মায়া এঞ্জেলো : নারীর কণ্ঠস্বর

আধুনিক সাহিত্যে মায়া এঞ্জেলো এক পরিচিত নাম। আধুনিক মহিলা কবিদের মধ্যে সিলভিয়া প্লাতের পর মায়া এঞ্জেলোর নাম উচ্চারিত হয়। তবে সিলভিয়া প্লাতের মধ্যে নানা সংকট ও শংসয় ছিল ব্যক্তি জীবনের টানা পোড়নে। কিন্তু মায়া এঞ্জেলোর শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি চিহ্নিত করেছেন নারী সমাজের পিছিয়ে থাকার কারণসমূহ। তার লেখনিতে নারীরা যে পুরুষতান্ত্রিকতার কারণেই অবহেলিত বা নির্যাতিত হচ্ছেন তাই নয়। নারীরা পুঁজিবাদ, ঔপনিবেশিক মনোভাব, বর্ণবাদ বৈষম্য ও ব্যক্তিস্বার্থবাদের কারণে কখনো গিনিপিগ কখনো ভোগপণ্য, আবার কখনো বিনিময়যোগ্য পণ্যে পরিণত হয়। 

তিনি আমেরিকান কৃষ্ণ নারী কবি, গল্পকার, আত্মজীবনীকার, নাট্যকর্মী, সমাজ সংস্কারক, নৃত্য শিল্পী, চলচ্চিত্র পরিচালক ও আন্দোলন কর্মী। তিনি ৪ এপ্রিল ১৯২৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং ২৮ মে ১৯১৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সাবলীল মতাদর্শ ও পরিশীলিত রাজনৈতিক চিন্তার জন্য অন্যদের চেয়ে ভিন্ন হয়ে উঠেন। তিনি অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথা লিখেছেন। তাঁর খ্যাতি আসে আই নো হোয়াই দ্যা কেইজড বার্ড সিঙস শীর্ষক আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের মাধ্যমে। তিনি একজন শিক্ষক ছিলেন। তাঁর কর্মস্থল ছিল ফরেস্ট ইউনিভার্সিটি। তাঁর জীবনকে মূল্যায়ন করে বলেন, ‘আমি সাধারণ মানুষ, তাই মানুষের জীবনের ভালো-মন্দ সবই জড়িয়ে আছে আমার মাঝে।’

বিশ্বে ধর্ষণ, বর্ণবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মূল শিকার কেন নারীরা এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলসমূহে সাদা মানুষ কর্তৃক নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদ ও দৃঢ় উচ্চারণের জন্য সবার কাছে প্রশংসিত হয়ে উঠেন। অসংখ্য পুরস্কারের মাঝে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ‘জাস্ট গিভ মি অ্যা কুল ডিস্ক অফ ওয়াটার ফর আই ডাই’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘পুলিৎজার’-র জন্য নির্বাচিত হন। অন্যান্য পুরস্কারের মাঝে ‘ন্যাশনাল মেডেল অফ আর্টস’ এবং ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম’ও লাভ করেন। 

গায়িকা হিসাবেও তাঁর খ্যাতি ছিল অনন্য পর্যায়ে। তাঁর গায়কী ঢং সবার চেয়ে আলাদা হবার পরও ‘গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড’ পাননি কেবল মাত্র গানের মাধ্যমে সমাজের প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়ার কারণে। কিন্তু গায়িকা হিসাবে না পেলেও কবিতার জন্য ১৯৯৩ সালে সে পুরস্কার লাভ করেন যখন বিল ক্লিনটনের সমাবেশে তাঁর ‘পালস অফ মর্নিং’ কবিতা আবৃত্তি করেন। তবে ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘দ্যা গিফট আউটরাইট’ কবিতা আবৃত্তি করে ‘রবার্ট ফ্রস্ট’ পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। 

ঘানার বিশিষ্ট সাহিত্যিক ম্যাকলম এক্স তার ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। বন্ধুত্বের জন্য ঘানায় যান ১৯৬০-এর দশকে। সেখানে তখন লেখক ও সম্পাদক হিসাবে রেডিওতে অনুষ্ঠান সম্প্রচারের কাজ করেন। ‘১৯৬৫ সালে আমেরিকায় নব গঠিত আফ্রো-আমেরিকান একতা সংগঠন তৈরিতে ভূমিকা রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসেন’। তিনি ‘মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র-এর সঙ্গেও কাজ করেন সমাজ থেকে বর্ণবাদকে চিরতরে বিদায় জানাতে’। কিন্তু লক্ষ্য করলেন এ বর্ণবাদী আন্দোলনে কেবল পুরুষদের মুক্তি পথকেই সুগম করছে। ফলে তিনি কৃষ্ণ নারীদের মুক্তির ডাক দিলেন। যা ইতিহাসে ব্ল্যাক ফেমেনিজ নামে পরিচিত। 

সাহিত্য চর্চা, নৃত্য অনুশীলন ও সংগীতচর্চার পাশাপশি চলচ্চিত্র পরিচালনার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। হলিউডের জনপ্রিয় অ্যাকশন হিরো ওয়েসলি স্নাইপস অভিনীত ডন ইন দ্যা ডেল্টা চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন।  ১৯৯৮ সালে এ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর প্রশংসার বন্যায় ভাসতে থাকেন। 

তাঁর মম এন্ড মি একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। এখানে তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো কাব্য শৈলির মাধ্যমে তুলে ধরলেন। বাস্তবতা আলোকে তুলে ধরা কথাগুলো কারও কাছে অবিশ্বাসও হতে পারে কিন্তু সমাজের চারপাশে লক্ষ্য করলেই এমন চিত্র চোখে পড়ে। এ গ্রন্থে তিনি জানিয়েছেন, একজনের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে। তাই প্রায়ই প্রেমাভিসারে যেতেন। মায়ার কর্মস্থল থেকে লোকটি গাড়ি-তে তুলে নিত। তাঁর সে বিশেষ মানুষটি অপহরণের ফন্দি তৈরি করছিলেন তা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি। 

সানফ্রান্সিকোর হাফমুন বে-তে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি ভেবেছিলেন, তাকে নিয়ে সম্ভবত অভিসারে আসা হয়েছে। লোকটিকে তার অপূর্ব মনে হয়েছিল। তখনো তিনি কিছুই টের পাননি। কিন্তু গাড়ি থেকে নামার পরই লোকটা তাকে ঘুষি মারে এবং শক্ত তক্তা দিয়ে আঘাত করে। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে আসলে নিজেকে তার গাড়ির পিছনের আবিষ্কার করলেন। পরে জোর করে তাকে একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে তিনি কৌশলে বাড়িতে খবর পাঠালে তাকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। 

ইতোমধ্যে মায়া লোকটিকে তার বাসার দরজা বন্ধ করে রেখে আসে। এঞ্জেলোর মা পরে ঠিকানা নিয়ে সে লোকটিকে দরজা ভেঙে উদ্ধার করেন। পরবর্তী সময়ে তার অবস্থা এত খারাপ হয়েছিল যে সে তিন দিন নড়াচড়া করতে পারেনি। মা তাকে সুস্থ করে তুললেন এবং একদিন একটা থ্রিএইট পিস্তল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যা ওকে গুলি করে আয়।’ তার ইচ্ছে হয়েছিল গুলি করতে। তাকে ডেকেও আনলেন, কিন্তু নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মনষ্যত্বের কারণে গুলি করা হয়ে ওঠেনি। এভাবেই তিনি পরিণত হলে এক বজ্র কণ্ঠধারী এক পরিপক্ব লেখককে। 

এঞ্জেলোর লেখার বৈশিষ্ট্য নিরূপণে জে কে রাউলিং-এর উদ্ধৃতি প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, ‘আমি শিখেছি, লোকজন খুব সহজেই ভুলে যায় আপনার যেকোনো কাজ বা কথা। কিন্তু তারা কখনো ভুলে না আপনি তাদের অনুভূতিতে কীভাবে আঘাত করেছেন।’৩ তাঁর কবিতা পুরো আমেরিকাতে যেকোনো অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করা হতো। ‘একে বলা যায় কালো গোলাপের ব্যতিক্রম সৌন্দর্য। তাঁর কবিতা কখনো নারীর শক্তি, মানবিক উৎকর্ষ, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমালোচনায় মুখর। আবার কখনো সমাজের সর্বস্তরের জনগণের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচারের আভায় প্রজ্জ্বলিত করে পাঠকের বিবেক। তাঁর কবিতার বই জাস্ট গিভ মি এ কুল ড্রিঙ্ক ওয়াটার : পর আই ডাই’ পাঠক চিত্তকে নাড়িয়ে দেয় গভীর থেকে। 

এ বইয়ের প্রথম বিশটি কবিতা প্রেমের। আবেগতাড়িত ভালোবাসাকে আবিষ্কার ও হারানোর তীব্র বেদনা প্রকাশ পেয়েছে। আর অন্যান্য কবিতায় তিনি ১৯৬০ সালে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের দুঃসহ জীবনসংগ্রাম ও দাসত্বের করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি কবিতায় শব্দ নিয়ে খেলতেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বললেন, ‘আমি মনে করি, শব্দ নিয়ে কাজ করাটাই লেখকের গুরু দায়িত্ব। পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শব্দ…। শব্দ নিয়ে নিজের মন মতো খেলে একজন লেখক। এই শব্দকে লেখক বলের মতো ছুঁড়ে মারেন কল্পনার দেয়ালে। আর বলের মতো বাউন্স করে তা আবার ফিরে আসে লেখকেরই কাছে।’ এ মহান লেখক এভাবেই নিজেকে সাহিত্যে জানান দেন। তাই ত্রিশ বছর বয়সে বলতে পারলেন, ‘আপনি যদি সব সময় সাধারণ মানুষ হতে চান, তাহলে আপনি টেরও পাবেন না কত মহৎ মানুষে আপনি রূপান্তরিত হয়েছেন।’ 

একটি কথা স্পষ্ট তাঁর লেখার ধরন বেশ সাবলীল এবং অপরিচিত শব্দ খুব কম ব্যবহার করেন। এমনকি অপ্রয়োজনীয় রূপকের আশ্রয়ও তিনি নেননি তাঁর কাব্যে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হলেও বাংলাদেশে মাত্র পাঁচটি কবিতা অনুবাদ হয়েছে। এক্ষেত্রে অনুবাদগুলো সব সময় প্রাঞ্জল হয়ে উঠেনি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শব্দ প্রয়োগে মূল বিষয় বস্তু ভিন্ন দিকে ধাবিত হয়েছে। তার মধ্যে ‘আমি জানি খাঁচার পাখি কেন গায়’, ‘এখনো আমি জেগে আছি’, ‘নারীর কাজ’ ও ‘বিস্ময়কর নারী’  উল্লেখযোগ্য। 

‘আমি জানি খাঁচার পাখি কেন গায়’ এ কবিতার বিষয়বস্তু শাহেদ আলীর ‘জিব্রাইলের ডানা’ গল্পের বিষয়বস্তুর সঙ্গে বেশ মিল আছে। অথবা একে রোমান্টিক কবি জন কীটস্-এর ‘ওড টু নাইটএঙ্গেল’র সঙ্গে তুলনা করা চলে। নাইটএঙ্গেল আকাশের পর আকাশ পেরিয়ে নিজেকে শূন্যে মিলিয়ে দেয়। সে পাখিটি পৃথিবীর নির্মমতার চিত্রকে তুলে ধরেছেন নিপুণতার সঙ্গে। আড়াল করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছা থাকলেও নাইটএঙ্গেল একপর্যায়ে ঠিক পৃথিবীতে ফিরে আসে। এর মধ্য দিয়ে বিপ্লবাত্মক মনোভাব ফুটে উঠেছে ঠিক এখানেও মায়া এঞ্জেলোর বন্দি পাখি একটি রূপক অর্থে বুঝানো হয়েছে। তাঁর স্বপ্ন বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্নের মতই গগনজুড়ে বিচরণের ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। 

মুক্ত পাখি যখন যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু বন্দি পাখি। সে ‘পাখি খাঁচায় বন্দি/ কদাচিৎ সে দেখাতে পারে/ হুঙ্কারের ভয়বহতা/ পাখাজোড়া আটকানো এবং/ পাদু’টো শক্ত করে বাঁধা/ ফলে মুখ খুলে নিরর্থক গান করার চেষ্টা করে।’ এ নিরর্থকতার মাঝেও নিজেকে সে মানসিকভাবে মুক্ত রাখতে চায়। তার স্বপ্নগুলোকে নষ্ট হতে দেয় না। তার স্বপ্নগুলোকে সে শঙ্কার মাঝেও নানাভাবে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তার ভাষায়, ‘খাঁচায় বন্দি পাখি/ ভয়ে ভয়ে গান করে/ অজানার/ কিন্তু রয়েছে ভবিষ্যতের স্বপ্ন/ এবং তার এ গান শোনা যায়/ দূর পাহাড় হতে।/ সে গান করে নিরন্তর/ বন্দি পাখির স্বাধীনতা চেয়ে।’ তার উদ্দেশ্য সে পরিষ্কার করে ‘স্বাধীনতা চেয়ে’। অর্থাৎ পৃথিবীর নারীদের বন্দি দশা থেকে মুক্তির আহ্বান ও প্রতিবাদী হয়ে উঠার নিখুঁত চিত্র ওঠে এসেছে। এ প্রতিবাদী সুর আধুনিক কবি টেড হিউজের ‘জাগোয়ার’ কবিতাতেও পাওয়া যায়। পার্থক্য হলো এঞ্জেলো নারী মুক্তির কথা বলেছেন। আর হিউজ সকল নির্যাতিত ও ঔপনিবেশিক মানুষের মুক্তির মন্ত্র দিয়েছেন। শত বঞ্চনার মাঝেও সুপ্ত ইচ্ছা প্রকাশ করে এঞ্জেলো বলেন, ‘কিন্তু বন্দী পাখি দাঁড়িয়ে থাকে স্বপ্নের মাঝে/ তাঁর ছায়াতেই সে দিবাস্বপ্নের মতো আর্তচিৎকার করে ওঠে/ তার পাখাগুলো আটকানো এবং পাগুলো বাঁধা/ তাই সে সুর তুলতে মুখ খোলে।’

‘এখনো আমি জেগে আছি’ তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা। ঘুমন্ত নারীকে জাগিয়ে তোলবার জন্য এমন জীবন্ত ক্যানভাস খুব কমই হয়। কাউকে অধ্স্তন করার জন্য সমাজের নানা কূটকৌশলের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘তুমিআমাকে ইতিহাসে নিচু করে ফুটে তুলেছো,/ তোমার কটু, কুপমণ্ডুকতা ও বানানো মিথ্যা দিয়ে,/ তুমি আমাকে সব নোংরা পথে পদদলিত করার চেষ্টা করেছো,/ তবু আমি জেগে থাকবো  ধুলিকণার মত।’ এ নোংরা সমাজ একজন নারীকে কীভাবে রাখতে চায় তা বুঝাতে প্রশ্নবানে ভাসিয়ে দেন সচেতন মানুষকে। তাঁর জিজ্ঞাসা, ‘তুমি আমাকে ভঙ্গুর অবস্থায় দেখতে চেয়েছো?/ অবনত মস্তকে এবং নিচু নেত্রে?/ কান্নার জলের মতো বাহুগুলো নিচে নেমে যাচ্ছে,/ আমার হৃদয় নিগরানো কান্নায় কি সাপ্তাহিক ছুটিগুলো নষ্ট হবে?/ আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কারণে তুমি কি নিয়ম ভাঙ্গছো?/ তুমি কি একে রুঢ় বাস্তবতা হিসাবে নিয়েছো?’

ধীরে ধীরে প্রতিবাদী কণ্ঠ বজ্র কঠিন হতে থাকে। তাই তাকে বলতে দেখি, ‘তোমার শব্দ বোমা দিয়ে আমাকে গুলি করতে পার,/ তোমার রক্ত মাখা চোখ দিয়ে আমাকে কচুকাটা করতে পার,/ তোমার ঘৃণা দিয়ে আমাকে খুন করতে পার,/ তবু আমি বাতাসের মত চির জাগ্রত থাকব।’ এরপর সমস্ত দ্বিধাকে দূরে ঠেলে দিয়ে নজরুলের মতো বিপ্লাবাত্মক হয়ে বললেন, ‘লজ্জাজনক ইতিহাসের পাতার বাহিরে/ আমি জেগে আছি।/ বিষযুক্ত ব্যাথাতুর অতীতের শিকড়ের উপর/ আমি জেগে আছি।/ আমি এক কৃষ্ণ সাগর, সেখানে লাফাচ্ছি আর বুক চিতিয়ে হাটছি,/ কূপ খনন করছি এবং স্ফীত করছি জোয়ারের মাঝে।’

‘মহিলার কাজ’ শীর্ষক কবিতাতে একেবারে সাদামাটাভাবে তুলে ধররেন মহিলাদের নিয়ে সমাজের চিন্তা ও ভাবনা। নেই কোন ভণিতা। বললেন, ‘একজন মহিলার কাজ বাচ্ছা জন্ম দিয়ে তাকে গোসল করানো, কাপড় পড়ানো, স্কুলে নিয়ে যাওয়া, বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার রাখা, অসুস্থ হলে তাকে সেবা করা, বড়দের যৌন লালসাকে মিটিয়ে দেয়া, কিন্তু নিজের ইচ্ছাকে প্রকাশ না করা। কেবল তাই নয় মৃত্যুর সময়ও তাকে নানা অপবাদ দিয়ে লাঞ্চিত করা হয়। সমাজের কোথাও তার অবস্থান নেই’। 

‘বিস্ময়কর নারী’ ও ‘মাতৃত্বের কালো ছায়া’ কবিতাতেও একই সুর পাওয়া যায়। নারীর প্রতি বৈষম্য মূলক আচরণ ধনী-গরিব সব সমাজে একইভাবে ক্রিয়াশীল। সাদা-কালো সমাজের দেয়ালে পিষ্ঠ নারী। নারীবাদীরা কেবল তাত্ত্বিক আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকলেও তিনি হয়ে উঠেন নারী মুক্তির এক বজ্র কণ্ঠ। 

তথ্যসূত্র : 
১. আকেল হায়দার, ‘মায়া এঞ্জেলোর অজানা জীবন’, দৈনিক ইত্তেফাক। 
২. স্মিতা অপর্ণ, ‘সাদা বিশ্বে এক কালো শিখা’, মার্কিন কবি মায়া এঞ্জেলো স্মরণ সংখ্যা। 
৩. শামস আরেফিন, ‘মায়া এঞ্জেলো : সাহিত্যের কালো গোলাপ আর নেই’। 
৪. মায়া এঞ্জেলো, খাঁচায় বন্দি পাখি, অনুবাদক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। 
৫. মায়া এঝেলো, এখনো আমি জেগে আছি, অনুবাদক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন।
৬. মায়া এঞ্জেলো, মহিলার কাজ, অনুবাদক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন।


মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে কর্মরত। তিনি ফোকলোর নিয়ে গবেষণারত, অনুবাদক ও গবেষক।

menu
menu