কবির সঙ্গে মানসভ্রমণ

বস্তুত নেই নিমন্ত্রণের আশা
মন শুধু বলে : চাইবাসা চাইবাসা
ডাকবাংলোর দুয়ার গিয়েছে খুলে
মন, তুমি ফেরো একবার, পথ ভুলে
অরণ্য-চরণিক
তুমি কাছে এসে দাঁড়ালে-দুয়ার দিক
কিংবা স্মৃতির পথরোধ করে টিলা
বলো তুমি—‘আজো নাম নাকি উর্মিলা?’

কবিতা ‘মন বলে’। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। লক্ষণীয় শব্দগুচ্ছ ‘অরণ্য-চরণিক’। বস্তুত কবির জীবনের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে অরণ্যচারণ। তবে কেবল অরণ্য নয়, কবির ভ্রমণ পিপাসু মন ছুটে বেড়িয়েছে পাহাড়ে-টিলায়, সমুদ্রতটে, বাংলার গ্রামে। পদ্যকার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাপেক্ষে ভ্রমণকাহিনিকার শক্তি চট্টোপাধ্যায় অনেকটাই অজানা। ‘উইকএন্ড’, ‘চলো বেড়িয়ে আসি’, ‘পাহাড়ে জঙ্গলে’ প্রভৃতি কবির বেড়ানোর বই। 

কবি তাঁর এক স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন, ‘দূরে দূরে মফস্বলের জলা জঙ্গলের পথে ছুটে যাই সবুজের খোঁজে খোঁজে। এরই ফলে বোধহয় জল-জঙ্গল আমার কবিতায় একটি স্থায়ী জায়গা দখল করে নিয়েছে।’ শুরুতে উল্লিখিত কবিতাটি‘ধর্মে আছো জিরাফেও আছো কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। কবি তাঁর ‘জঙ্গলে-পাহাড়ে’ বইয়ের ‘অন্তর্ভ্রমণ আর বহির্ভ্রমণ’ রচনায় জানিয়েছেন, ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য এর প্রায় সবগুলি লেখা এবং ‘ধর্মে আছো’-র অধিকাংশই সিংভূমের জঙ্গল কেন্দ্র করে। সিংভূম সদর চাইবাসা এবং তার আশেপাশে ঘুরে বেড়ানোর গপ্পো এত রকম ভাবে লেখা হয়েছে যে আর একবার শুধু ছুঁয়ে যাওয়া যেতে পারে। ’তবে শুধু সিংভূম নয়, বাংলার পশ্চিম প্রান্তে ঝাড়গ্রাম-বেলপাহাড়ি-বাঁশপাহাড়ি-কাঁকড়াঝোড় থেকে ডুয়ার্সের অরণ্যে কিংবা মধ্যপ্রদেশের পান্না, বান্ধবগড়, কান্‌হা-কিসলী থেকে অসমের কাজিরাঙা, সর্বত্র তাঁর অবাধ গতায়াত।

কবির অরণ্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ভ্রমণকাহিনিতে বিবৃত হয়েছে অপূর্ব কাব্যিক ভঙ্গিতে। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। মধ্যপ্রদেশের অরণ্যে কবির সঙ্গী ছিলেন কৃষিবিজ্ঞানী শম্ভুলাল বসাক। তাঁরা গিয়েছিলেন ‘জারপ্লাজম’ সংগ্রহ করতে; ‘জারপ্লাজম’ হলো ‘আধুনিক শস্যের আদিম রূপ’। সেই রূপের মধ্যে রয়েছে অপরিসীম সহ্যশক্তি আর প্রতিরোধ ক্ষমতা। পুরো বিষয়টি বুঝে নিয়ে কবি ‘জারপ্লাজম’ এর নামকরণ করলেন ‘বনকুটুম’ আর এই যাত্রা হলো ‘বনকুটুমের সন্ধানে’। বিজ্ঞানের নিতান্ত কেজো বিষয় একটি সুমিষ্ট কাব্যিক নাম পেলো কবির সৌজন্যে। মধ্যপ্রদেশের এই অরণ্য অঞ্চলে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠে ঢোলকলমির লতা। স্থানীয় ভাষায় তার নাম ‘বেসরম’; তা থেকে কবির পদ্যে জায়গা করে নেয় ‘বেসরম ঢোলকলমি’। 

কবির কাছে অরণ্য ভ্রমণের উদ্দেশ্য ‘অসহ্য সবুজের চাপ সহ্য করা’। তাই জঙ্গলের মধ্যে অন্যমনস্কভাবে ঘুরে বেড়ানোই জঙ্গল বেড়ানোর কারণ, বন্যজন্তু দেখতে পাওয়া উপরি পাওনা। এই সবুজের টানেই কবি বারবার ছুটে গেছেন অরণ্যের অন্দরে। অরণ্যকে অনুভব করার জন্য আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ই যে অপরিহার্য, তার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় কবির ‘বেলপাহাড়ি ডাকবাংলো’ রচনাটিতে। রচনাটি থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি; দর্শনেন্দ্রিয় :  ‘শাল সেগুন চাঁপ পিয়াল চাষ করে এই নতুন বন, বছর কয়েকের। আমগাছ, জামগাছ; ইউক্যালিপটাস আর সোনাঝুরি।’ ঘ্রাণেন্দ্রিয় : ‘বনের মধ্যে ঢুকতেই একটা তীব্র মিষ্টি গন্ধ নাকে এলো পেট্রোলের গন্ধ ছাপিয়ে। কীসের গন্ধ? তাত লেগেছে সেগুন মঞ্জরীর গায়ে। তার সঙ্গে মিশেছে অজানা বনগন্ধ।’ শ্রবণেন্দ্রিয় : ‘বাচ্চারা কিচিরমিচির লাগিয়েছে। ডালপালার পাখি তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে।’ স্পর্শেন্দ্রিয় : ‘জঙ্গলে শীত, আমরা ঘাসের শতরঞ্চিতে বসে চারিদিকের স্নিগ্ধতা গায়ে মেখে নিচ্ছি।’ এর সঙ্গে স্বাদেন্দ্রিয় হিসেবে যুক্ত হয়েছে চা সিঙারা কিংবা ডিনারে ভাত মুরগির ঝোল, সঙ্গে কোঁড়ক ভাজা। ‘কোঁড়ক হলো ব্যাঙের ছাতা। যে জানে বেছে নিতে পারে। কিছু কিছু বিষাক্ত ছাতা আছে। খেয়ে মরে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সবাই ভয় পেলো। অনেকেই খাইনি জীবনে। কিন্তু আমি তো জানি কী অসামান্য স্বাদ এই ছত্রাকের। বাঁচি মরি গালে ফেলে দিলাম। এর আরেক নাম ‘স্বর্গপুষ্প’—অমৃতের আস্বাদ এর হবে না তো কী কুঁকড়োর ঝোলে হবে? এই হলো কবির অরণ্য ভ্রমণ। জঙ্গলের রূপ-রস-গন্ধ-স্বাদ-স্পর্শ আঁজলা ভরে পান করে নিয়েছেন কবি। 

সবুজের প্রতি কবির প্রেম ছিল চিরন্তন; সেই ভালোবাসার টানে কবি বারবার ছুটে গেছেন অরণ্যের পানে। অরণ্য তাঁর কাছে ধরা দিয়েছে মোহময়ী রূপে। কবির লেখনীতে তা পরিস্ফুট হয়েছে অসাধারণ কাব্যিক ভাষায়: ‘তোবড়ানো চাঁদ আছে শালের চূড়ায় লটকে, ঘয়লা ঘুড়ির মতন’; কান্‌হা অভয়ারণ্য যাওয়ার পথে মান্‌ডলা বাংলোয় বসে কবির বর্ণনা ছিল এরূপ। কবির অরণ্য ভ্রমণের একটি অপরিহার্য সঙ্গী হলো মহুয়ার মদ; কবিকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্রেও তার উল্লেখ পাওয়া যায়। মান্‌ডলায় মহুয়া প্রাপ্তির সংবাদ শুনে কবির প্রতিক্রিয়া স্বতোৎসারিতভাবে উচ্চারিত হয় : ‘ফূর্তির প্রাণ মান্‌ডলার মাঠ’। কান্‌হা-কিসলির পরে কবির গন্তব্য ছিল অচানকমার। অচানকমারের পরিচয় কবি দিয়েছেন খানিকটা অদ্ভুতভাবে : ‘মোহনবাগান যে বছর ইস্টইয়র্ককে হারিয়ে প্রথম ভারতীয় দল আইএফএ শিল্ড পেলো, ঠিক সে বছরই অচানাকমার বনবাংলো তৈরি’। অচানকমারে বিখ্যাত বাঘঘাস; তা বাঘের মতোই সংরক্ষিত হয়। মণিহারির মতো অচানকমারকে সাজিয়েছে মণিয়ারি নদী। সিমলিপালের অসংখ্য নাম-না-জানা বনবাংলোতে পাড়ি দিয়েছেন কবি। তার মধ্যে চড়ুই পাহাড়ি, বরেহিপানি, বড়াকামরা, জেনাবিল ইত্যাদি অন্যতম। যে চাইবাসার প্রসঙ্গ দিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল, সেখানে কবি ছুটে গেছেন বারবার; রোরো নদীর ধারে। প্রকৃতির অকৃত্রিম সৌন্দর্য অনুভব করেছেন। 

কবির অরণ্য ভ্রমণের ভূগোল পশ্চিমে মধ্যপ্রদেশ থেকে পূর্বে কাজিরাঙা পর্যন্ত বিস্তৃত। আর এই অরণ্য ভ্রমণের সূত্রেই এসেছে অসংখ্য বনবাংলোর প্রসঙ্গ। তার মধ্যে কয়েকটি বনবাংলোর উল্লেখ না করলেই নয়। পূর্বের সর্বেন্দ্রিয় সমন্বিত অভিজ্ঞতা বেলপাহাড়ি ডাকবাংলোর প্রেক্ষিতে রচিত। ভৌগোলিকভাবে এর কাছাকাছি অবস্থিত ঘোড়াধরা ডাকবাংলো। লেখকের বর্ণনাটি এরূপ : চারদিকে শাল পলাশের জঙ্গল; শহরের সুবিধা নিয়ে স্বার্থপর দৈত্যের মতো সুখভোগ করার জন্য আদর্শ। কোলাঘাটে রূপনারায়ণের ধারে দেনাং বাংলো। জ্যোৎস্নারাতে আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের নিচে নদীতটে বসে জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ অনুধাবন করা কবির কাছে এক ‘দুঃসহ’ অভিজ্ঞতা। এই দৃশ্যপটের অন্দরে একাত্ম হয়ে কবির উপলব্ধি : ‘সৌন্দর্যের একধরনের নিঃশব্দ অত্যাচার আছে। তাতে রক্তপাত হয়।’ চক্রধরপুরের কাছে অচেনা অজানা রোগোদ বনবাংলো। বাংলোটি এতটাই অপরিচিত যে বাংলার রেজিস্ট্রার বুকের পৃষ্ঠাসংখ্যার অগ্রগমন বত্রিশ হলেও তার বয়স কবির বয়সের থেকে বেশি। স্বভাবতই বয়সের ভারে রেজিস্ট্রার বুকটি বিবর্ণ হয়ে গেলেও তার পৃষ্ঠা এখনো সম্পূরিত হয়নি। এই রেজিস্ট্রার বুকেই কবি খুঁজে পান ভীষণ পরিচিত দুটি নাম : প্রবোধ সান্যাল ও  নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কাজিরাঙা অভয়ারণ্যে বনবাংলো টিলার চূড়ায়। কাজিরাঙা অভয়ারণ্যে জীববৈচিত্র লক্ষণীয়। কবি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন মনিটর লিজার্ডের কথা; বিষাক্ত হিংস্র এই সরীসৃপের তাড়ায় হাতিও নাকি ছুটে পালায়। বনবাংলোর পাশাপাশি সমুদ্রতট বা নদীতটে অবস্থিত বাংলোর বর্ণনাও আকর্ষণীয়। যেমন : হুগলি-রূপনারায়ণের সংযোগস্থলে অবস্থিত গেঁওখালি বাংলো। ভ্রমণকাহিনিতে যতগুলো বাংলোর উল্লেখ করেছেন তার প্রায় সবগুলোই সরকারের বন বা সেচ বা পূর্ত দপ্তর বা জেলা পরিষদের অধীনস্থ। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই কবি জানিয়েছেন কোথায় কীভাবে আগাম বুকিং করে সেইসব বাংলোয় আশ্রয়প্রার্থী হওয়া যায়। কোন ক্ষেত্রেই আগে থেকে না জানিয়ে হঠাৎ উপস্থিত হওয়ার কোনো বিবরণ নেই। সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে যেমন দেখা যায় শহরের চার যুবক ডিএফও ডালটনগঞ্জের নির্দেশকে তোয়াক্কা না করে পলামুর সেই বাংলোতে উপস্থিত হয়েছিল, কবি নিজে ঠিক তেমন উদ্দাম, বাঁধন-না-মানা বোহেমিয়ান স্বভাবের হলেও ভ্রমণকাহিনিতে তার কোন উল্লেখ নেই। হয়তো কবি পাঠকের উদ্দেশ্যে তেমন কোন বার্তা দিতে চান না বলেই আগাম বুকিং এর সুযোগ-সুবিধা বিস্তৃতভাবে জানিয়েছেন।  

অরণ্য ভ্রমণ প্রাধান্য পেলেও পাহাড়-সমুদ্র, ঐতিহাসিক স্থান, ধর্ম স্থান পর্যটনের বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ হয়েছে কবির ভ্রমণকাহিনির পাতায়। ওড়িশার গোপালপুর সমুদ্র সৈকত থেকে চাঁদিপুর-দীঘা-জুনপুট হয়ে ফ্রেজারগঞ্জ পর্যন্ত সমুদ্রের ভিন্ন ভিন্ন রূপ, ফ্লোরা ও ফনার বর্ণনা, সেইসঙ্গে কোন স্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব উল্লেখ করেছেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাজ্য তদানীন্তন বিহার বর্তমান ঝাড়খণ্ডের ছোটনাগপুর মালভূমির অভ্যন্তরে রয়েছে অসংখ্য অনির্বচনীয় ভ্রমণস্থান যেগুলো একেবারেই জনপ্রিয় নয় বরং অত্যন্ত অজানা কিন্তু প্রকৃতি সেখানে উজাড় করে দিয়েছে নিজেকে; এমন বেশ কয়েকটি স্থানের সন্ধান দিয়েছেন। ছোটনাগপুরের দার্জিলিং হিসেবে খ্যাত নেতারহাট থেকে রাজরাপ্পা ছিন্নমস্তা মন্দির; কবি বলেই দিয়েছেন সপরিবারে হইহুল্লোড় করে বেড়ানোর জায়গা এগুলো নয়, এগুলো নিজের মুখোমুখি হয়ে নিজের সঙ্গে নিজের বাক্যালাপের জায়গা। ওড়িশায় রয়েছে অসংখ্য তীর্থস্থান, মন্দির নগরী : ঢেংকানল, হরিশংকর, গুপ্তেশ্বর, দুদুমা, ধৌলি, চাকাপাদ, জাজপুর ইত্যাদি। প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক তথ্য জ্ঞাপন করেছেন কবি। উত্তরবঙ্গ, উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড পরিক্রমার সূত্রে পাহাড়ে বেড়িয়েছেন। মিশেছেন স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে। এমনই একজন মানুষ অসমের রতীশ শর্মা; যে কবির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল বাসমিয়া ভাষায় অর্থাৎ বাংলা-অসমিয়া ভাষার মিলিত রূপে।   

ভ্রমণকাহিনির মাঝে কবি দু’একটি লেখা লিখেছেন রিপোর্টাজের ধাঁচে। রিপোর্টাজের যে আদল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কলমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনই একটি ছাঁদ লক্ষ্য করা যায় কবির গদ্যে। প্রথমে জনযুদ্ধ ও স্বাধীনতা পত্রিকার জন্য রিপোর্টাজ লিখলেও পরবর্তীকালে মূলত আনন্দবাজারে জন্যই রিপোর্টাজ লিখেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়েরও কর্মস্থল ছিল আনন্দবাজার। সেক্ষেত্রে রিপোর্টাজ লেখার প্রবণতাটি কবির পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক। মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে কিশোর-কিশোরীদের আবাসিক আশ্রম ‘বিদিশা’। গাছপালা, ফুলফল, জলাশয়, শস্যক্ষেত রয়েছে ক্যাম্পাসের মধ্যেই। মূলত লোধা উপজাতির ছেলেমেয়েরা সাজিয়ে তুলেছে এই আশ্রম; স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা। নারায়ণগড়ের অখ্যাত বাঘাভেড়া গ্রামের ঊষর প্রান্তরে ‘বিদিশা’ নামের এই ফুল ফুটিয়েছেন দুই সহৃদয় ভদ্রলোক : প্রবোধ ভৌমিক ও রঞ্জিত গুপ্ত। মেদিনীপুরের বিখ্যাত লোকশিল্প গয়নাবড়ি। যা অনেক ক্ষেত্রে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে সহায়ক হয়ে উঠেছে ব্যাপকভাবে। মুসুর, বিউলি প্রভৃতি ডালের সঙ্গে চালকুমড়ো মিশিয়ে তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটা, দাঁতন প্রভৃতি অঞ্চলের বাড়ির মেয়েরা তাকে রূপ দেন বিভিন্ন গয়নার ছাঁদে : চন্দ্রমালা, কানপাশা ইত্যাদি। সে অর্থে নারীর ক্ষমতায়ন তথা অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতার একটি দৃষ্টান্ত গয়নাবড়ি। কবি জানিয়েছেন মূলত মেদিনীপুরের মাহিষ্য সম্প্রদায়ের মধ্যেই এই শিল্প সীমাবদ্ধ যদিও তার কারণ তিনি খুঁজে পাননি।

মেদিনীপুরের আরেকটি বিখ্যাত শিল্প পটশিল্প। বিনপুর থানা সংলগ্ন পটিদারপাড়া। কলকাতা থেকে পূর্ণেন্দু পত্রী এসেছেন তাঁর তথ্যচিত্রের কাজে। কবি তাঁর পিছু নিয়ে এসে পড়লেন পটুয়া গ্রামে। বাড়ির ছেলেরাই মূলত পট আঁকা শেখে। শিউলি, জবা, পুঁইবিটুলি, লালপাট, গেরিমাটি দিয়ে তৈরি হয় প্রাকৃতিক রং। পোকামাকড়ের থেকে পট বাঁচানোর উপকরণ বনতুলসীপাতা, নিমপাতা। তবে পট এঁকে তাদের অন্নসংস্থান হচ্ছে না; অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। এজন্য অনেকেই এপেশা ছেড়ে দিচ্ছে। কবির মতে, আর্থিকভাবে তাদের স্বাবলম্বী না করতে পারলে পটশিল্প বেঁচে থাকবে না।  

কবির লেখায় খাবারের বর্ণনা দেখে খুব সহজেই অনুধাবন করা যায়, স্বভাবগতভাবে তিনি ছিলেন একজন খাদ্যরসিক। সমুদ্রতটে কাঁকড়া-চিংড়ি থেকে বনবাংলোয় বনমুরগির ঝোল, সর্বত্রই খাবারের বর্ণনা ভীষণ জীবন্ত। ডায়মন্ডহারবারে খাপড়ার হোটেলে ইলিশ আর গরমাগরম ভাত সুস্বাদু, তবে উড়ে আসা বালি এখানে খাবার আস্বাদনে অন্তরায়। আবার দীঘার সৈকতে চাল কলাই মুগের সঙ্গে ইলিশ আর চর্বিহীন পারশে মাছ কবির প্রিয়। ঝাড়গ্রামে কবির বাঁধা আবাস শান্তিনিকেতন বোর্ডিং। সেখানকার মেনু মাছ ভাত ডাল ভাজা সুক্তো; কাঁটা দিয়ে ছ্যাঁচরা কবির ধরাবাঁধা খাবার। সুন্দরবনে গিয়ে কবি অবশ্য মেনি গুলের টকের স্বাদ নিতে ভোলেন না। মেনি হলো এক রকমের কুঁচো মাছ। গৌহাটি থেকে কাজিরাঙা যাওয়ার পথে পড়ে নওগাঁ। এই যাত্রাপথে নওগাঁতেই ভোজনপর্ব সেরে নেওয়া কবির মতে সর্বোত্তম। কবির বর্ণনা পাঠককেও তাঁর মতো মেনে নিতে বাধ্য করবে : ‘নওগাঁতেই দুপুরের ভাতমাছ, ভাতমাংস খেয়ে নেওয়া ভালো। টকটকে কাঁচালঙ্কা লেবুর আচার টেবিলের শোভা।’ অরণ্যভ্রমণে কবির মেনুতে বনমুরগির ডিম আর মাংস বাঁধা উপাদান। তারিয়ে তারিয়ে সেসব উপভোগের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। 

কবির লেখা ভ্রমণকাহিনির স্বাতন্ত্র্য তার কাব্যিক উপমায়। সাধারণ বিষয়বস্তু উপমার সৌকর্যে অসাধারণ হয়ে ওঠে। ওড়িশার গোপালপুর থেকে বাংলার সুন্দরবন পর্যন্ত সুদীর্ঘ সমুদ্র উপকূলরেখাটি তাঁর কাছে ‘পিঁপড়ে খাওয়া ময়দার পরটার গায়ের মতো। বৃষ্টিস্নাত শিলং এর রূপ কবির কাছে প্রতিভাত হয় এভাবে : ‘বৃষ্টি পড়ে হৃদয়ে আমার। আমার হৃদয় আজ ঘাস’। কিংবা অসম সীমান্তে দুলিয়াজান শহরের কোনো বাড়ির উঠোনের লঙ্কাগাছ দেখে তাঁর হৃদয় নেচে ওঠে বাল্যকালে শোনা ছড়ার ভঙ্গিতে : ‘বাগানে লঙ্কাগাছ রাঙা টুকটুক করে’। তবে কখনো কখনো এমন কাব্যরূপময় বর্ণনার একেবারে বিপরীত প্রান্তে নৈর্ব্যক্তিকভাবে কবি বেড়ানোর তথ্যসম্ভার সাজিয়ে দেন; কোনো জনপ্রিয় ভ্রমণ গাইড বুকের মতো। অর্থাৎ ওই নির্দিষ্ট জায়গায় কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন, বুকিং এর জন্য প্রয়োজনীয় ফোন নম্বর, খাওয়ার উপযুক্ত জায়গা, বেড়ানোর ভ্রমণসূচি সাজানোর কৌশল অর্থাৎ ওই অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের পারস্পরিক দূরত্ব, বেড়ানোর সঠিক রুট নির্ধারণ করে দেওয়া, কোন্‌ কোন্‌ স্থান অবশ্য দ্রষ্টব্য ইত্যাদি সমস্ত তথ্য কখনো সাজিয়ে দেন মূল রচনার অভ্যন্তরে, কখনো আলাদা করে নির্দেশিকা হিসেবে। এ কারণেই হয়তো কবির বহু ভ্রমণ যাত্রার সঙ্গী বেলাল চৌধুরী তাঁর নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায় শীর্ষক রচনায় কবিকে অভিহিত করেছেন ‘চলন্ত গাইড বই’ অভিধায়। 

অরণ্য প্রেমিক শক্তি চট্টোপাধ্যায় বিভূতিভূষণের আরণ্যককে অভিহিত করেছিলেন ‘গ্লোব নার্সারির ক্যাটালগ’ নামে। ফলস্বরূপ অধ্যাপক ভূদেব চৌধুরী ক্লাস থেকে বের করে দেন তাঁকে। উজ্জ্বলকুমার মজুমদার স্মৃতিচারণে বলেছেন, কবি শুরু থেকে নিজ ভাবনা প্রকাশের বিষয়ে যত্নবান ছিলেন, নিজের মত প্রকাশে সবসময় সাহসী ছিলেন, পছন্দ-অপছন্দ স্পষ্টভাষায় জোরালোভাবে বলার দক্ষতা ছিল। কবির ব্যক্তিজীবনেও তার আভাস পাওয়া যায়। উদ্দামতার মধ্যেই তাঁর আনন্দ, উচ্ছ্বলতার মধ্যেই তাঁর রোমাঞ্চ, বাঁধ ভাঙার মধ্যেই তাঁর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। তাঁর সম্পর্কে মনোতোষ দাশগুপ্ত বলেছেন, ‘always roaming with a hungry heart’। তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে এই সারসত্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। পাঠকের উদ্দেশ্যে তাঁর একান্ত বার্তা :
 
যদি কোনো পৃথিবীর কিশলয়ে বেসে থাকো ভালো
যদি কোনো আন্তরিক পর্যটনে জানালার আলো
দেখে যেতে চেয়ে থাকো, তাহাদের ঘরের ভিতরে—
আমাকে যাবার আগে বলো তা-ও, নেবো সঙ্গে করে।
(অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে, ধর্মে আছো জিরাফেও আছো)


কৌশিক কর্মকার প্রাবন্ধিক, ভারত 

menu
menu