মহান কথার সমাহার
প্রতি বছর সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীরা পুরস্কার গ্রহণের সময় একটি ভাষণ প্রদান করেন।সেসব ভাষণ আমি আগ্রহভরে পড়ি।ভাষণগুলো পড়ে মনে হয়, প্রত্যেক নোবেলজয়ী কবি-সাহিত্যিক তাঁদের চিন্তা তথা সাহিত্যভাবনার নির্যাসটুকু সেই ভাষণে বলে দেন।সারাজীবন যা লিখেছেন, বলা যায়, ভাষণটি হচ্ছে তার সারসংক্ষেপ।ভাষণে তিনি তুলে ধরেন তাঁর সাহিত্যিক আকাঙ্ক্ষা, শৈল্পিক কলাকৌশল, সাহিত্যের দীর্ঘ বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার অভিজ্ঞতা, তাঁর জীবন ও রাজনৈতিক দর্শনের সংক্ষিপ্তসার, এমনকি তাঁর জাতি, তাঁর ভাষা নিয়েও মতামত ব্যক্ত করেন।এসব কারণে আমার কাছে মনে হয় নোবেল ভাষণগুলো হচ্ছে মহান কথার সমাহার।
নোবেল ভাষণগুলো পড়তে পড়তে একটি দৃশ্যপট আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে এবং তা এমন : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে কালের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো নিজ নিজ মাথায় জ্ঞানের ঝুড়ি বয়ে সুইডিশ একাডেমিতে হাজির হয়েছেন। মঞ্চ থেকে একজন উপস্থাপক একে একে সবার নাম ঘোষণা করে ডায়াসে এসে দাঁড়িয়ে কিছু বলার জন্য তাঁদের আহ্বান করছেন। ঝুড়িটা মাথায় নিয়ে তাঁরা ডায়াসে এসে দাঁড়াচ্ছেন। ধারাবাহিকভাবে প্রত্যেকে বলে যাচ্ছেন তাঁদের ঝুড়ি সম্পর্কে এবং ঝুড়ির ভেতরে কী কী সম্পদ আছে, দিয়ে যাচ্ছেন তার সবিস্তার বর্ণনা।
ভাষণগুলোর মধ্য দিয়ে একজন পাঠকের প্রজ্ঞা বহুমাত্রিকভাবে সমৃদ্ধ হয়। জ্ঞানের কত দিক থেকেই না তাঁরা আলো ফেলেন! পাবলো নেরুদা তাঁর নোবেল ভাষণে যেমন বলেন, ‘কবি ক্ষুদে ঈশ্বর নন। তিনি বিশ্ব বিধানের ভবিতব্য দ্বারা বিশেষ নির্বাচিত কেউ নন যে, তিনি অসংখ্য মানুষ―যাঁরা হাজার রকমের কাজ আর দায়িত্ব সামলাতে জের বার, তাঁদের চেয়ে উন্নততর কেউ নন। আমি প্রায়ই বলে থাকি যে, সর্বশ্রেষ্ঠ কবি তিনি, যিনি আমাদেরকে প্রত্যেক দিনের রুটি প্রতিদিন যোগান দিতে পারেন। প্রতিবেশী রুটির দোকানি, তিনি তো নিজেকে ঈশ্বর ভাবেন না। ওই রাজকীয় অথচ বিনয়াবনত কর্তব্য কর্মটি তিনি পালন করে যান―খামির তৈরি, তন্দুরের ভিতরে সেগুলো ঢুকানো, পুরো সেঁকে লালচে রং না-করা পর্যন্ত সেদিকে চোখ রাখা, সবশেষে তৈরি রুটি আমাদের হাতে পৌঁছানো―সামাজিক যৌথ কর্তব্য পালন। এরকম সহজ সরল বিবেক বোধের তাড়নায় কোনো কবি যদি আলোড়িত হন তো তিনি এক বিশাল শিল্পকর্ম যজ্ঞের অংশ হিসেবে নিজেকে দেখতে পাবেন।’
নেরুদার এমন উক্তি পড়ে সত্যি মনে হয়, একজন লেখকের কাজ শুধু লিখে যাওয়া নয়, লেখার পাশাপাশি তিনি পার্থিব কাজগুলো ও সম্পাদন করেন।লেখক কোনো ইউটোপিয়ায় বসবাস করেন না। লেখার জন্য জীবনের নৈমত্তিক কাজগুলো ত্যাগ করে তিনি ফকির-সন্ন্যাসী হয়ে যান না। স্বাভাবিক জীবন যাপনের মধ্য দিয়েই তিনি শিল্পের অমৃত রস সৃষ্টি করেন।
নোবেল ভাষণে কবি পাবলো নেরুদা তাঁর সেই অভিযাত্রার কথা বলেছেন।জন্মভূমি থেকে হাঁটতে হাঁটতে সেই নৈঃসঙ্গের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকা, সেই হরিৎ শুভ্র ও নিস্তব্ধতা, বৃক্ষরাজি, বিশালাকায় লতানো গাছপালা, নিচে পড়ে থাকা হাজার বছরের সঞ্চিত পত্র-পল্লবের পচানো সার, এসবের ভেতর দিয়ে তার যেতে থাকা... যেতে থাকা। হঠাৎ সামনে পথরোধ করে দাঁড়ানো মাজা উল্টে পড়া গাছ।
মহান কথাশিল্পী গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর ভাষণে দিয়েছেন জন্মভূমির নিদারুণ করুণ বর্ণনা। লাতিন আমেরিকান দুইকোটি শিশু মৃত্যুবরণ করে তাদের প্রথম জন্মদিনের আগেই, নির্যাতনের ফলে নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার, আটকাবস্থায় গর্ভবতী অসংখ্য নারী সন্তান জন্ম দেয় আর্জেন্টিনার কারাগারগুলোতে। অবস্থার আমূল পরিবর্তন চাওয়ার কারণে পুরো মহাদেশ জুড়ে হত্যা করা হয় দুই লক্ষাধিক নরনারীকে।
মিশরীয় কথাশিল্পী নাগিব মাহফুজের নোবেল ভাষণ ‘দুই সভ্যতা’ কিংবা ভিএস নাইপলের ‘দুই ভুবন’ পড়ার সময় মনে হয় যেন কোনো স্তোত্র পাঠ করছি, যেন কোনো মন্ত্র পাঠ করছি। এসব ভাষণ আত্মার গভীরে গিয়ে ধাক্কা মারে, আত্মাকে প্রশান্ত করে তোলে। কিংবা হ্যারল্ড পিন্টার তাঁর নোবেল ভাষণে যেমন বলেন, ‘একজন লেখকের জীবন খুব অরক্ষিত, প্রায় নগ্ন সব কর্মকাণ্ড। এ নিয়ে কর্মকাণ্ডের কিছু নেই। লেখক তার জীবন বেছে নেন আর তা নিয়েই তাকে থাকতে হয়।’ ওরহান পামুকের নোবেল ভাষণ ‘বাবার স্যুটকেস’ পড়তে পড়তে আমাদের বোধের ডালপালাগুলোর বিস্তার ঘটতে থাকে। যেন পৃথিবীর এককোণে বসে পৃথিবীর সবকটি ভূভাগ ঘুরে আসতে পারি ভাষণটি পড়ে। পামুক কী চমৎকার বলেছেন, ‘লেখালেখির কাজ হচ্ছে অন্তর্নিহিত দৃষ্টিকে শব্দে রূপ দেওয়া, বিশ্বকে নিরীক্ষণ করা, যেখানে ব্যক্তি নিজেকে নিজের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ধৈর্য ও উৎফুল্ল মনে কাজটি করা। একজন লেখকের গুপ্ত রহস্য অনুপ্রেরণা নয়, কোথা থেকে এর উদয় হয় সে ব্যাপারটি নিশ্চিত নয়, এটা তাঁর একগুঁয়েমি, তাঁর ধৈর্য। লেখক এমন একজন, যে বছরের পর বছর ধৈর্য ধরে তাঁর নিজের ভিতরের দ্বিতীয় সত্তা আবিষ্কারের চেষ্টায় থাকেন এবং সেই সত্তাই তাঁকে নিরূপণ করে সে আসলে কে?’
পেরুর কথাসাহিত্যিক মারিও বার্গাস ইয়োসা তাঁর নোবেল ভাষণে কী অসাধারণ বলেছেন, ‘উপন্যাস বিনোদনের চেয়েও বেশি, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার চেয়েও বেশি, যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা সংবেদনকে জাগায়, সমালোচক সত্তাকে সচেতন করে। আমাদের ভেতরের মানব সত্তার নবায়নের মাধ্যমে মানুষের শ্রেষ্ঠাংশটুকু সংরক্ষণ করে, সভ্যতা যাতে বহাল থাকে সেজন্য এ প্রক্রিয়াটির চরমভাবে প্রয়োজনীয়―যাতে আমরা আর নৈঃসঙ্গের বর্বরতায় ফিরে না যাই এবং জীবন যাতে প্রয়োগবাদী বিশেষজ্ঞের হাতে সংকুচিত না হয়―যারা বস্তুকে গভীরভাবে দেখে কিন্তু উপেক্ষা করে তার চারপাশ, তার অতীত এবং প্রবহমান ভবিষ্যত। ফলে মানুষের সেবায় যে যন্ত্র আবিষ্কার করি আমরা, আবার না সে যন্ত্রেরই ভৃত্য ও ক্রীতদাস হয়ে পড়ি। কারণ সাহিত্য ছাড়া পৃথিবী বাসনা কিংবা আদর্শহীন পৃথিবীতে পরিণত হবে, তা অশ্রদ্ধার পৃথিবী হয়ে যাবে; যা মানুষকে সত্যিকারের মানবিক গুণসম্পন্ন করে তা থেকে বঞ্চিত করবে; আমাদের স্বপ্নের মৃত্তিকা দিয়ে গড়া সত্তা নিজের ভেতর থেকে বের হয়ে অন্যের ভেতরে প্রবেশের অধিকার হারাবে।’
সম্প্রতি পড়লাম বিশ শতকের সর্বাগ্রগণ্য ইংরেজভাষী কবি সিমাস হিনির নোবেল ভাষণটি। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আমি এমন একটি দুর্গে ঢুকে পড়েছি যে দুর্গের দেওয়াল কথা দিয়ে তৈরি, ছাদ কথা দিয়ে তৈরি, বেলকনি কথা দিয়ে তৈরি, দরজা-জানালাগুলো ও মহান সব কথা দিয়ে তৈরি। ভাষণে সিমাস হিনি বলেছিলেন এক খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীর গল্প, যাঁর নাম সেন্ট কেভিন। এককালে সেন্ট কেভিন ক্রুশের চিহ্ন এঁকে দুই বাহু ছড়িয়ে দিয়ে পড়ে থাকতেন গ্লেন ডালাও নামক তীর্থস্থানে। তিনি যখন হাঁটু নোয়ায়ে দিতেন এবং প্রার্থনায় মগ্ন হয়ে যেতেন, তখন কালো পাখিরা ভুল করে তাঁর টানটান করা হাতদুটিকে গাছের ডালপালা মনে করত। সেখানে তারা বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ার প্রস্তুতি নিত। পাখিদের এই অবস্থা দেখে কেবিন দয়া প্রদর্শনের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, সপ্তাহের পর সপ্তাহ সেই ডিম নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সেই ডিম ফুটে বাচ্চা বের না হয় এবং সে বাচ্চাগুলো ডানা ঝাপটিয়ে উড়তে না শেখে।
সেন্ট কেভিনের এই গল্পটি নিঃসন্দেহে এক মহান গল্প। ধৈর্যের, প্রার্থনার, নিমগ্নতার এবং জীবের প্রতি দয়ার গল্প। এই গল্প মানুষের জন্য দিয়ে যায় এক মহান বাণী। নোবেল ভাষণে এই গল্পের উল্লেখ করে সেন্ট কেভিনকে সিমাস হিনি পরিচিত করে তুলেছেন গোটা বিশ্বের অগ্রসর মানুষদের কাছে।
চীনা গল্পকার ও ঔপন্যাসিক মোইয়ানের ভাষণটি পড়তে পড়তে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠছিল চোখ। তাঁর মা এবং শৈশব স্মৃতি দিয়ে ভাষণটি শুরু করেছিলেন মোইয়ান। ছোটবেলায় অত্যন্ত দরিদ্র ছিল তাঁর পরিবার। মায়ের সঙ্গে তিনি গমের মাঠ থেকে পরিত্যক্ত গমের শীষ সংগ্রহ করতেন। একদিন পাহারাদার তাদেরকে দেখে ফেলল। মা দৌড়ে পালাতে পারলেন না। পাহারাদার তাকে ধরে খুব শক্ত করে চড় মারল। মা মাটিতে পড়ে গেলেন। তার ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরছিল। এই ঘটনা মোইয়ানকে বড় ব্যথিত করেছিল। অনেক বছর পর এক বাজারে মোইয়ান সেই পাহারাদারকে দেখতে পেলেন। তার চুল-দাড়ি পেঁকে গেছে। মোইয়ান যাতে কোনো প্রতিশোধ না নেন সেজন্য তার মা তার হাত চেপে ধরলেন। বললেন, ‘পুত্র, যে লোকটা আমাকে মেরেছিল সেই লোকটা আর এখনকার এই বুড়ো লোকটা দুজন একই মানুষ না।’
কেমন ক্ষমাশীল ছিলেন মোইয়ানের মা! কী অসাধারণ ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব! ছেলেকে তিনি সেভাবেই গড়ে তুলে ছিলেন। মোইয়ানের ভাষ্য মতে, তিনি দেখতে খুব কুৎসিত হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। স্কুল সহপাঠীরা সেজন্য তাঁকে খুব খেপাতো। তাতে খুব মনখারাপ হতো তাঁর। একদিন এই কারণে ছেলের মনখারাপ দেখে মা বললেন, ‘শোনরে বেটা, তুই মোটেও কুৎসিত না। তোর একটি নাক আছে, দুটি চোখ আছে, হাত-পা সবই আছে। কোথাও কোনো সমস্যা নেই। তাহলে তুই কীভাবে কুৎসিত? তোর যদি ভালো একটা অন্তর থাকে আর সবসময় ঠিক কাজটি করিস, তাহলে এই কুৎসিতটাই একদিন সুন্দরে পাল্টে যাবে।’
মায়ের উপদেশ মেনে ছিলেন মোইয়ান। সব সময় ঠিক কাজটাই করেছিলেন। লেখালেখিতে ছিলেন নিবিষ্ট, দায়বদ্ধ। সেই দায়বদ্ধতা তাঁকে নিয়ে গেল বিশ্ব দরবারে, মহান কথাকার হিসেবে পরিচিত হলেন গোটাবিশ্বে, ভূষিত হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেলে।
নোবেল ভাষণগুলো পড়লে মনে প্রশান্তি আসে। ভেতরের নিভু নিভু প্রদীপটা জ্বলে ওঠে। প্রশান্ত মন বলে ওঠে, থেমে থাকা চলবে না, কাজ করতে হবে, প্রচুর কাজ করতে হবে। কাজের মধ্য দিয়ে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করতে হবে এই পৃথিবীতে।
স্বকৃত নোমান কথাসাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক। সাম্প্রতিক সময়ের ঔপন্যাসিক হিসেবে তিনি অন্যতম। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস : রাজনটী, বেগানা, হীরকডানা, কালকেউটের সুখ, শেষ জাহাজের আদমেরা, মায়ামুকুট। তিনি কথাসাহিত্যে একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি বাংলা একাডেমিতে কর্মরত।