বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তিন প্রচেষ্টা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন যুক্তরাষ্ট্র এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই এই স্নায়ু যুদ্ধের সূচনা হলেও ১৯৬০-এর দশকে তা তুঙ্গ পর্যায়ে উপনীত হয়। দু’পক্ষই নিজেদের প্রভাব বলয় রক্ষা ও বিস্তারের জন্যে বিভিন্ন ধরনের কৌশল অবলম্বন করে এবং তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করেও এই দুই দেশের মধ্যকার টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। এই সূত্রেই ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে উপস্থিত হয়, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দুই দফা ভেটো প্রয়োগ করে। ডিসেম্বরের এই ঘটনা প্রবাহের সূচনা হয় মার্চ মাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা কালেই। 

দুই পরাশক্তির অন্যতম যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তানের ‘অখণ্ডতা’ রক্ষার জন্যে পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে। এটা মোটেই বিস্ময়কর নয় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল কেননা এই দুই দেশের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূচনা ১৯৫০-এর দশকে। ১৯৫৪ সালে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রতিরক্ষা বিষয়ক দুটি আঞ্চলিক জোট-সিয়াটো (সাউথ ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন) এবং সেন্টো (সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশনে)-তে যোগ দেবার পর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ‘কমিউনিস্টদের প্রভাব’ মোকাবেলা যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকেই তার মিত্র বলে বিবেচনা করে এবং সব ধরনের সামরিক সাহায্য প্রদান করে। এতে করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পাকিস্তানে উপুর্যপুরি সেনাশাসন স্বত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ব্যাপারে কোন ধরনের আপত্তি করেনি। যুক্তরাষ্ট্র ভারত এবং পাকিস্তান উভয়কেই অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য করে আসছিল—ভারতের ক্ষেত্রে সামরিক সাহায্যের শুরু হয় ১৯৬৩ সালে আর পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ১৯৫৩ সাল থেকে। দুই দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক স্বত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের ঝোঁক যে পাকিস্তানের দিকেই ছিল সেটা বিভিন্নভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। 

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন সাংবাদিক জ্যাক এণ্ডারসন তাঁর কলামে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নিয়ে আলোচনা করার সময় যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে পাকিস্তানের প্রতি ‘ঝোঁক’ বা ‘টিল্ট’ বলে বর্ণনা করেন। সেই থেকে পাকিস্তানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে ‘টিল্ট পলিসি’ বলেই বলা হয়ে থাকে। এর কারণ এবং পটভূমি বিষয়ে বিভিন্ন গবেষক আলোচনা করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেন, ড্যানিস কুক্স, র‍্যামন্ড গার্থফ, উইলিয়াম বান্ডি, এবং যুশি হানহিমাকি। তাঁদের আলোচনায় মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে, কেউ কেউ দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির দিকে নজর দিয়েছেন। বাংলাদেশের উদ্ভবের সময়কার ভারত পাকিস্তানের কূটনৈতিক নীতিগুলো কী বিবেচনায় তৈরি হয়েছিল সেই বিষয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেন রিচার্ড সিসোন এবং লিও রোজ, ১৯৯০ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থে প্রধানতই ভারত এবং পাকিস্তানের দিকেই নজর দেয়া হয়, তবে প্রাসঙ্গিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাও আলোচিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আর্কাইভ এবং প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত বিভিন্ন দলিল সংগ্রহ করে সংকলন আকারে প্রকাশিত হতে শুরু করে ১৯৯৯ সালে। রোয়েদাদ খান ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ বিষয়ে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৩ সময়ের মার্কিন গোপন দলিলগুলো একত্রে সংকলন এবং তার ভাষ্য প্রকাশ করেন ১৯৯৯ সালে। এর এক বছর পরে এনায়তুর রহিম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় হোয়াইট হাউসের ভূমিকা কি ছিল সেই বিষয়ে দলিলপত্রগুলো সংকলন করেন। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর ১৯৬৯ সালে থেকে ১৯৭২ সালের সময়কার বিপুল পরিমাণ দলিল অবমুক্ত করে।১০ সেই থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ে আরও দলিল অবমুক্ত করা রয়েছে; ফলে এই বিষয়ে নতুন নতুন তথ্য সকলের জ্ঞাত হয়। এই প্রেক্ষাপটেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার প্রশ্ন নতুন করে ব্যাপকভাবে আলোচনারও সূচনা হয়। ২০১০ সালে বি জেড খসরু’র গ্রন্থ১১ একার্থে এই ধারাবাহিকতার ফল যদিও তা কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাই আলোকপাত করেনি। শ্রীনাথ রাঘাভান তাঁর ২০১৩ সালের গ্রন্থে আরও বিস্তৃত আকারে বৈশ্বিক রাজনীতির পটভূমিকায় বাংলাদেশের স্বাধীন যুদ্ধকে বিশ্লেষণ করেছেন।১২ তবে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের, বিশেষ করে হোয়াইট হাউস এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ভূমিকার অনুপুঙ্খ আলোচনা উপস্থাপিত হয় ২০১৩ সালে প্রকাশিত গ্যারি ব্যাসের গ্রন্থ ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’-এ।১৩ এই গ্রন্থে কেবল এটাই দেখানো হয়নি যে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল, উপরন্ত দেখানো হয়েছে কী করে নিক্সন এবং কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ মার্কিন নীতি রচনা করেছে, কী করে যুক্তরাষ্ট্র গণহত্যাকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং তার যৌক্তিকতা তৈরি করেছে।

১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কেবল যে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এবং তার ফলে কার্যত একটি গণহত্যায় শরিক হয়েছে তাই নয়, একই সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে নস্যাৎ কররার জন্যেও সক্রিয়ভাবে চেষ্টা চালিয়েছে। এই প্রবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের তিনটি প্রচেষ্টা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দলিল-দস্তাবেজে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে এই সব প্রচেষ্টার বিভিন্ন দিক এবং সেগুলোর পটভূমি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 

বাংলাদেশ আন্দোলন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি
১৯৭০ এর নির্বাচনের পর থেকেই অন্য অনেকের মতো মার্কিন প্রশাসনও বুঝতে সক্ষম হয় যে পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে বাঙালি জনগোষ্ঠীর নির্বাচিত প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের কোনো প্রকার সমঝোতাই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে এবং এর ফলে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া অবধারিত। পাকিস্তানের বিভাজন যে কেবল সময়ের ব্যাপার তা এমনকি ১ মার্চের আগেই মার্কিন প্রশাসন বুঝে গিয়েছিল। ১৯৭০ সালের ১৯ ডিসেম্বরের ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডি মেমোরেন্ডাম ১০৯,১৪ ২২ ফেব্রুয়ারির প্রেসিডেন্ট বরাবর কিসিঞ্জারের স্মারকলিপি এবং ২৩ ফেব্রুয়ারির প্রেসিডেন্ট বরাবর পররাষ্ট্র মন্ত্রী উইলিয়াম রজার্সের স্মারকলিপি১৫ — এসবকিছুই এই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের আসন্ন অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেবার পরে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দুজন স্টাফ হ্যারল্ড সণ্ডার্স এবং স্যামুয়েল হসকিনসন নিরাপত্তা কাউন্সিলার প্রধান প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের জন্যে একটি মেমো তৈরি করেন। তাতে এটাই বলা হয়েছিল যে, আজকে পাকিস্তানে ঘটনাবলি এমন দিকে মোড় নিয়েছে যাতে পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য স্বাধীনতা ঘোষণা আরও এগিয়ে এলো। ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৭০ এ ঢাকা থেকে কনসাল জেনারেল আর্চাল ব্লাড যে টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন তাতেও পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে সে ব্যাপারে স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল।১৬ এছাড়াও, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ বিরাজমান সাংবিধানিক অচলাবস্থা (constitutional deadlock) অবসানে মার্কিন সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন।১৭ সে সময়ে অন্তত কাগজে-কলমে হলেও মার্কিন প্রশাসন নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখেছিল।১৮

২৫ মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের অভিযান শুরু ক্ররার পরও মার্কিন প্রশাসন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ২৬ মার্চ কিসিঞ্জার ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশান গ্রুপ (WSAG)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন, ‘লাঞ্চের আগে প্রেসিডেন্টের সাথে আমার সংক্ষিপ্ত আলাপ হয়।... তিনি কোনো পদক্ষেপ নিতে রাজি নন।... কোনো সক্রিয় নীতিমালা গ্রহণের পক্ষপাতি তিনি নন।’১৯ এরকম একটি সংকটময় সময়ে স্থিতাবস্তা বজায় থাকা আর নৃশংসতাকে সমর্থন দেয়া কার্যত একই কথা। কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষে না থাকলেও প্রেসিডেন্ট নিক্সন ২৮ মার্চ কিসিঞ্জারের সঙ্গে এক টেলিফোন কথোপকথনের সময় বলেন, ‘আমরা কোনো নিন্দা প্রকাশ করব না।’২০ পাকিস্তানি বাহিনীর অভিযান শুরু হবার প্রায় মাসখানেক পর, ২৮ এপ্রিল, ১৯৭১, কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে কিসিঞ্জার পরিস্থিতির ব্যাপারে তাঁর মূল্যায়ন২১ ও নীতিমালা সম্পর্কিত প্রস্তাবনা তুলে ধরেন; ততদিনে পুরো ব্যাপারটিই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঢাকা থেকে হামলার বিবরণ দিয়ে কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড স্টেট ডিপার্টমেন্টকে একাধিক টেলিগ্রাম (টেলিগ্রাম ৯৫৯—২৮ মার্চ;২২ টেলিগ্রাম ৯৭৮—২৯ মার্চ;২৩ টেলিগ্রাম ৯৮৬—৩০ মার্চ২৪) পাঠিয়েছেন; ঢাকার কনস্যুলেট থেকে কুড়িজন কর্মকর্তার একটি পিটিশান ওয়াশিংটনে পৌছেছে এবং সেই আবেদনকে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বিষয়ক নয়জন বিশেষজ্ঞ সমর্থন করেছেন। তাঁদের মতামতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালার সমালোচনা করা হয়। কিসিঞ্জারের স্মারকলিপিটি লেখিয়েছিল এগুলো হাতে পেয়ে আলোচনা করবার পর।২৫ ইসলামাবাদে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডও ঘটনাগুলোর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আর্চার ব্লাড এর সাথে একমত হন। তিনি বলেন, “ইয়াহিয়ার স্বল্পমেয়াদি কর্মকাণ্ডই হয়তো দীর্ঘমেয়াদে তিনি যা ঠেকাতে  চাচ্ছেন অর্থাৎ পাকিস্তানের বিভাজনকেই অনিবার্য করে তুলছে।”২৬

সংকটের শুরু থেকেই মার্কিন প্রশাসন যেই নীতিমালা অনুসরণ করে আসছে কিসিঞ্জারের স্মারকলিপি যে শুধু তাকে সুস্পষ্ট করে তাই নয়, বরং মার্কিন প্রশাসন তাকে মূলনীতি হিসেবে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অথচ ২৬ মার্চ ওয়াশিংটন স্পেশাল এ্যাকশান গ্রুপ (WSAG)-এর বৈঠকে কিসিঞ্জার বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অনিবার্য বলেই স্বীকার করেছিলেন। সেই সময়ে তিনি তিনটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিলেন :

প্রথম প্রস্তাবটি হচ্ছে, কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের উপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যেকোনো রাজনৈতিক ও সামরিক অভিযানই চালাতে চাক তাতে সমর্থন দেয়া।
দ্বিতীয় প্রস্তাব হচ্ছে, সত্যিকারের নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা। 
তৃতীয় প্রস্তাবটি হলো, ইয়াহিয়াকে যুদ্ধ শেষ করতে ও এমন ব্যবস্থাগ্রহণে আন্তরিকভাবে সাহায্য করা যা কিনা পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পথে সাহায্য করে। 

প্রতিটি বিকল্প প্রস্তাবের ক্ষেত্রেই যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার কিসিঞ্জার সেগুলো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকার যাতে তৃতীয় প্রস্তাবটি গ্রহণ করে সে পরামর্শও দেন, কারণ—

তৃতীয় প্রস্তাবটির গ্রহণ করলে ইয়াহিয়ার সাথে সম্পর্কের সর্বোচ্চ ফায়দা নেয়া যাবে, একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের স্বার্থের ক্ষতির পরিমাণ যাতে কম হয় পরিস্থিতিকে সে দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আন্তরিক প্রয়াসও চালানো যাবে। আর এর অসুবিধাটি হচ্ছে, এর ফলে পরিস্থিতি এমন দিকে মোড় নিতে পারে যার ফলে একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দিকে অগ্রগতি স্থগিত হয়ে পড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পূর্ব-পাকিস্তানের ৬০০ মিলিয়ন জনগণের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। এবং রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগ স্বীকারে পশ্চিম-পাকিস্তানের সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য করতে অপারগ হয়ে পড়বে।

কিসিঞ্জারের ছয় পৃষ্ঠার এই ব্রিফিংয়ের উত্তরে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের হাতে লেখা ও স্বাক্ষরিত নোটটি মূল ব্রিফিংয়ের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছিল। ‘সকলের জন্যে’ (To All Hands), কথাটির উল্লেখসহ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছয়টি সহজ শব্দে অফিশিয়াল নীতিমালার সারসংক্ষেপ করেন : ‘Don’t squeeze Yahya at this time’ (এই সময়ে ইয়াহিয়ার ওপরে চাপ দিওনা); নিক্সন “Don’t” (দিওনা) কথাটির নিচে তিনবার আন্ডারলাইন করেন, যাতে করে তা কারোরই নজর না এড়িয়ে যায়।২৭  আর এভাবেই এপ্রিলের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন, বিশেষ করে হোয়াইট হাউজ বাংলাদেশ আন্দোলনের ব্যাপারে তাদের নীতিমালা প্রণয়ন করে। অর্থাৎ, একে সমর্থন না দেয়া; বিপরীতে দীর্ঘসময়ের বন্ধু পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়।

কিসিঞ্জারের স্মারকলিপির তারিখ অর্থাৎ ২৮ এপ্রিল আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এটি যেদিন লেখা হয় তার আগের দিন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা হিলালি চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের একটি বার্তা বহন করে নিয়ে আসেন, যেখানে “চৌ এন লাই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একজন গোপন রাষ্ট্রদূতকে গ্রহণ করতে চীনের আগ্রহের ব্যাপারে নিশ্চিত করেন।”২৮ পাকিস্তানকে যে শুধু বার্তাবহনের মাধ্যম হিসেবেই বেছে নেয়া হয় তাই নয়, বরং এই সাক্ষাতের ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা ও প্রক্রিয়ার আয়োজক হিসেবেও বেছে নেয়া হয়। যদিও মার্কিন প্রশাসনের জন্য পিকিং এর সাথে যোগাযোগ এর জন্য ইসলামাবাদই একমাত্র পথ ছিল না,২৯ কিন্তু গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের আদর্শ বর্জন করে পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়ার মূল কারণই হয়ে দাঁড়ায় তা যে সময়ে “আদর্শই সর্বোত্তম রাজনীতি হয়ে উঠতে পারতো”৩০  সে সময়ে হোয়াইট হাউজ তার মৌলিক আদর্শগুলো বিসর্জন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

রাজনৈতিক সমাধান
হোয়াইট হাউজ যে প্রস্তাবটি বেছে নিয়েছিল তা এই সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে ছিলো। এই প্রস্তাবের একটি অংশ ছিল ‘পাকিস্তানের ভৌগোলিক অখণ্ডতা’ বজায় রাখাকে মূল বিবেচনা হিসেবে নেয়া। এপ্রিলের শুরুর দিকেই জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল (এনএসসি)র একটি সভাতে ‘দুই পক্ষের সাথে একই সাথে কাজ করার’ সম্ভাবনাকে বাতিল করে দেয়া হয়।৩১ আর এই সিদ্ধান্ত  কলকাতায় ‘প্রবাসী বাংলাদেশি সরকার’-এর অস্তিত্বকে স্বীকার করা বা এর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো যোগাযোগ রাখার সম্ভাবনার পথ রুদ্ধ করে দেয়। গ্রীষ্মের মধ্যেই এই নীতির অকার্যকারিতা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কূটনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা হোয়াইট হাউজ, বিশেষ করে কিসিঞ্জারকে, সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে পরিস্থিতির বদল ঘটতে থাকে দ্রুতই, যুদ্ধরত গেরিলারা আমলে নেয়ার মতো একটি শক্তিতে পরিণত হওয়ার ফলেই অবস্থার বদল ঘটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর অবাস্তব কল্পনা নয়, বরং অবশ্যম্ভাবী বাস্তবতায় পরিণত হয়। নিজ দেশে ও দেশের বাইরে কড়া সমালোচনার মুখে হোয়াইট হাউজ এই অগ্রগতি ঠেকানোর উপায় ভাবতে থাকে, এবং সংঘাতকে দীর্ঘায়িত করার একাধিক প্রচেষ্টা চালায়। উদ্দেশ্য ছিল ইয়াহিয়া খানকে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ করে দেয়া। এই প্রচেষ্টাগুলোর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ আন্দোলনের মাঝে ফাঁটল তৈরি করা। এই প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যে তিনটি প্রচেষ্টা ছিল গুরুত্বপূর্ণ, এগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার রয়েছে। এই প্রচেষ্টাগুলো হচ্ছে : কলকাতার যোগাযোগ, ইসলামাবাদ আলোচনা, এবং তেহরান উদ্যোগ।

১. কলকাতায় যোগাযোগ 
কিসিঞ্জারের বিবরণ অনুসারে, কলকাতার যোগাযোগ বা ‘কোলকাতা কন্টাক্টস’ এর সূত্রপাত হয় ৩০ জুলাই বেশ ছোট আকারে; আওয়ামী লীগের নির্বাচিত একজন সদস্য, কাজী জহিরুল কাইয়ুম প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করেন আলোচনা শুরু করার জন্য। “এর ফলে রাজনৈতিক সমঝোতার তিন মাসব্যাপী একটি ব্যর্থ প্রয়াস শুরু হয়।” কিসিঞ্জার জোর দিয়ে বলেন, “এর থেকে একটি সমাধান আসতে পারত যদি ভারত ও বাঙালিরা চাইতো।”৩২ প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যুক্ত সেই সময়কার কয়েকজন নেতা দাবি করেছেন যে প্রাথমিক যোগাযোগ শুরু হয়েছিল জুনের শেষদিকে। ধারণা করা হয় যে, কাইয়ুম নয় বরং যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসই প্রথম উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগের কয়েকজনের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় ৬ জুলাই শিলিগুড়িতে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রথম বৈঠকের পরপরই গ্রিফিন ও অন্যান্যরা কাইয়ুমের সাথে যোগাযোগ করে ভেতরের খবর জানার জন্য। এই যোগাযোগগুলো থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে যুক্তরাষ্ট্র তার আনুষ্ঠানিক নীতিমালা অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার এবং যুক্তরাষ্ট্রের তাতে নাক গলানোর কোনো ইচ্ছা নেই—তা থেকে সরে এসেছে। এটাও উল্লেখযোগ্য যে, এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধির সাথে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকৃতি জানান। ১৩ এপ্রিল ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের একজন প্রতিনিধি বৈঠকের জন্য কলকাতায় মার্কিন কনস্যুলেটে যোগাযোগ করেন। ওই প্রতিনিধি ইঙ্গিত প্রদান করেন যে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাতে আগ্রহী। ব্রিটিশ কর্মকর্তারা তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে সাক্ষাৎ করলেও, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের দূতাবাসকে নির্দেশ দেয় এমন অনুরোধ গ্রহণ না করার জন্য।৩৩ কিন্তু তারপরও, জুলাইয়ের শেষদিকে মার্কিন দূতাবাস একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে, যার নির্ভরযোগ্যতাও তখনো ওইভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তাঁকে গ্রহণ করে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার জন্য হোয়াইট হাউজের অনুমোদনও ছিল। আর এর কারণ অবশ্যই নীতিগত কোনো পরিবর্তন ছিল না, বরং এর পেছনের কারণ স্পষ্টতই ছিল পাকিস্তানি শাসকদের স্বার্থে কালক্ষেপণ। কিসিঞ্জার যিনি বিশ্বাস করতেন যে, ইয়াহিয়া খানকে “কলকাতায় অবস্থিত আওয়ামী লীগারদের সাথে সমঝোতা করতে বলার মানে হচ্ছে আব্রাহাম লিঙ্কনকে জেফারসন ডেভিসের সাথে সমঝোতা করতে বলা।”৩৪ তিনি স্বয়ং এই যোগাযোগের ব্যাপারে সবুজ সংকেত প্রদান করেন এবং জোসেফ ফারল্যান্ডকে অগ্রগতি সম্পর্কে অবগতও রাখতে বলেন। দলিলপত্র থেকে জানা যায় যে, উল্লেখিত তিন মাসে কাজি জহিরুল কাইয়ুম ও দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা জর্জ গ্রিফিন এর মধ্যে অন্তত ১৩টি বৈঠক সংঘটিত হয়। কাইয়ুমের অনুরোধ ছিল এই যোগাযোগগুলোকে বেশ সতর্কতার সাথে পরিচালনা করার জন্য। তিনি এও জোর দিয়ে বলেছিলেন যে আওয়ামী নেতৃত্বের একটি বড় অংশই এই সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান চাচ্ছিলেন এবং তাঁরা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি থেকে পিছিয়ে আসার জন্যও প্রস্তুত ছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধির সাথে অব্যাহত যোগাযোগ সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে খুব কমই অগ্রগতি প্রদর্শন করে, কিন্ত তা চূড়ান্ত গোপনীয়তার সাথেই বজায় রাখা হয়। এতটাই গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল যে নয়াদিল্লির রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিংও তা জানতেন না। কৌতূহলজনকভাবে কিটিং ও দিল্লি দূতাবাসকে অন্ধকারে রাখার প্রস্তাবটা এসেছিল ইসলামাবাদের রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ডের কাছ থেকে। 

সম্ভবত এই গোপন যোগাযোগের সর্বোচ্চ পর্যায় ছিল ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমেদ ও মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তার মধ্যকার ৯০ মিনিটের একটি বৈঠক। বৈঠক চলাকালীন সময়ে মোশতাক আহমেদ নিজেকে ‘কমিউনিস্টবিরোধী নিবেদিতপ্রাণ’ হিসেবে বর্ণনা করেন। প্রবাসী সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে নিজের অসন্তোষও প্রকাশ করেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র ‘পুরাতন ও ভালো এক বন্ধু’ ছিল তা তিনি মনে করিয়ে দিয়ে বলেন যে, ‘আমরা আপনাদের কাঁধে ভর করতে চাই।’৩৫ কাইয়ুমের সাথে একাধিক বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে এবং দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলামের সাথে একটি বৈঠক আয়োজন করার জন্য কাইয়ুমকে জোর দেন। কিন্তু দূতাবাস বুঝতে পারে যে নজরুল ইসলাম মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাতে আগ্রহী নয়। একটি সরাসরি আমন্ত্রণও প্রত্যাখ্যান করা হয়।৩৬

পরবর্তী মাসে, কলকাতার যোগাযোগ ব্যবহার করে কোনোপ্রকার ‘রাজনৈতিক সমাধান’-এর সম্ভাবনা বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদকে এসব গোপন যোগাযোগের বিষয়ে অবহিত করা হয়। ১২ অক্টোবর কলকাতায় বাংলাদেশের হাই কমিশনার হোসেন আলী এবং গ্রিফিন-এর মাঝে একটি বৈঠকে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ওই বৈঠকে হোসেন আলী যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়ার কাছে বাংলাদেশের ‘ইচ্ছাগুলোকে’ পৌঁছে দেয়নি বলে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এছাড়াও তিনি ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনার উপযোগিতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেন। ইয়াহিয়া কেন মুজিবের সাথে বৈঠকে বসছেন না সে ব্যাপারেও তিনি প্রশ্ন তোলেন।৩৭

২৪ অক্টোবর এই যোগাযোগগুলোর সংবাদ জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়। কলকাতার প্রায় সবগুলো সংবাদপত্র লন্ডন থেকে পাঠানো এসোসিয়েটেড প্রেসের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে ‘এশিয়ার কূটনৈতিক সুত্রগুলোর’ বরাত দিয়ে বলা হয়, ‘পাকিস্তান সরকার ও বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সাথে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেছে।’ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে অস্বীকৃতি জানানো হয়। এরই প্রেক্ষিতে, ২৮ অক্টোবর একটি টেলিগ্রামের মাধ্যমে কলকাতার দূতাবাস থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানানো হয় যে, ‘কলকাতার যোগাযোগের ক্ষেত্রে যে পর্যায় ও যতদূর পর্যন্ত পৌঁছানো গিয়েছে তা শেষ অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, ফলে নতুন কৌশল কাম্য।স্টেট ডিপার্টমেন্টকে পাঠানো টেলিগ্রামে বলা হয়, 

আমরা সমঝোতা-আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্দোলনে নিজের অবস্থানকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে প্রস্তুত বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধির মধ্যে এমন কোনো লক্ষণ বা আশা দেখি না। কাইয়ুমের মূল উদ্যোগের পেছনে যেই কারণ ও ব্যক্তিগত বিষয়ই থাকুক না কেন, জুলাই থেকে পরিস্থিতি যে দিকে মোড় নিয়েছে সেগুলো (যেমন: মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধি, ভারত সরকার ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যকার টানোপোড়েন অথবা বাংলাদেশের মধ্যে বামপন্থীদের চাপ বৃদ্ধি) বাংলাদেশ সরকারের যেকোনো নেতার পদক্ষেপ নেবার সুযোগ সীমিত করে তুলেছে। এখানে আমরা যে পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি, আলোচনা যদি করতেই হয়, তবে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ভর করছে ইয়াহিয়ার ওপরই।৩৮

এই যোগাযোগগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি পরবর্তীদিনে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যখন কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা রিপোর্ট করে যে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি সকল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় সংসদের সদস্যদের নির্দেশ দেয়, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিদেশি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিশেষ করে আমেরিকান প্রতিনিধিদের সঙ্গে’ কোনো প্রকার আলোচনা থেকে বিরত থাকতে। এই রকম হুঁশিয়ারি দেয়া হয় যে এই নির্দেশ অমান্য করা হলে সদস্যদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর দণ্ডমূলক ব্যবস্থা’ গ্রহণ করা হবে। কমিটির সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে এই ঘোষণাও ছিল যে, দলটি ‘স্বাধীনতা ব্যতীত অন্য কোনো বন্দোবস্তে’ রাজি হবে না। ‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এখন পরিবর্তন আনার কোনো প্রয়োজন নেই’ এই কথাগুলো দিয়ে নেতৃত্ব নিয়ে চাপা অসন্তোষ মোকাবেলা করা হয়।

কাইয়ুম অবশ্য দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে এবং অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করার জন্যনভেম্বর মাসে গ্রিফিনের সঙ্গে তিনবার দেখাও করে। কাইয়ুম অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্বে থাকা ভারতীয় কর্মকর্তা ডিপি ধর এক উত্তেজিত আলোচনার সময় মুশতাক আহমেদকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি মার্কিন প্রশাসনকে শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার আবেদন করেন (এমনকি যদি শেখ মুজিবের গতিবিধি পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেও তা করা হয়)। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন মধ্যপন্থীরা বামপন্থী, রাশিয়ান কমিউনিস্ট ও সোভিয়েত সমর্থকদের চাপের মুখে পড়ছে এবং ‘শেখ মুজিবকে ছাড়া আমরা এই চাপের মুখে বেশিদিন টিকতে পারব না।’৩৯

২. ইসলামাবাদ আলোচনা
কলকাতার যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ আরেকটি উপায় খুঁজে বের করা হয় অক্টোবরের শেষদিকে। আওয়ামী লীগের যেসব সদস্য পাকিস্তানে রয়ে গিয়েছিলেন এবং পাকিস্তানি সরকার আগস্টের ৭ তারিখ যাদেরকে ‘নিষ্কৃতি’ দিয়েছিল, তারা এই পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘নিষ্কৃতির’ তালিকায় ৮৮টি নাম ছিল। জুলাইয়ের শেষদিকে এই কৌশলের ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণ শুরু হয়। আগেও যেমন বলা হয়েছে সিনিয়র রিভিউ গ্রুপ-এর ২৩ জুলাইয়ের বৈঠকে ‘রাজনৈতিক সমাধান’ আলোচনার একটি প্রধান বিষয়ে পরিণত হয় এবং একাধিক বিকল্প প্রস্তাব বিবেচনা করা হয়। কিসিঞ্জার কৌতূকপূর্ণভাবে মন্তব্য করেন যে ‘ইয়াহিয়া ও তার দল কখনোই উচ্চ আইকিউ বা তাদের রাজনৈতিক বোঝাপড়ার সূক্ষ্মতার জন্য পুরস্কার পাবে না’ এবং তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘এমন কোনো কর্মসূচি কি সম্ভব যাতে শরণার্থী সমস্যাকে আলাদা রেখে রাজনৈতিক সমঝোতার পথ সুগম থাকবে?’ তিনি এও বলেন যে, ‘পাকিস্তানিদের নিজে থেকে এটা করার মতো কোনো রাজনৈতিক কল্পনাশক্তি নেই।’৪০ দক্ষিণ এশিয়া ও নিকট প্রাচ্য বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট জোসেফ সিসকো জোর দিয়ে বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রেরই ‘ইয়াহিয়াকে আওয়ামী লীগের দিকে ঠেলে দিতে হবে।’ সিসকো শেখ মুজিবের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে এও বলেন, ‘সে যাতে মুজিবের বিচার না করে সেজন্যও আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে।’ ঠিক সে মুর্হূতেই আন্ডার সেক্রেটারি ফর স্টেট জন আরউইন পাকিস্তানে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে চুক্তি করার একটি বিকল্প প্রস্তাব পেশ করেন। আরউইন প্রশ্ন রাখেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে আর কোনো আওয়ামী লীগার কি আছে যাদের সাথে ইয়াহিয়া কোনো চু্ক্তিতে আসতে পারে?’ তারপর তিনি প্রস্তাব রাখেন, ‘ভালো হতো যদি পূর্ব পাকিস্তানে এখনো সম্মানিত এমন কয়েকজন আওয়ামী লীগারকে সে খুঁজে বের করতে পারত, যাদের সঙ্গে সে [ইয়াহিয়া] একটা চুক্তিতে আসতে পারে।’৪১

এই আলোচনার সাতদিনের মাথায়ই ‘নিষ্কৃতদের’ তালিকা ঘোষণা করা হয়। এটি কেবল কাকতালীয় নাকি কোনো সূত্র থেকে পাকিস্তানকে এই বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল তা জানা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দলিলে এই বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। ‘নিষ্কৃত’ সদস্যদের সকলেই যদিও তখন পাকিস্তানে ছিল না, এবং সকলে এই ঘোষণার সুবিধাও নিতে রাজি হয়নি। যারা শনাক্ত হয়েছিল এবং সেনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল তাদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছিল। নিষ্কৃত ও ‘নিরাপত্তাপ্রাপ্ত’ সদস্যদের একজন নুরুল ইসলাম। যাকে শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের মাঝে আলাপের মধ্যস্থতাকারী হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। প্রস্তাবটি ঢাকায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভাককে প্রদান করা হয়। তিনি মাসখানেক আগেই আর্চার ব্লাডের বদলে সেখানে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নুরুল ইসলাম ও আরেকজন সদস্য, এসবি জামানকে এই কাজের জন্যে দাঁড় করায় ঢাকা কনসুলেট ও ইসলামাবাদ দূতাবাস।  ইসলামাবাদ দূতাবাসের মাধ্যমে বৈঠকটির সময়সূচি ঠিক করা হয়৪২ এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে এই বৈঠক সম্পর্কে জানিয়ে রাখা হয়। ১৭ নভেম্বরের প্রেসিডেন্টের বৃহস্পতিবারের ব্রিফিংয়ে এই বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যেখানে এই গোষ্ঠিটিকে ‘নিস্তেজ আওয়ামী লীগার’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। নভেম্বরের ২২ তারিখ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও এই দুই আওয়ামী লীগ নেতার মধ্যে একটি বৈঠিক সংঘটিত হয়। নভেম্বরের ২৪ তারিখ ইসলামাবাদ দূতাবাসের টেলিগ্রামে যে বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়, সেখানে দেখা যায় যে নুরুল ইসলাম ও জামান চার-দফা সমাধান প্রস্তাব করেছেন। নুরুল ইসলাম ও জামানের চার-দফা প্রস্তাব আশ্চর্যজনকভাবে কাইয়ুমের প্রস্তাবগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। কেউ-ই অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তি এবং মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে সরাসরি আলোচনার ওপর জোর দেননি। তার বদলে, ইসলাম-জামান জুটি প্রস্তাব করেন যে, তারা মুজিবের সঙ্গে কথা বলে তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে আরও আলোচনা করতে কলকাতা যাবেন।৪৩ যদিও এগুলো গোড়া থেকেই  অকার্যকর প্রস্তাব ছিল এবং এর মাধ্যমে সংকটের কোনো সমাধান হবে সে ব্যাপারেও তেমন কোনো আশা ছিল না। ইয়াহিয়া খানেরও ধারণাগুলো শোনার বাইরে অধিক কিছু করার মানসিকতা ছিল না। তদুপরি, নভেম্বরের মধ্যেই প্রেক্ষাপট নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায়—কলকাতার যোগাযোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, যারা এই ধরনের যোগাযোগের পক্ষে ছিলেন ভারতী নীতি নির্ধারকরা তাঁদের ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন, আওয়ামী লীগের মধ্যকার অন্তর্কোন্দলও থিতিয়ে আসতে থাকে এবং রণাঙ্গনে  মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে।

৩. তেহরান উদ্যোগ
৩০ জুলাই সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের সভায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি বৈঠকের আয়োজন করার প্রচেষ্টা দেখা যায়। যাকে তেহরান উদ্যোগ বলা হয়। জুলাইয়ের ২৩ তারিখের আরেকটি বৈঠকে যখন এই সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তার ওপর একাধিক সদস্য জোর দেন, তখন সে বৈঠকের ধারাবাহিকতায়ই এই বৈঠকটি হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সম্ভাব্য ত্রাণ কার্যক্রমের প্রসঙ্গে এটিও উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী খুব সামান্যই বিস্তৃত। তাদের নিদারুণ পরিবহন সংকট আছে।’ সিআইএর রিচার্ড হেলমস ধারণাটি প্রদান করে বলেন, ‘কেউ কি ইরানের শাহকে পাকিস্তানের সাথে কাজে জড়ানোর কথা ভেবেছে? তিনি আমাদের কাজে আসতে পারেন; অন্ততপক্ষে বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। বিশেষত যখন পাকিস্তানের জন্য আমাদের রসদ ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে’৪৪ তাৎক্ষণিকভাবেই হেলমস-এর যুক্তি বিরোধিতা করে কিসিঞ্জার বলেন, ‘ইয়াহিয়াকে ঘিরে আমাদের রসদ ফুরিয়ে যায়নি’, তবে কিসিঞ্জার ইরানের শাহকে জড়িত করার পরিকল্পনার বিরোধিতা করেননি। পরিকল্পনা ছিল কয়েকজন নির্বাসিত আওয়ামী লীগ নেতা এবং পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের মধ্যে তেহরানে একটি বৈঠকের আয়োজন করা। এই প্রস্তাবটির তেমন কোন অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয় না। যদিও শাহ এ জাতীয় গোপন বৈঠক আয়োজনের ব্যাপারে রাজি ছিলেন, কিন্ত পাকিস্তান ও বাংলাদেশি পক্ষের তরফ থেকে প্রস্তাবটি তেমন একটা সমর্থন পায়নি। রিচার্ড সিসন ও লিও রোজ এই উদ্যোগের উৎসের ব্যাপারে একটি ভিন্ন বয়ান হাজির করেন। পাকিস্তানের একটি সূত্রের ভিত্তিতে তাদের বিবরণে দাবি করা হয় যে উদ্যোগটি ছিল পাকিস্তান সরকারের। সিসন ও রোজ লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালে ইয়াইয়ার ঘনিষ্ঠ এক পাকিস্তানি সূত্রমতে, ইয়াহিয়া মুজিবকে যুক্ত করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা/দেনদরবারে প্রস্তুত ছিলেন এবং এমনকি তার সেপ্টেম্বরের তেহরান সফরকালে ইরানের শাহকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের আলোচনায় সহায়তা করার জন্য বলেছিলেন।’৪৫

‘শিগগিরই ভারতে নির্বাসিত নেতাদের কাছে এই বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়।’৪৬ কলকাতার যোগাযোগ কাইয়ূম এই পদক্ষেপের কথা জানতে পেরে কনস্যুলেট কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন, কলকাতা কনস্যুলেট স্টেট ডিপার্টমেন্টকে ২৮ আগস্ট একটি টেলিগ্রাম রিপোর্টে এমনটি জানিয়েছিল। উদ্যোগটির ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু না জানা গেলেও নিশ্চিতভাবেই অক্টোবর পর্যন্ত এর সম্ভাবনা টিকে ছিল। সেক্রেটারি আলেকসিস জনসনের ইসলামাবাদ দূতাবাসে পাঠানো ৮ অক্টোবরের টেলিগ্রামে তেহরান উদ্যোগের উল্লেখ ছিল এবং যেখানে রাজনৈতিক সমঝোতা অর্জনের জন্য ইরানের শাহের সমর্থন চাওয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রদূতের প্রতি নির্দেশ ছিল।৪৭ কিন্তু রেজা শাহ ইতোমধ্যেই উল্লেখ করে ফেলেছেন যে রাজনৈতিক সমাধানই পাকিস্তানের জন্য একমাত্র পথ। অক্টোবরের শুরুর দিকে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক বৈঠকে রেজা শাহ ইয়াহিয়া খানকে ‘রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর জন্য বেশ চাপ দিয়েছিলেন।’ ভ্যান হোলেন অক্টোবরের ৭ তারিখ ডব্লিউএসজিতে খবর পাঠান যে ‘শাহ ইয়াহিয়াকে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর তাগিদ দিয়ে, খোলাখুলিভাবেই বলেন যে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে সমাধানের তেমন একটা সম্ভাবনা নেই এবং তাকে রাজনৈতিক সমঝোতায় যাওয়ার আহ্বান জানান।’৪৮ জনসনের মতে, ইয়াহিয়া পর্যন্ত এই বার্তা নিয়ে আসারটা একটা ‘ইতিবাচক অগ্রগতি’ ছিল। পরবর্তী ঘটনাবলী, বিশেষত হঠাৎ কলকাতার প্রচেষ্টার ধ্বস, এই উদ্যোগর সম্ভাবনা কমিয়ে আনে বলেই প্রতীয়মান হয়।

‘উদ্যোগের’ লক্ষ্যসমূহ
এই উদ্যোগগুলো, বিশেষত শেষের দুটি, স্পষ্টতই খুব সামান্য এবং খুব দেরিতে নেয়া হয়েছিলো। কিন্ত এই প্রশ্ন করাই যায় যে, এই উদ্যোগগুলোর কি ফলাফল আশা করা হচ্ছিলো? যদি কিসিঞ্জারের ১৯৭৯-এর বিবরণ আমরা বিবেচনায় নেই, তাহলে এসমস্ত উদ্যোগের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানে একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা, শেখ মুজিবের মুক্তি নিশ্চিত করা, স্বল্প মেয়াদে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা এবং ‘কয়েক মাসের মধ্যে’ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা।৪৯ কিন্তু যদি আমরা কিসিঞ্জারের একাত্তরের বিবরণটি আমলে নিই, ‘রাজনৈতিক বিবর্তন আনতে যে সময়ের দরকার… তা শরণার্থীদের চাপ সামাল দেয়ার ভারত সরকারের সক্ষমতার চেয়ে দীর্ঘতর হতে পারে।’৫০ ঘটনাবলী অনুসরণের পর যে কেউ কিসিঞ্জারের একাত্তরের বিবরণের সঙ্গে একমত হবেন এবং সিমোর হার্শের সঙ্গে একমত পোষণ করবেন যে, ‘এই পর্যায়ে, কেবল নিক্সন ও কিসিঞ্জারেরই বিশ্বাস ছিল যে ইয়াহিয়া খান এবং বাঙালির মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির কোনো সম্ভাবনা আছে। শরৎকাল নাগাদ [আগস্ট থেকে যে সময়ের শুরু] আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা কার্যক্রমের পাশাপাশি তাদের দাবিও আরও বর্ধিত করেছিল এবং বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার ব্যতিত অন্য কোনো আলোচনা আর সম্ভব ছিল না।’৫১

কিসিঞ্জারের ১৯৭৯-এর বিবরণে এই রকম ধারণা দেয়া হয় যে, যুক্তরাষ্ট্র একটি সমাধান প্যাকেজ হাতে নিয়েছিল এবং পাকিস্তানসহ বিবদমান পক্ষগুলোকে চাপ দিতে প্রস্তুত ছিল। তবে ফিলিপ ওল্ডেনবার্গ, যিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, তিনি লিখেছেন, ‘সাক্ষাৎকার প্রদানকারী বেশ কয়েকজন একমত হয়েছিলেন যে একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত “রাজনৈতিক সমাধান” এর জন্যে পাকিস্তানের উপর চাপ দেয়া হয়নি, তা ছাড়া এ সমাধানটি কী ছিল সেটাও কেউ বলতে পারেনি। সত্যিই যদি এমন কোনও প্যাকেজ থেকে থাকে তবে তা হোয়াইট হাউসের তৈরি করা, এটি অবশ্যই স্টেট ডিপার্টমেন্টে উপস্থাপন করা হয়নি।’৫২

পাকিস্তানের দিক থেকে কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া না পাওয়ায় কলকাতার যোগাযোগগুলো থেকে কোনো সমঝোতার দিকে এগুবার লক্ষণ ছিল না। কিসিঞ্জারের নিজস্ব স্বীকারোক্তি এই দাবিকে সমর্থন করে। ১৯৭১-এর ৭ ডিসেম্বর, কংগ্রেসের প্রশ্নের জবাবে কিসিঞ্জার বলেছিলেন যে আলোচনার সূচনা কখনো হয়নি, বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো ‘বিষয়বস্তু’ নির্ধারণের সঙ্গে জড়িত ছিল না।৫৩ এছাড়াও, প্রেসিডেন্ট নিক্সন ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২-এ কংগ্রেসে তার পাঠানো বার্তায় স্বীকার করেছিলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করে বলতে পারে না যে তার প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করতো কিংবা এ জাতীয় সমঝোতার ফলে কোনো নিষ্পত্তি হত।’

যুক্তরাষ্ট্রের যদি কোনো সমাধানের দিকে যাওয়ার ইচ্ছা থাকত, তবে ভারতের অন্যান্য চ্যানেলগুলো ব্যবহার করা হতো। বরঞ্চ উল্টোটাই করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রসচিব মাহবুব আলম আগস্টে যোগাযোগ করলেও দিল্লিতে অবস্থিত রাষ্ট্রদূত কেটিংকে কোনো বাংলাদেশি কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, মাহবুব আলম ছিলেন কাইয়ুম ও মোশতাক আহমদের দলের লোক।

তাই এটা বলাই যায় যে, এই উদ্যোগগুলো ছিল সংকটের ইতিবাচক সমাধান তৈরির জন্যে ‘অকার্যকর মহড়া’৫৪ মাত্র। কিন্ত এই সব উদ্যোগ তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার পক্ষে কাজ করেছিল। কলকাতার এই গোপন উদ্যোগ এর সবচেয়ে সুস্পষ্ট উদাহরণ।
আওয়ামী লীগ যেহেতু প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই বিভিন্ন বিস্তৃত সামাজিক অংশকে প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা করেছিল, তাই সংগঠনের মধ্যে বিভাজন সবসময়ই বিদ্যমান ছিল। ২৫ মার্চ সেনা অভিযান শুরুর আগের ও পরবর্তী ঘটনাবলী দলটির বিভাজনকে আরও শক্তিশালী করে এবং দলাদলির সহায়ক কিছু নতুন উপাদানকে সামনে এনেছিল। ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের মধ্যে কমপক্ষে তিনটি উপদল ছিল : প্রথমত কট্টরপন্থী; দ্বিতীয়ত উদারপন্থী; এবং তৃতীয়ত রক্ষণশীল।

তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে দলের উদারপন্থী অংশ এপ্রিলের শুরুতে সরকার গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছিল। ৩ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এক বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমেদ তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের চাপে মুজিবের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ তার সহকর্মীদের অবস্থান সম্পর্কে জানতেন না এবং একরকম অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে কোনো প্রকার পরামর্শ ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পাঁচদিন পর কলকাতায় যখন তাজউদ্দীন আহমদ দলটির নেতৃবৃন্দের একটি ক্ষুদ্র অংশকে একত্র করেছিলেন, তখন এটাই দলের মধ্যে প্রথম বিরোধের বিষয় হয়ে ওঠে। কট্টরপন্থী এবং রক্ষণশীল উভয় অংশই তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে ওঠে। ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ এবং আরও কয়েকজন নেতা রক্ষণশীল অংশের প্রবীণ নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে দেখা করলে মোশতাক তাজউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে দলের প্রবীণ সদস্য হিসেবে তাঁর শীর্ষ পদটি নেওয়া উচিত। তিনি সেই সময়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সারা জীবনের জন্য দেশ ছেড়ে মক্কায় যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছিলেন।

১৭ এপ্রিল স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং মন্ত্রিপরিষদ গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সংঘাতটি হ্রাস পায় কিন্তু বিলীন হয়ে যায়নি।৫৫ ১৯৭১ সালের ৫-৬ জুলাই জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগ সদস্যদের ভারতের আগরতলার শিলিগুড়িতে বৈঠকের সময় আবারও মতবিরোধ দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত ৩০০ জন প্রতিনিধির উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক যে একটি হৈ হট্টগোলে পরিণত হয়েছিল সেই বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই তা স্মরণ করে থাকেন। বৈঠকটিকে দলের মধ্যকার বিভিন্ন গোষ্ঠী শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেন, এবং মোশতাক আহমেদসহ বিপুল সংখ্যক অংশগ্রহণকারী নেতৃত্বের বিষয়ে, বিশেষত ভারতীয় কর্তৃপক্ষের জোরালো সমর্থন আদায়ে প্রধানমন্ত্রীর অক্ষমতায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কয়েকজন বলেছিলেন যে দেশে ফিরে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা বা সমঝোতা করাই শ্রেয়। এই মতামত যুক্তরাষ্ট্রের কলকাতা কনসুলেটের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছিল।  

৯ আগস্ট ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষর একটি স্পষ্ট সংকেত প্রদান করেছিল যে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা এমন পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন যেখানে পাকিস্তান এবং/অথবা চীন আক্রমণ করলে তারা বন্ধুহীন অবস্থায় থাকবে না। উদারপন্থীরা এই অগ্রগতিকে স্বাগত জানালেও এটি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরস্থ রক্ষণশীলদের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ অস্বস্তির জন্ম দিয়েছিল। তারা এটিকে ইন্দো-সোভিয়েত পক্ষের শক্তি সঞ্চয় হিসেবে দেখে। তাঁরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল যে এটি সরকারের অভ্যন্তরে উদারপন্থীদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে এবং রক্ষণশীলদের পরিকল্পনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাদের আশঙ্কা আরও তীব্র হয়েছিল যখন মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রমকে শক্তিশালী করতে অবিলম্বে মস্কোপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্যদের নিয়ে সমন্বিত একটি জাতীয় জোট গঠনের জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাগিদ দেয়।৫৬ রক্ষণশীলদের পক্ষে এই ধরনের পদক্ষেপের বিরোধিতা করা বেশ কঠিন ছিল।৫৭ কিন্তু একটা আবেগময় পরিস্থিতির আবির্ভাব ঘটে যা রক্ষণশীলদের বহুল প্রত্যাশিত সরকার-বিরোধী অবস্থান নেয়ার সুযোগ দিয়েছিল, তা হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষা। 

ইন্দো-সোভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার একদিন পরই পাকিস্তানের সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর অভিযোগে শেখ মুজিবের গোপন বিচার শুরু করে।৫৮ বিচারের রায় ছিল পূর্ব নির্ধারিত। বিশেষত ২ মার্চ এবং ২৮ জুন ইয়াহিয়ার দেয়া ভাষণ এবং ৫ আগস্টের মন্তব্যের পরে; তিনি বলেছিলেন যে, মুজিবকে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ ‘শাস্তি’ দেওয়া হবে।৫৯ বিভিন্ন দেশ শেখ মুজিবের জীবন রক্ষা করার জন্য পাকিস্তানের কাছে আবেদন করেছিল, কিন্তু ১১ আগস্ট এসআরজি বৈঠকে প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্টেট ডিপার্টমেন্টকে ‘নিরপেক্ষ’ থাকতে বলেন। যদিও ফারল্যান্ড ইয়াহিয়াকে মার্কিন ‘পরামর্শ’ জানিয়েছিলেন, ‘মুজিবকে গুলি করা তাঁর ঠিক হবে না।’৬০ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মধ্যে মোশতাক-গোষ্ঠী জোর দিয়ে বলতে শুরু করেছিল যে মুজিবের জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায় হলো সরাসরি পাকিস্তান সরকারের সাথে আলোচনা করা। তাঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে এটি ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ অথবা ‘শেখ মুজিবের জীবন’-এর মধ্যে একটিকে বেছে নেয়ার মতো অবস্থা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক অবস্থান ছিল যে, স্বাধীনতা ব্যতিত যেকোনো কিছুই মুজিবের জীবনকে বিপন্ন করে তুলবে। 

শেখ মুজিব ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ড কেবল এই উদ্দেশ্যকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা নয়, নেতৃত্বকেও বহুধা বিভক্ত করে দেবে, এই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে মুজিবের জীবন বাঁচানোর আহ্বানের আবেদন তৈরি করতে সক্ষম ছিল। মোশতাক-গোষ্ঠী অভিযোগ তুলেছিল যে তাজউদ্দীন গোষ্ঠী মুজিবের জীবন বাঁচানোর বিরুদ্ধে, কারণ তারা ক্ষমতায় থাকতে চায়। এটি ভারতে যারা আশ্রয় নিয়েছিল এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাঁদের মধ্য আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং শেখ মুজিবের প্রতি নিজেদের উৎসর্গীকৃত সমর্থকদের একটি গুরুতর দ্বিধায় ফেলে দিতে সক্ষম হয়। 

এই পর্যায়ে মোশতাক গোষ্ঠী দলত্যাগের একটি বিস্তৃত পরিকল্পনা এঁটেছিল। পরিকল্পনাটি ছিল মুজিবের জীবন বাঁচানোর অজুহাতে তাঁরা সরকারের নীতি বিসর্জন দিয়ে পাকিস্তানে ফিরে যাবে। এর জন্য নির্বাচিত মুহূর্তটি ছিল একাত্তরের অক্টোবর এবং স্থানটি হবে জাতিসংঘ। প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মোশতাক আহমেদ বাংলাদেশের ঘটনাটি উপস্থাপনের জন্য জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কে থাকবেন বলে আশা করা হয়েছিল। পরিকল্পনাটি ছিল পাকিস্তানের প্রশাসনের সঙ্গে স্বাধীনতা ব্যতিত ভিন্ন এক আপসরফা ঘোষণা করা এবং এইভাবে বাংলাদেশ আন্দোলনকে সম্পূর্ণ বিলোপ না করা গেলেও, মারাত্মকভাবে ক্ষতি করা। 

বলার অপেক্ষা রাখে না, নিক্সন হোয়াইট হাউজের ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ প্রকল্পের সঙ্গে এই পরিকল্পনা খুব সুন্দর মিলে গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের গোপন যোগাযোগ থেকে সরকারের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতে, মোশতাক গোষ্ঠী তাজউদ্দীন প্রশাসনের সমালোচনা করার জন্য একাধিক আঞ্চলিক বৈঠকের আয়োজন করে।৬১ এই পদক্ষেপটি আওয়ামী নেতৃত্বের মধ্যকার বিভাজনকে প্রকাশ্য করে তোলে। ২০ সেপ্টেম্বর কলকাতার কনসুলেট জেনারেল ওয়াশিংটনে পাঠানো টেলিগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজনের ব্যাপারে রিপোর্ট করেন।৬২ সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎ করা হবে কি হবে না সেটাই কেবল বিবেচ্য বিষয় সঙ্গে না, মুশতাক গোষ্ঠীর এই প্রকাশ্য বিদ্রোহের ব্যাপারটি কীভাবে মোকাবিলা করা যায় সেটাও বিবেচনায় ছিল। ৫ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবের চলমান বিচার পুনরায় শুরু হওয়ার খবর এবং তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার গুজব বাংলাদেশ সরকারের জন্য পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল করে তোলে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজন এবং ষড়যন্ত্র বিষয়ক উল্লেখিত বিবরণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একটি অংশ এবং হোয়াইট হাউজের মধ্যে স্বার্থের অভিন্নতা ছিল। সেক্রেটারি অফ স্টেট-এর তরফ থেকে পাকিস্তান দূতাবাসে পাঠানো ৩১ আগস্টের টেলিগ্রামে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ‘“স্বাধীনতা বনাম সমঝোতা” নিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনের মধ্যে (মুক্তিবাহিনীসহ) সংকটপূর্ণ বিভাজনের গতিবিধি’ সম্পর্কেও মন্তব্য করতে বলা হয়।৬৩ এটা প্রমাণ করে যে, মার্কিন প্রশাসন আশা করছিল যে এই বিভাজনটি ফলপ্রসূ হবে। এই বিবেচনায় কলকাতা উদ্যোগটি শেষপর্যন্ত আর ‘অকার্যকর মহড়া’ হয়েই ছিল না। এটি যুক্তরাষ্ট্রের  স্বার্থের অনুকূলে কিছুটা অবদান রেখে গিয়েছিল, তবে তা বাঙালির দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে পারেনি।

উপসংহার
এই আলোচনাটি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশীয় সংকটের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি কেবল পাকিস্তানের প্রতি বহুল আলোচিত ‘পক্ষপাত’ নীতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে তাদের সক্রিয় অবস্থান ছিল, যদিও এই নীতির মূল স্থপতি কিসিঞ্জার নিশ্চিত ছিলেন যে, ‘র্পূব পাকিস্তান শেষমেষ স্বাধীন হবেই।’৬৪ এই বিরোধিতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার জন্য নাকি ইয়াহিয়া খানকে পাকিস্তান রক্ষার সুযোগ দেওয়ার জন্য কালক্ষেপণ করার লক্ষ্যে, সেই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর দিতে সক্ষম কেবল যারা এই প্রক্রিয়াতে নিযুক্ত ছিলেন তারাই।

তবে এ যাবৎকালে অবমুক্ত মার্কিন নথি এবং বাস্তবতা আমাদের এই উপলব্ধিতে উপনীত করে যে এই প্রচেষ্টাগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দুর্বল করতে শুরু করেছিল এবং প্রক্রিয়াগুলো দীর্ঘকাল অব্যাহত থাকলে এই আন্দোলনের জন্যে মারাত্মক ক্ষতি বয়ে আনতে পারত। অন্যদিকে, এই প্রচেষ্টাগুলো ইয়াহিয়ার মধ্যে এই মনোভাব তৈরি করেছিল যে মার্কিন প্রশাসন তাকে উদ্ধার করতে এসেছে এবং সঙ্কটের সমাধান কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল। ইয়াহিয়ার মানসিকতা প্রাক্তন তথ্যমন্ত্রী এবং ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জিডব্লিউ চৌধুরির মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, ‘নিক্সন যদি তাকে মিথ্যা আশ্বাস না দিতেন তবে তিনি আরও বাস্তববাদী হতে পারতেন।’ চৌধুরী উল্লেখ করেছিলেন যে মার্চ মাসে সামরিক পদক্ষেপ—যা গণহত্যার সূচনা করেছিল—সেই সিদ্ধান্ত ইয়াহিয়ার নিজস্ব ছিল, ‘তবে আশা করা হয়েছিল যে তিনি বোকার মতো কিছু করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে সেখান থেকে মুক্ত করে আনবে।’৬৫ ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ প্রচেষ্টাকে ইসলামাবাদের অনুকূলে উদ্ধার প্রকল্প হিসেবে দেখা হয়েছিল, তাদের সামরিক অভিযানের লাগাম টানার দরকার ছিল না। ফলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নৃশংসতা চালিয়ে গেছে—আরও মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে। ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’ হিসেবে বর্ণিত মার্কিন গোপন তৎপরতা, রক্তপাত থামানোর পরিবর্তে রক্তপাত চালিয়ে যাওয়ায় ভূমিকা রেখেছে।

পাদটীকা
১.     জ্যাক এন্ডারসন মার্কিন সরকারের গোপন নথি সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে এই বিষয়ে আলোচনা করেন। তাঁর এই সব লেখা একত্রে পরে প্রকাশিত হয়েছে এণ্ডারসন পেপারস নামে। Jack Anderson, The Anderson Papers, (New York, Random House. 1973).  
২.     Christopher Van Hollen, “The Tilt Policy revisited: Nixon-Kissinger geopolitics and South Asia’, Asian Survey, Apr., 1980, Vol. 20, No. 4 (Apr., 1980), পৃষ্ঠা 339-361. 
৩.     Dennis Kux, The United States and Pakistan, 1947–2000: Disenchanted Allies (Washington DC, Woodrow Wilson Center, 2001).
৪.     Raymond Garthoff. Détente and Confrontation: American-Soviet Relations from Nixon to Reagan rev. edn (Washington DC, Brookings Institution Press, 1994).
৫.     William Bundy. A Tangled Web: The Making of Foreign Policy in the Nixon Presidency (New York, Hill & Wang, 1998).
৬.     Jussi Hanhimaki. The Flawed Architect, Henry Kissinger and American Foreign Policy (Oxford, Oxford University Press, 2004)
৭.     Richard Sisson, R., and Leo E Rose, War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh (Berkeley, University of California Press, 1990).
৮.     Roedad Khan. The American Papers: Secret and Confidential India-Pakistan-Bangladesh Documents, 1965-1973 (Karachi, Oxford University Press, 1999). 
৯.     Enayetur Rahim, The Bangladesh Liberation War and the Nixon White House 1971,(Dhaka,  Pustaka, 2000).
১০.     United States Department of State (USDS), Foreign Relations of the United States. 1969 –1976,VolumeXI. South Asia Crisis 1971, সম্পাদক L. J. Smith (Washington,The Department of State, 2005).
১১.     B Z Khasru. Myths and Facts Bangladesh Liberation War: How India, US, China, and the USSR Shaped the Outcome (Delhi, Rupa & Co, 2010).
১২.     Srinath Raghavan, 1971: A Global History of the Creation of Bangladesh (Harvard, MA, Harvard University Press, 2013).
১৩.     Garry Bass. The Blood Telegram: Nixon, Kissinger, and a Forgotten Genocide (New York, Knoff, 2013).
১৪.     Nixon Presidential Materials, National Archives, NSC Files, Box 365, Subject Files, NationalSecurity Study Memoranda, Nos. 104–206. Secret.
১৫.     Nixon Presidential Materials, National Archives, NSC Files, Box 624, Country Files, MiddleEast, Pakistan,Vol. III, 1 Oct 70–28 Feb 71. Secret; Exdis.
১৬.     Telegram 373, from Dhaka Consulate to State Department, National Archives, RG 59, CentralFiles 1970–73, SOC 10 PAK. Confidential.
১৭.     Telegram 540 from Dhaka Consulate to State Department, February 28, 1971, National Archives,RG 59, Central Files 1970–73, POL PAK–US. Confidential; Priority; Limdis. Telegram 697 fromDhaka Consulate to State Department, March 10, 1971. National Archives, RG 59, Central Files1970–73, POL PAK. Secret; Immediate; Exdis. 
১৮.     নিকট প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক তৎকালীন ডেপুটি এসিস্টেন্ট সেক্রেটারি অফ স্টেট ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেন জোর দিয়ে বলেছেন যে, নিক্সন প্রশানসের ‘পক্ষপাত’ নীতি ২৫ মার্চের আগে থেকেই ছিল। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, ৬ মার্চে সিনিয়র রিভিউ গ্রুপ মিটিংয়ে কিসিঞ্জার নিক্সন ও ইয়াহিয়ার মধ্যকার ‘বিশেষ সম্পর্ক’-এর ব্যাপারে মন্তব্য করেন (Van  Hollen,  ‘Tilt  Policy’,  টিকা ২ ). ১৯৬৭ সালে ফরেন অ্যাফেয়ার্সে নিক্সনের লেখা নিবন্ধ থেকে নিক্সনের পাকিস্তানপন্থী অবস্থান টের পাওয়া যায়। ‘এশিয়া আফটার ভিয়েতনাম’ শিরোনামের নিবন্ধটিতে পাকিস্তানকে বর্ণনা করা হয় ‘ভারতের অধিকতর সফল প্রতিবেশি’ হিসেবে। দায়িত্বপ্রাপ্তির পর থেকেই তিনি ভারতকে ‘একইসাথে চ্যালেঞ্জিং ও হতাশাজনক’ একটি বৃহৎ দেশ হিসেবে দেখে আসছেন। (Nixon উদ্ধৃত  T. P. Thornten, “US-India relations during the Nixon and Ford years”, The Hope and The Reality: US-Indian Relations from Roosevelt to Reagan, সম্পাদক H. E Gould and S. Ganguly (Boulder CO, Westview, 1992), পৃষ্ঠা ৯৩-৯৪. নিক্সন ও ইয়াহিয়ার মধ্যকার ‘ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব’ গাঢ় হয় ১৯৬৯ সালে যখন নিক্সন চতুর্থবারের মতো এবং সম্ভবত সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য পাকিস্তান সফরে যান এবং চীনের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য ইয়াহিয়ার সাহায্য প্রার্থনা করেন।
১৯.     Nixon Presidential Materials, National Archives, NSC Files, NSC Institutional Files (H-Files),Box H-115,WSAG Minutes, Originals, 1971 
২০.    United States Department of State (USDS), Foreign Relations of the United States. 1969 –1976,VolumeXI. South Asia Crisis 1971, সম্পাদক L. J. Smith (Washington,The Department of State, 2005). পৃষ্ঠা ৩৪, ফুটনোট ২.
২১.     পরিস্থিতি নিয়ে কিসিঞ্জারের মূল্যায়ণ থেকে বাইরের শক্তিগুলো যেমন-ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার সম্ভাব্য ভূমিকার বর্ণনা পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন: ‘ভারত হয়ে ওঠবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ (বাইরের শক্তিগুলোর মধ্যে)। অপেক্ষাকৃত ছোট একটি বাঙালি বিদ্রোহী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসজ্জিত করে ভারত সক্রিয় প্রতিরোধকে জিইয়ে রাখতে সাহায্য করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে। ভারত যে এদিকেই অগ্রসর হতে চাচ্ছে তার সমস্ত লক্ষণই স্পষ্ট। বাঙালি সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করে পূর্ব-পাকিস্তানে রাজনৈতিক রদবদলের মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো ইয়াহিয়ার জন্য কঠিন হয়ে পড়তে পারে ভারতের কারণে। তাদেরকে এ ব্যাপারে খুবই সচেতন মনে হচ্ছে। উক্ত অঞ্চলের বাইরের শক্তিগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে: 
(ক)     পশ্চিম পাকিস্তানে এখনো আমাদের প্রভাব বজায় রয়েছে এবং ভারতের কাছেও আমরা গুরুত্বপূর্ণ। 
(খ)     মার্কিন অর্থনৈতিক সহায়তা—যা কিনা বিশ্বব্যাংকের সাহায্য দাতা সংঘে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের মাধ্যমে অনেকগুণ বর্ধিত হয়েছে—পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য তা এখনো গুরুত্বপূর্ণ। মস্কো বা পিকিং কেউ-ই এই সাহায্যের বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে না। 
(গ)     তুলনামূলকভাবে কম হলেও এবং যুদ্ধের ফলাফলে কোনোরূপ প্রভাব বিস্তার করার মতো না হলেও আমাদের সামরিক সরবরাহ আমাদের অবস্থানের ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী উপাদান। ইউএসএসআর [সোভিয়েত ইউনিয়ন] উদ্বিগ্ন যে এই অস্থিতিশীলতা চীনের পক্ষে সুফল বয়ে আনবে, এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে তাদের অধিকতর ঝোঁক দেখা গেছে উপমহাদেশের বিবাদগুলো মিটানোয় সাহায্য করার ক্ষেত্রে। সাময়িকভাবে, সোভিয়েতের স্বার্থ আমাদের নিজেদের স্বার্থের সাথেই খাপ খাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, যদিও আবশ্যিকভাবেই তারা এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করতে চাইবে ভারতে আমাদের অবস্থানকে নড়বড়ে করে দিতে। কমিউনিস্ট চীন (ক) ভারতকে বিবিধ সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে হুমকি প্রদান করে পশ্চিম পাকিস্তানের মূল মিত্র হয়ে উঠতে পারে এবং (খ) শেষপর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরোধ আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ নিতে ভারতের সাথে প্রতিযোগিতায়ও নেমে যেতে পারে। আপাতত, মনে হচ্ছে চীন পশ্চিম পাকিস্তানের সাথেই তাদের জোট বেঁধেছে। দেখুন, National Archives, Nixon Presidential Materials, NSC Files, Box 625, Country Files, Middle East,Pakistan,Vol. IV, 1 Mar 71 – 15 May 71. Secret. Sent for action; এ ছাড়াও দেখুন,United States Department of State (USDS), Foreign Relations of the United States. 1969 –1976,VolumeXI. South Asia Crisis 1971, ed. L. J. Smith (Washington,The Department of State, 2005). পৃষ্ঠা ৯৪-৯৮।
২২.     National Archives, RG 59, Central Files 1970–73, POL 23–9 PAK. Confidential; Immediate;Exdis.
২৩.     National Archives, RG 59, Central Files 1970–73, POL 23–9 PAK. Confidential; Priority.
২৪.     পূর্বোক্ত
২৫.     Telegram 1138 from Dhaka Consulate April 6, 1971, National Archives, RG 59, Central Files1970–73, POL 1 PAK-US. Confidential; Priority. Response from the Department State–Telegram 58039, April 7, 1971, National Archives, RG 59, Central Files 1970 –73, POL 27 INDIA–PAK.Secret; Immediate; Nodis. Reaction from Dhaka Consulate,Telegram 1249, National Archives, RG 59, Central Files 1970–73, POL 27 INDIA–PAK. Secret; Priority; Nodis.
২৬.     Telegram 3164, from US Embassy in Islamabad, April 6, 1971, National Archives, RG 59, Central Files 1970–73, POL PAK-US. Secret; Immediate; Nodis
২৭.     দেখুন, ‘The Tilt: The U.S. and the South Asian Crisis of 1971, National Security Archive Electronic Briefing Book No. 79, সম্পাদক Sajit Gandhi, ১৬ ডিসেম্বর ২০০২, http://www.gwu.edu/~nsarchiv/NSAEBB/NSAEBB79/.
২৮. Dennis Kux, The United States and Pakistan, 1947–2000: Disenchanted Allies (Washington DC, Woodrow Wilson Center, 2001). পৃষ্ঠা ১৮৮।
২৯.     ১৯৭০ এর শেষদিকে এবং ১৯৭১ এর শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্র রোমানিয়ার মাধ্যমে বার্তা আদানপ্রদান করেছে। দেখুন : Seymour M. Hersh, The Price of Power: Kissinger in the Nixon White House (New York, Summit Books. 1983), পৃষ্ঠা ৪৪৮-৪৯। 
৩০.     Telegram 4494, from New Delhi Embassy to State Department, March 29 entitled ‘Selective Genocide,’ Record Group 59, Subject Numeric File 1970–73, Pol and Def Box 2530.
৩১.     United States Department of State (USDS), Foreign Relations  পৃষ্ঠা ৬৩।
৩২.     Henry Kissinger. White House Years (Boston, Little, Brown and Company, 1979); পৃষ্ঠা ৮৬৯. এই যোগাযোগের অস্তিত্ব প্রকাশ করে জ্যাক এন্ডারসন ১৯৭৩ সালে। দেখুন: The Anderson Papers (NewYork, Random House, 1973). 
৩৩.     United States Department of State (USDS), Foreign Relations of the United States. 1969 –1976,VolumeXI. South Asia Crisis 1971, সম্পাদক L. J. Smith (Washington, The Department of State, 2005). পৃষ্ঠা ৭৬। ফুটনোট ২।
৩৪.     সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের মিটিং, আগস্ট ১১, ১৯৭১, দেখুন : USDS, Foreign Relations, পৃষ্ঠা. ৩২৭। 
৩৫.     Telegram 2575, September 28, 1971, from Calcutta Consulate to State Department. National Archives, RG 59. Central Files 1970–73, POL 27 INDIA-PAK, Secret, Nodis.
৩৬.     Telegram 2648, October 14, 1971, from Calcutta Consulate to State Department, National Archives, RG 59. Central Files 1970–73, POL 27 INDIA-PAK, Secret, Nodis.
৩৭.     পুর্বোক্ত
৩৮.     Telegram 2713, October 28, 1971, from Calcutta Consulate to State Department. National Archives, RG 59. Central Files 1970–73, POL 27 INDIA-PAK, Secret, Nodis.
৩৯.     কলকাতা কনস্যুলেট থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানো গোপন টেলিগ্রাম নভেম্বর ২২, ১৯৭১। 
৪০.     USDS, Foreign Relations, পৃষ্ঠা. ২৭৪.
৪১.     পূর্বোক্ত, পৃ. ২৭৫।
৪২.     Telegram 10927 from Islamabad Embassy to State Department, November 2, 1971, National Archives, RG 59, Central Files 1970 – 73, POL 23 – 9 PAK. Telegram 10964 from Islamabad Embassy to State Department, November 3, 1971, National Archives, RG 59, Central Files 1970–73, POL 29 PAK.
৪৩. Telegram from Islamabad Embassy to State Department, November 24, 1971, National Archives, RG 59. Central Files 1970–73, POL 29 PAK, Secret.
৪৪.     USDS, Foreign Relations, পৃষ্ঠা ২৯৩.
৪৫.     Richards Sisson and Leo. E. Rose. War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh (Berkeley, University of California Press, 1990), পৃষ্ঠা ৩১৬, ফুটনোট ৬৩।
৪৬.     ১৯৭১ সালে কলকাতায় অবস্থান করা একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা ও সাংবাদিক ১৯৯৫ সালে নেয়া সাক্ষাৎকারে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তাদের বেশিরভাগই যদিও একে ‘গুজব’ বলেছেন। দুজন প্রথিতযশা  আওয়ামী লীগ নেতা মন্তব্য করেছেন এই বলে যে তারা এমন সম্ভাবনা নাকচ করছেন কারণ তারা মনে করেন ইরান এমন কিছু করবে না যাতে পাকিস্তান মনক্ষুণ্ন হয়।
৪৭.     USDS, Foreign Relations, পৃষ্ঠা ৪৪৯।
৪৮.     ঐ, পৃষ্ঠা. ৪৪০।
৪৯.     Kissinger, White House Years, পৃষ্ঠা. ৮৮০.
৫০.     Congressional Record, ডিসেম্বর ৯, ১৯৭১, পৃ. এস২১০১৫
৫১.     Hersh, Price of Power, পৃষ্ঠা ৪৫৬.
৫২.     Philip Oldenberg. “The Breakup of Pakistan”, The Regional Imperative: The Administrationof US Foreign Policy Towards South Asian States Under Presidents Johnson and Nixon, সম্পাদক L. I. Rudolph andS. H Rudolph (New Jersey, Humanities Press Inc, 1980), p. 161.
৫৩.     পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা. ১৫৮।
৫৪.     পূর্বোক্ত,
৫৫.     মন্ত্রীসভার গঠন থেকে উদারপন্থী ও রক্ষণশীলদের মধ্যে একটি সমঝোতার আভাস পাওয়া যায়। নজরুল ইসলাম, রক্ষণশীল মনোভাবের একজন নেতা ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হন, যেখানে তাজউদ্দীন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকেন। তারপরও, মে মাস জুড়ে প্রবল টানাপোড়েন চলতে থাকে। ছোট ছোট বিভিন্ন গোষ্ঠী তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার পথ খুঁজতে থাকে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রেসিডেন্টের হাতে এবং তার অবর্তমানে ভাইস প্রেসিডেন্টর হাতে মন্ত্রীদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করার ক্ষমতা প্রদান করা হয়। একাধিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নজরুল ইসলামের কাছে যান এই বিষয়ে তার ক্ষমতার প্রয়োগ করার জন্য। 
৫৬.     পরামর্শক কমিটি নামে এই মর্মে একটি কমিটি গঠন করা হয় সেপ্টেম্বরের শুরুতে। দীর্ঘ আলোচনা ও ডিপি ধর এর অনুরোধে মন্ত্রীপরিষদ ৯ সেপ্টেম্বর এই পদক্ষেপের অনুমোদন দেয়। চূড়ান্ত আকারে এই কিমিটি যদিও খুব সীমিত ক্ষমতার মালিক ছিল, এবং ভারতীয় সরকার প্রাথমিকভাবে যা আশা করেছিল তা হয়ে উঠতে পারেনি। এই পদক্ষেপ প্রশাসন ও প্রশাসনের বাইরে ভারতীয় রক্ষণশীলদেরও বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। ‘ন্যাশনাল কোঅর্ডিনেশান কমিটি ফর বাংলাদেশ মুভমেন্ট’-এর প্রধান সমর গুহ অভিযোগ করেন যে ডিপি ধর এবং পররাষ্ট্র সচিব টিএন কাউল বাংলাদেশ সরকারকে ন্যাশনাল লিবারেশান ফ্রন্ট গঠন করতে চাপ দিয়ে আসছে। তিনি একে ‘দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেন (The Statesman, September 8, 1971)।  
৫৭.     অন্যান্যদের মধ্যে নজরুল ইসলাম ও মোশতাক আহমেদ পরামর্শক কমিটি গঠনের বিরোধিতা করেন। মোশতাক আহমেদ যদিও অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসেবে তার সম্ভাব্য নিউইয়র্ক সফরের জন্য নিজের সমর্থন পাল্টে ফেলেন।
৫৮.     “Yahya schedules a secret trial of separatist chief tomorrow,” NewYork Times, August 10, 1971.
৫৯.     উদাহরণস্বরূপ যেমন, ইয়াহিয়া ২৬ মার্চে তার বক্তৃতায় বলেন, মুজিব ‘এদেশের সংহতি ও ঐক্যে আঘাত করেছে – এই অপরাধের সাজা তাকে পেতেই হবে।’
৬০.     USDS, Foreign Relations, পৃষ্ঠা ৩২৭. 
৬১.     উদাহরণস্বরূপ, সেপ্টেম্বরের ১২ তারিখ, মোশতাক ও শেখ ফজলুল হক মনি গ্রুপের অধীনে দক্ষিণের প্রশাসনিক অঞ্চলের চল্লিশজন নির্বাচিত প্রতিনিধি সাক্ষাৎ করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ে আবেদন করবেন যাতে তাজউদ্দীন আহমেদকে দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্য উভয় পদ থেকেই পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। সেপ্টেম্বরে দুইজন প্রথম সারির আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামান ও ইউসূফ আলীর নেতৃত্বে আরেকটি দল দেশের উত্তরাঞ্জলের মুক্তিযোদ্ধাদের উপর নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেন। তারা এমনকি কলকাতার বাইরে কার্যক্রম পরিচালনাকারী কিছু চীনপন্থী, বাম রাজনৈতিক দলের সাথেও যোগাযোগ করেছিল।
৬২.     Telegram 2527 from Calcutta Consulate to State Department, September 20, 1971, NationalArchives, RG 59, Central Files, 1970–73, POL 27 INDIA-PAK, Secret.
৬৩.     USDS, Foreign Relations, পৃষ্ঠা ৩৭১. 
৬৪.     পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৬।
৬৫.     G. W. Choudhury, “Reflections on Sino-Pakistan Relations,” Pacific Community, 7 (2), 1976, পৃষ্ঠা. 248–70.


আলী রীয়াজ অধ্যাপক এবং প্রাবন্ধিক, যুক্তরাষ্ট্র।

menu
menu