় সমুপস্থিত কারণ একটি অসাধারণ দৃশ্য ও বিবিধ অবিস্মরণীয় ইমেজের এবং বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের সমন্বয় (kinosynesthesia) মূলক সমাহারে :

আর সেবার যখন মন্ত্রের মতন গুঞ্জরণে-ভরা
এক বৃষ্টি পড়া রাত্রে
লুন্ঠন নিভানো নৌকার গলুই
দু’হাত আঁকড়ে
ভেসে আমি যাচ্ছিলাম সেদিকে
যেখানে জ্বলছে স্বদেশ
শবেবরাতের মোমের আলোর মতন
এয়োতির কপালের সিঁদুরের মতন
এবং তখুনি সীমান্তের টহলদার সৈনিকের বন্দুক উঠেছে গর্জে বারবার।

বিশেষ করে এখানকার শেষ তিন পঙক্তিতে ‘বিষণ্ণ স্বদেশ’ কেন এত ট্র্যাজিক বিষঙ্গের (Disassociation) জনক তা ফুঠে উঠেছে অনবদ্য অকরুণ এক গীতিময় রুক্ষতায়।

শবেবরাতের মোমের আলোর মতন 
এয়োতির কপালের সিঁদুরের মতন 
এবং তখুনি সমাজের টহলদার সৈনিকের বন্দুক উঠেছে গর্জে বারবার

বাউণ্ডুলে বোহেমিয়ান কবি আমাদের জানাচ্ছেন যে তিনিও নস্টালজিয়ার শিকার :

তিন তিনটি মহাদেশ থেকে
অন্তত ছ’বার উড়োজাহাজের টিকেট কিনেও
তোমাদের উঠোন পেরিয়ে
নিজস্ব আটচালার দিকে যাত্রা সাঙ্গ হয় নি এখনো।
তোমরা বিশ্বাস করো
ছয় বেহারার পালকিতে আমিও
চেপেছি একদা এবং ‘হুমনা হুমনা’
করতে করতে সেই গাঁয়ের নদীর
কিনার অবধি 
পৌঁছে

এত কাছে এসেও তবু দূরেই থেকে যান তিনি
 
কিন্তু আমি 
সেখানে আমার গাঁ কিংবা শহর
কিংবা বাড়ি কিছুই এখনো খুঁজে পেলাম না।

ঠিক একইভাবে ঘরে ফেরার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা পরাজিত হয় একবিংশ শতকের সাম্রাজ্যবাদী পৃথিবীর বাস্তব পরিস্থিতির কাছে :

অন্য একবার, উদ্দাম সমুদ্রে, ঝোড়ো আবহাওয়ায়
একটি নিমজ্জমান জাহাজের ডকে দাঁড়িয়ে দেখেছি
অপসৃয়মাণ উপকূলে,
তিমিরে আচ্ছন্ন, একটি অচেনা পাহাড়ের সানুদেশে,
আমার মা’র কপালে টিপের মতন
আমার বোনের নাকফুলের মতন
জ্বলজ্বল করছে একটি গ্রাম।
‘ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন জাহাজ থামাও’
না, আমি পারি নি চিৎকার করতে
অথচ আমার
হৃৎপিণ্ডে এখনো বেজে চলছে জলের পর ঘর-ফেরা
ছিপ নৌকার বৈঠার মতন! ‘ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন’ 

এখানে মায়ের কপালের টিপ কিংবা বোনের নাকফুল মোটেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। কিংবা ‘ছিপের নৌকার বৈঠার’ উপমাও নয় মোটেই কাকতালীয়। জয়েসের শিল্পীর মতন, স্টিফেন ডেডেলাসের মতো কিংবা আরও গভীরে নিমজ্জিত ‘ফিনেগানস ওয়েকের’ কিছু চরিত্রের মতো কাদরীও নিমজ্জমান জাহাজের যাত্রী—নিরুদ্দেশ যা নাকি স্বদেশের বাইরে কিন্তু অন্য কোনো নির্দিষ্ট ‘দেশে’ নয় অথবা কাদরী কি দেশে থাকলেও নিরুদ্দেশের যাত্রী হয়েই থাকতেন?

উপরের অনুচ্ছেদে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ অভিধানটি সজ্ঞানেই ব্যবহার করেছি। যে বইয়ের শেষ কবিতাটি নিয়ে আলোচনা করলাম এতক্ষণ তার প্রথম কবিতাটিতেই ‘শ্রেণিসাম্যের আদর্শে যারা একদা সংহত হয়েছিল…’ তাদের দূরোপমেয় পতন এবং উল্লাসিত ‘পশ্চিমা পণ্ডিত কূল’ যাঁরা নাকি ‘মেতে উঠে অশ্লীল উল্লাসে’ তাদেরকে একই কাতারে দাঁড় করিয়ে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত-হৃদয় কবির সকাতর নিবেদন ও প্রার্থনা।

দুই মহাযুদ্ধের শোণিতে রাঙা হয়ে আছে আমাদের 
নিজস্ব শতক; এবং এখনও ভ্রাতৃরক্তে সিক্ত আমারও স্বদেশ।

(বৃথা গেল মাতার এ অশ্রুধারা, স্বজনের শোণিত প্রপাত।) 
… 
এবং খুচরো পয়সার মতো পথে-বিপথে খরচ হয়ে গেছে
       সমকালীন স্বপ্নগুলো আমার। 

তাই বলি, বারবার বলি; না যেন পড়ে আমার রক্ত পদচ্ছাপ
       তোমাদের স্বতন্ত্র শতকে।

রক্তাক্ত পতনের সাম্রাজ্যবাদী পৃথিবীর নখর-দন্তের ছাপ এ বইয়ের অন্য অনেক  কবিতায়ই ছড়িয়ে আছে। 
‘গাছ, পাথর, সমুদ্র’ কবিতায় কবি সমুদ্রকে দেখছেন :

সমুদ্রকে দেখি, মাঝে-মাঝে, লুণ্ঠনপ্রিয় দস্যুদলের মতো 
কিংবা সাম্রাজ্য-লিপ্সায় কোনো অস্থির হননপ্রিয় নৃপতির মত আক্রমণ করে   স্থলপথে—
আমাদের নিজস্ব ভূবনডাঙা
ছিন্নভিন্ন করে দেয়।

যদিও শরীরী, দৈহিক প্রেমের নারীকে মাঝে মাঝে রক্ষাকবচের মতো আকাঙ্ক্ষা করেন কবি, শূন্যতা কাটাতে, হতাশাদীর্ণ মৃত ও শীর্ণ কৃশকায় কালো রাতের আঁধার  কাটাতে, আসলে তিনি জানেন যে পালানোর পথ নেই।

বোধ কবি এ কারণেই শেষমেশ কাদরী রবীন্দ্রনাথের রহস্যময় মরমিয়াবাদের সোনার তরী খুঁজে পাননি। বলতে পারেননি

শুধু ভাসে তব দেহ সৌরভ ,
শুধু কানে আসে জল কলরব,
গায়ে উড়ে পড়ে বায়ুভরে তব কেশের রাশী।

হতে পারেননি তিনি বিকল হৃদয় বিবশশরীর। ডাকতে পারেননি তিনি সেই গায়েবি জীবন দেবতাকে। শ্রেণিসংগ্রামে বিবশ-কাতর একুশ শতকের কবি তাই নির্মম সত্যের মুখোমুখি হয়েছেন মানবিক নিষ্ঠা নিয়ে এই প্রত্যয়ে যে,

‘কিন্তু এই নিরুদ্দেশ যাত্রা ঘরের দিকেই—পদব্রজে, হামাগুড়ি দিয়ে গিরগিটি বা সাপের মতো বুকে হেঁটে হেঁটে।‘

শারের কবি-প্রত্যয়ের মতোই বাংলার মাটিতে পোঁতা গাছ এবং বাংলার উড়ন্ত পাখির বিম্বিত রূপ ফিরে আসে কাদরীর বিষণ্নবেলার শেষের কবিতায়, কুয়াশা আক্রান্ত বারান্দায় তাই অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি এখন রুমাল নেড়ে চলছে। শহীদ কাদরীর এই সব বাঙালি কবিতার অনুরণন সাম্প্রতিক একটি হাইকুতেও লক্ষ করা যায় :

শীতে-বসন্তে আনন্দ-বিষাদে
যাযাবর পথ চলা অবিরাম
পথিকের প্রেম—জীবনের গভীর আহ্বান

চূড়ান্ত বিচারে শহীদ কাদরী এক বহুস্তরবিশিষ্ট চলমান জীবন্ত মানুষের আজীবনব্যাপী পরাবাস্তব অরোমান্টিক সংগ্রামেরই কবি। একাধারে সমাজ ও রাজনীতি সচেতন এবং আত্মদৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টি প্রসারী কাব্য ভাষার সন্ধানি শহীদ কাদরী। একদিকে যেমন তার উপমা, প্রতিমা, প্রতিতুলন, প্রতিষঙ্গ, প্রতিসাম্য, শ্লেষ বোদলেয়র ও র‌্যাবোকে ছাড়িয়ে যায় কুটি-প্রতিভার বিকরণে। অন্যক্ষেত্রে তাঁর বিষঙ্গ, একাকিত্ব বোধ এমনকি আলিয়েনশন মূলত ব্রেষটিয় সংগ্রামী গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার ফসল। জীবন ও চেতনার কাব্যিক প্রকাপের এমন দ্বান্দ্বিক সমন্বয়ের সাধনাতে খুব কম কবিই সফল হয়েছেন। শহীদ কাদরী সেই মুষ্ঠিমেয় শক্তিশালী স্বযুগে স্বকালে প্রোথিত সমুজ্জ্বল একাধারে সমাজ ও ব্যক্তিমানুষ ও মানসের অধিকারীদের অন্যতম।


হায়দার আলী খান প্রাবন্ধিক এবং অধ্যাপক, জন ইভান্স ইউনিভার্সিটি, জোসেফ কর্বেল স্কুল অফ ইন্টান্যাশনাল স্টাডিজ, ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়, কলোরাডো, যুক্তরাষ্ট্র। 

menu
menu