সাহিত্যে আদর্শবাদ

সাহিত্যের জগৎ এক অলৌকিক মায়ার জগৎ। কিন্তু এই অলৌকিক জগৎ বস্তু জীবনকে বাদ দিয়ে গড়ে ওঠেনি। পরিচিত জগৎ ও জীবনকে অতিক্রম করে এক সুদূর মায়ারাজ্যের সন্ধান এনে দেয় সাহিত্য। সীমা অসীমের মাঝে হারিয়ে ফেলে নিজেকে বিশেষ মুহূর্ত, বিশেষ কাল, বিশেষ সামাজিক গণ্ডিকে ছাড়িয়ে সকল কালের সকল যুগের চিরন্তন মানব হৃদয়ের কাহিনি সাহিত্যের মধ্যে প্রতিভাত হয়ে ওঠে।

জগৎ, জীবন ও প্রকৃতির চিরন্তন রহস্যলীলাই সাহিত্যে রূপায়িত হয়। মানবজীবন সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমাজ-জীবন থেকেই সাহিত্য তার রসদ সংগ্রহ করে। সমাজ বাস্তবতা সাহিত্যের উৎকর্ষ কিংবা অপকর্ষ নির্ণয়ের মাপকাঠি। সেজন্য সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবিও সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। 

সাহিত্যের যেকোনো মাধ্যম দিয়ে ব্যক্তি ও সমাজজীবনের সর্বজনীনতার এক একটি বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে এবং এ চিত্র ফুটিয়ে তোলার মধ্যেই সাহিত্যিকের কৃতিত্ব। একজন যথার্থ শিল্পী সমাজ ও জীবনের বিবিধ সমস্যাকে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে নিরীক্ষণ করেন এবং নিরীক্ষিত তথ্য সত্যকে শিল্পকুশলতার সঙ্গে সাহিত্যের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হন।

প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, সাহিত্য হচ্ছে ব্যক্তিত্বের বিকাশ। মানুষের অমর হবার ইচ্ছে হতে সাহিত্যের উৎপত্তি নয়। সাহিত্য হচ্ছে সরাসরি সাহিত্যিকের সৃষ্টি। সাহিত্য জন্মে মনভূমিতে। প্রকৃতিজগৎ, মানবজগৎ ও শিল্পীর অন্তর্জগৎ—এই তিনের সমন্বয়েই সৃষ্টি হয় আদর্শ সাহিত্যের।

সবার আগে আমাদের জানতে হবে, আদর্শবাদ কী? কারণ সমাজ ও জীবনের আলেখ্য অঙ্কনে সাহিত্যিক কোনো নীতি বা আদর্শ অনুসরণ করেন অথবা সাহিত্যে আদর্শবাদের আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা বা থাকলে কতখানি থাকা উচিত, তা নিয়ে যুগ-যুগান্তর ধরে সাহিত্য সমালোচকদের মধ্যে মতভিন্নতার শেষ নেই।

তাই আদর্শবাদ সম্পর্কে বলা যায়, যার মধ্যে মানব কল্যাণের ধারণা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুসূত হয়। সামগ্রিক মানব কল্যাণের অভীপদ ও আকুলতাকেই শ্রেষ্ঠ আদর্শবাদ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তবে তা ব্যক্তিগত না হয়ে সমষ্টিগত হলে এর মূল্য বেড়ে যায়। এই আদর্শবাদ বাস্তব জীবনের কাজের মধ্যে রূপায়িত করতে হয়। বাস্তবতার এই চর্চায় অনেক ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন হয়। আদর্শবাদের সঙ্গে ত্যাগের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়, অচ্ছেদ্য। সাহিত্য কর্মীর জীবনকে আশ্রয় করে এই ত্যাগ রূপ লাভ করবে এবং তার সাহিত্যের মধ্যে অভিব্যক্তি লাভ করবে। সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টার মনের কামনাকে রূপায়িত করে তোলার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সাহিত্যকে যদি শুধু ভঙ্গি হিসেবে বিবেচনা করা না হয়, সৌন্দর্য সৃষ্টির অজুহাতে নিছক কথার মালা সাজাবার খেলা হিসেবে গণ্য করা না হয়, তাহলে স্রষ্টার মনের মধ্যে এই ত্যাগ ও সংযম গ্রথিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

সাহিত্যের আদর্শ সম্বন্ধে লঙ্গিনাসের মনোভাব এই, শ্রেষ্ঠ সাহিত্য আমাদের মনকে আলোড়িত করবে এবং মহত্তর করে উত্তীর্ণ করবে ঊর্ধ্বলোকে। সেখানে এক অপার্থিব আনন্দলোকে উপনীত হবেন পাঠক। লঙ্গিনাসের কথায়, অন্যসব আরোপিত গুণাগুণ তাকে মানুষ করে কিন্তু Sublimity একজনকে শেষ পর্যন্ত উন্নীত করে ঈশ্বরের মহিমাময় দ্বারে। অর্থাৎ Sublime-এর মূল কথা হলো উত্তরণ।

সাহিত্যের মূল বিষয় হিসেবে Sublimity কে গ্রহণ করে এই পথে উত্তরণের জন্য লঙ্গিনাস সাহিত্যে নীরসতা, মেকিত্ব, সমালোচনা, হৃদয়ের মহত্ত্ব, সম্প্রসারণ, প্লেটোর অনুকরণতত্ত্ব, কল্পনা ও শক্তি, বাগ্মিতা, অলংকার, পরোক্ষ উক্তি বা বক্রোক্তি, মনন, ভাষা, রূপক, অতিশয়োক্তি, বাক্যগঠন, সচেতনতা, সাহিত্যিক যশ, গতানুগতিকতা ইত্যাদি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

উনিশ শতকে ইউরোপীয় সাহিত্যে শিল্প ভাবনায় ভাবিত সাহিত্যিকদের প্রবর্তনায় 'Art for Art's Sake' ‘শিল্পের জন্যই শিল্প’ মতের উদ্ভব হয়েছিল। নিকোলাসের শাসনামলেই ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্বের প্রথম ধারণা পাওয়া যায় আলেকজান্ডার পুশকিনের রচনাবলীতে। ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্বের শুরুর ইতিহাসটা বড়ই বিচিত্র। প্লেখানভ তাঁর শিল্প ও সমাজ গ্রন্থে বিষয়টি চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই মতের শীর্ষাধিপতি ছিলেন অস্কার ওয়াইল্ড। এক সময় এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব বিস্তৃত হলেও বর্তমানের মানদণ্ডে এই মতবাদ ভোগসুখলিপ্সু, প্রমোদবিলাসী, শৃঙ্খলা ও সংযম নীতির পরিপন্থী বলে বিবেচিত।

এই মতবাদের প্রবক্তারা শিল্পকে জীবনের সঙ্গে সমীকৃত করতে গিয়ে শিল্পকে যতটা প্রাধান্য দিয়েছেন, জীবনের দাবিকে খর্ব করেছেন তার থেকে ঢের বেশি। শিল্প যে জীবনের একটি দিক মাত্র, জীবনের আরও অজস্র দিক আছে এবং সে সকল দিকের কোনোটি শিল্পের চেয়ে কোনো অংশে কম মূল্যবান নয়; এই বোধ তাঁদের রচনায় অনুপস্থিত। তাঁরা সত্য সন্ধানী নন এবং তাঁদের রচনায় আদর্শবাদের দাবি স্বীকৃত নয়। এজন্য বিশুদ্ধ সৌন্দর্য চেতনাকে কল্যাণ চিন্তা দ্বারা নিয়মিত করার কট্টর, বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গিকে সংযম চেতনার দ্বারা শাসিত করার প্রয়োজনও সেখানে স্বীকৃত নয়। বিশ শতকের প্রথম যুদ্ধোত্তর পর্বে এই মতের প্রবক্তারা একধাপ উপরে উঠলেন। অতিমাত্রায় আত্মস্বাতন্ত্র্যবাদী শিল্পীগণ যাঁদের মূলমন্ত্র ছিল 'Art for my Sake'। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পুরোমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক ও আত্মপরায়ণ। আর্টকে ছাড়িয়ে এখানে বড় হয়ে উঠেছে আমিত্ব। পাঠকের সঙ্গে ভাবের যোগ সাধনের প্রয়োজনও অনেকাংশে উপেক্ষিত, এমনকি পরিত্যক্ত। সাহিত্যের প্রচলিত ধারণা এই শিল্প সৃষ্টির মধ্যে অনুপস্থিত। 

এ ধরনের অতিমাত্রায় আত্মসচেতন মতবাদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারাতে ঐতিহ্যাশ্রিত সাহিত্য সাধনা এবং সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াসের মাঝখানে একটি তৃতীয় ধারার সাহিত্য চেতনা গড়ে তুলেছিল, যা পাশ্চাত্য মতবাদের প্রভাবেরই ফল। বাঙালির মাঝে এই স্বাতন্ত্র্যবাদ বেশি হওয়ায় কোনো কোনো লেখকের মনের গহিনে আঘাত হেনেছে।

'Art for Art's Sake' এবং 'Art for my Sake' এই তত্ত্ব দুয়ের কোনোটার মধ্যেই আদর্শবাদ নেই। কারণ এই দুটি তত্ত্বই সৌন্দর্য সৃষ্টির আত্মপ্রমাদে নিমগ্ন। এর মধ্যে প্রথমোক্ত শিল্প সৃষ্টির মধ্যে সমাজচিন্তা অনুপস্থিত, দ্বিতীয় মতবাদে সমাজচিন্তা নেই-ই শিল্প সৌন্দর্যের স্বকীয় দাবিও সেখানে স্বীকৃত নয়। ‘সাহিত্য’ কথাটির ব‍্যূৎপত্তিগত অর্থ অনুসারে এবং শিল্পোৎকর্ষের স্বীকৃত লক্ষণাদির মানদণ্ডে বিচার করলে দেখা যায় সাহিত্য শিল্পের একটি প্রধান কাজ অপরের মনে শিল্পীভাবের সঞ্চার করা, শিল্প স্রষ্টা ও শিল্পভোগীর মধ্যে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করা।

শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে এই প্রত্যাশিত কাজটি যদি নিষ্পন্ন না হয়, তাহলে শিল্প যতই বুদ্ধি লক্ষণাক্রান্ত হোক, মনোজীবী হোক, দেশ ও সমাজের তাতে কিছু আসে যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘সাহিত্য’ মানে ‘হিতের সহিত’। অর্থাৎ ‘হিতের সাথে যা বর্তমান তাই সাহিত্য।’ তাই অতিমাত্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাহিত্য স্পষ্টতই হিতের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না। ইতালিয়ান মার্কসবাদী লেখক উমবার্তো ইকো অন আগলিনেস বইয়ে চিত্রকলা আর সাহিত্যে কুৎসিত সৌন্দর্যের রূপ দেখিয়েছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত মেঘনাদ বধ কাব্যে রাবণ চরিত্রেও সেই নজির দেখিয়েছেন। কিন্তু সাহিত্য শুধু শুভ হবে এমন নয়, অশুভও হতে পারে। পৃথিবীতে এমন সাহিত্যের নজির কম নেই।

'Art for Art's Sake' মতবাদের সমর্থকদের সবচেয়ে বড় যুক্তি, যা সুন্দর তাই কল্যাণকর। এই যুক্তির আশ্রয়েই তারা সমাজ বা বৃহত্তর পাঠক সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্বচ্যূতির স্খালন সম্পাদন করে থাকে। সুন্দর জিনিসের সব দোষ মাফ তার আর যেন কোনো দায়-দায়িত্ব নেই।

সমাজকল্যাণ, জাতিপ্রেম, আদর্শবাদ সবকিছুই ওই বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের ধারণার মধ্যে বিধৃত। প্রাচীন কবির লেখনীতে মহাভারতের ‘চিত্রাঙ্গদা’ ও ‘শকুন্তলা’র গল্প দুটিতে যে রূপ লাভ করেছে তার মধ্যে একই সময়ে সৌন্দর্য ও আদর্শবাদের দাবি পরিপূরিত হয়েছে। কাজেই শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যের মর্যাদায় সেগুলো অভিষিক্ত।

মহাবীর অর্জুন সত্য পালনের জন্য এক যুগ ব্রহ্মচর্যব্রত গ্রহণ করে মণিপুর বনে এসেছেন। মণিপুর-রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের প্রেমে উদ্বেলিত হলেও অর্জুন রূপহীন চিত্রাঙ্গদাকে প্রত্যাখ্যান করেন। অপমানিত চিত্রাঙ্গদা প্রেমের দেবতা মদন এবং যৌবনের দেবতা বসন্তের সহায়তায় এক বছরের জন্য অপরূপ সুন্দরীতে রূপান্তরিত হন। অর্জুন এবারে যথারীতি চিত্রাঙ্গদার প্রেমে পড়েন। কিন্তু অর্জুনকে লাভ করেও চিত্রাঙ্গদার অন্তর দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে—অর্জুন প্রকৃতপক্ষে কাকে ভালোবাসেন? চিত্রাঙ্গদার বাহ্যিক রূপ? নাকি, তার প্রকৃত অস্তিত্বকে?

আবার শকুন্তলাতে তপোবনের নিভৃতিকে অবলম্বন করে শকুন্তলা ও দুষ্মন্তের যে প্রেম দেখানো হয়েছে তা সুন্দর ও দেহ সর্বস্বহীন এক প্রেমের আলেখ্য। কিন্তু শুধু দেহের সীমার মধ্যেই যদি ওই আলেখ্যের চিত্রণ সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে গল্পটিকে তথাকথিত সুন্দর আর্ট বলা গেলেও মহৎ আর্ট বলা যেত না। মহৎ আর্ট মাত্রই কল্যাণ ভাবনায় অনুপ্রাণিত, আদর্শবাদী অভীপ্সায় পরিপূরিত। শকুন্তলার প্রেম পরিশুদ্ধ হয়েছে দুঃখের অনলে এবং সেই সঙ্গে মহৎ আর্টে উন্নীত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ও গ্যাটের ভাষায়, ‘ভোগ এবং ত্যাগ, স্বর্গ এবং মর্ত‍্য এখানে একসূত্রে বাঁধা পড়েছে।’

‘শিল্পের জন্য শিল্প’ সাহিত্যিকদের জন্য কখনো প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে পারে। কখনোবা শিল্পের উদ্দেশ্য জনগণের বিরুদ্ধে যেতে পারে। ফরাসি নাট্যকার আলেকজান্ডার ডুমা শিল্পের উদ্দেশ্যে থাকার পক্ষে ছিলেন। তিনি কিছুদিন ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ কথাটিতে বিশ্বাস করলেও পর্যায়ক্রমে ঘোষণা করেছিলেন, ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ অর্থহীন। ঠিক একইভাবে, ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্বে বিশ্বাস করতেন না রুশ দেশের আলেক্সেই কনস্তানতিনোভিচ টলস্টয়। অনেক বড় বড় সাহিত্যিক টলস্টয় ও রলাঁ কথিত 'Art for humanity Sake' নীতিই সর্বোত্তম ভাবাদর্শ মনে করেন। তাঁরা তাঁদের শিল্পকর্মের ভেতরে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এই আদর্শের পোষকতা করেছেন।

‘মানব কল্যাণের জন্য শিল্প’ নীতিতে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁরা তাঁদের মনোগত ভাব বৃহত্তর পাঠক সমাজের হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেন। অপরদিকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যধর্মী লেখকেরা আত্মকেন্দ্রিক ভাষা ও ভঙ্গির আশ্রয় গ্রহণ করে পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশের কোনো চেষ্টা করেন না। ভাবাবেগ সমৃদ্ধ কল্যাণাদর্শের দ্বারা নিজেদের চালিত করেন না। সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য আনন্দ এবং কল্যাণ পরিবেশন। এই দ্বিবিধ উদ্দেশ্যের কোনোটিই সিদ্ধ হয় না, যদি কোনো সংকীর্ণ সম্প্রদায়ের মধ্যেই মুখ্যত সাহিত্যের আবেদন সীমিত রাখার চেষ্টা করা হয়।‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্ব ছিল মূলত আঙ্গিকবাদী সাহিত্যের নব-প্রয়াস। বিমূর্ত ভাবধারার বলে অনেক তাত্ত্বিক এটাকে ‘মানব বিবর্জিত তত্ত্ব’ বলেছেন। এমন তত্ত্বকে ফরাসি কবি মেক্সিম দ্যুঁকাপ রসিকতার সুরে কবিতায় বলেছিলেন, ‘আঙ্গিক সুন্দর—সত্য, পেছনে যদি ভাব থাকে! আর কপাল সুন্দর হলে কি আর হবে, পেছনে যদি মগজই না থাকে কোনো।’ তাই শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সাহিত্য হোক সমাজ সচেতনতার কিংবা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। 

হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতির ভাষাগত রূপায়ণকেই বলা হয় সাহিত্য। আবেগ ও চেতনাকে সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক শব্দের বিন্যাসের মাধ্যমে ব্যক্ত করাই সাহিত্য। তা যেমন বক্তৃতা ও ভাষণরূপে প্রকাশিত হতে পারে, তেমনি সাহিত্যেও সজ্জিত হতে পারে। মার্কিন কবি আর্চিবল্ড ম্যাকলিশের ভাষায়, ‘A poem should not mean / but be’ প্রকৃত সাহিত্যের জন্ম তখনই, যখন ভাষার সৌন্দর্য ও আবেগের ক্রিয়াশীলতা শব্দের আশ্রয়ে রূপ লাভ করে। 

যেকোনো সাহিত্যকর্মের সমৃদ্ধ রচনাশৈলীর প্রসঙ্গে দেখা দরকার নির্বিচার অলংকরণের ফলেই মেকি ঐশ্বর্যের ভাবব্যঞ্জনা সৃষ্টি হয়েছে কিনা, অলংকার-বাহুল্য সরিয়ে ফেললে রচনাটি নেহাত বাগাড়ম্বরে পরিণত হবে কিনা। কারণ উৎকর্ষময় রচনার একটা অন্তর্নিহিত ক্ষমতা আমাদের আত্মাকে উন্নত করে। একটি রচনা তখনই যথার্থ মহৎ বলে পরিগণিত হবে যখন তা বারবার পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েও স্বমহিমায় দাঁড়াতে পারে। 

তবে সাহিত্যের প্রকাশ হতে হবে স্বচ্ছ। প্রতিটি বিশিষ্টার্থক শব্দকে দিনের আলোয় এনে পরীক্ষা করতে হবে। কোনো ঘোলাটে বিষয় উৎকৃষ্ট সাহিত্যের লক্ষণ কখনোই হতে পারে না। সাহিত্যে বাস্তবভিত্তিক বর্ণনাই গ্রহণযোগ্য, সেখানে কোনো বাগাড়ম্বরতার স্থান নেই। বাগাড়ম্বরতা সাহিত্যে বড় ধরনের ত্রুটি। রচনাশৈলীতে অহেতুক স্ফীতি গ্রহণীয় নয়। গালভরা কৃত্রিম বুলি মূল উদ্দেশ্যের উল্টো কাজটিই করে। লেখকেরা বিষয়ের স্বাভাবিক পরিণতির কথা না ভেবে অস্বাভাবিক এবং অতিরিক্ত চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়ে সর্বোপরি রচনার আকর্ষণ বাড়াবার জন্য রুচিহীন অসারতা ও কৃত্রিমতায় পর্যবেশিত করেন। তেমনি অতি আবেগ দিয়ে রচিত কোনো কিছু কৃত্রিম ভাবালুতায় নিম্নমানের হয়ে ওঠে। তেমনি কোনো মেকি বিষয়ের উপস্থাপনা রচনার উৎকর্ষতা হারায়। কোনো অতিরিক্ত উদ্ভট বিষয় প্রকাশে অদম্য আবেগ রচনার গাম্ভীর্য হারায়। 

মানব জীবনের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। জীবনের মূল্যমান নির্ধারণ ও বিনির্মাণে তার ভূমিকা অত্যন্ত প্রবল। মানুষের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যবোধ ও সৌন্দর্য চেতনাকে উজ্জীবিত ও উদ্ভাসিত করে তুলতে সক্ষম। সৌন্দর্য চেতনাকে ভারসাম্যময় এবং জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বানাতে; উচ্চ মানসম্মত লালিত্য ও সুধাময় করে তোলাও সাহিত্যেরই অবদান। তাই সাহিত্যে আদর্শবাদের স্থান নেই একথা সত্য নয়। আদর্শবাদের স্থান অবশ্যই আছে এবং সে স্থান অনেক প্রশস্ত এবং বিস্তৃত।


 সালমা আক্তার প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশ

menu
menu