সম্পাদকের খেরোখাতা

গত ঊনত্রিশ বছর যাবৎ চলে আসা নিউইয়র্ক বইমেলা এখন উত্তর আমেরিকার বাঙালিদের জন্য একটা উৎসব। এ উপলক্ষে প্রতিবছর ঘুংঘুর-এর একটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়, সংখ্যাটিকে ঘিরে বইমেলায় ঘুংঘুর-এর স্টলে জটলা হয়, আলোচনা সমালোচনা হয়। কিন্তু এবছর এর ব্যতিক্রম, এবারের বইমেলা হচ্ছে ভার্চুয়াল বইমেলা। করোনাক্রান্ত পৃথিবীর আরও অনেক পরিবর্তনের মতো আমরাও খাপ খাইয়ে নিচ্ছি এই নতুন নিয়মের সঙ্গে।   
এবছরের মেলাটি মুজিব বর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি নিবেদিত। আমরা শ্রদ্ধা জানাই সেই মহাপুরুষকে যার মননশীল নেতৃত্ব ও অদম্য প্রচেষ্টায় আজ আমরা একটি স্বাধীন জাতি। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ পাঠ ও বিশ্লেষণ বাংলাদেশের সুস্থ রাজনীতির জন্য একটা অপরিহার্য বিষয়। আমাদের স্বাধীনতা মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধেই অর্জিত হয়নি, এর জন্য ছিল—বহু বছরের ত্যাগ, তিতীক্ষা ও পরিকল্পনা। নানা কারণে আমরা খণ্ডিত ইতিহাস চর্চায় অভ্যস্ত। বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃত সম্মান জানানো সম্ভব কেবল তাঁর জীবন ও কর্মকে সামগ্রিকভাবে অধ্যয়নের মাধ্যমে। সাহিত্যের চর্চা ও বিকাশে আমরা মুক্তচিন্তার বিষয়টি তুলে এনে বলি, চিন্তাকে আবদ্ধ না করে তার উন্মুক্ত প্রসারেই মননশীলতার বিকাশ। বঙ্গবন্ধু চর্চার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। রবীন্দ্র-নজরুলকে যেমন খণ্ডিতভাবে উপস্থাপনের বিরোধিতা করি, তেমনি বঙ্গবন্ধুকেও। সহস্র বছরের বাংলার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর আগমন ও প্রস্থান দমকা হাওয়ার মতো কিন্তু ভবিষ্যৎ বাংলায় তাঁর অবস্থান যেন এক উৎকীর্ণ কীলকাক্ষর। যারা বলেন বঙ্গবন্ধুর দর্শনকে অনুধাবন করতে বাঙালির আরও অনেক বছর লাগবে, আমি সেই দলে। আর এই অনুধাবনের জন্য প্রয়োজন তাঁর জীবন ও কর্মকে অনুশীলন করা। 

পৃথিবীর মানুষ অবাক আতঙ্কে লক্ষ করছে সার্স কোভ-২ এই বিদঘুটে নামের একটি ভাইরাস কীভাবে সারা বিশ্বকে আচমকা স্তব্ধ করে দিয়েছে। শুধু  তাই নয়, জনজীবনের সব ইস্যুকে রাতারাতি হাইজ্যাক করে একটি ইস্যুতে পরিণত করেছে। প্রগতি ও অগ্রগতির পাশাপাশি ধ্বংস ও মৃত্যু মানব ইতিহাসের এক অতি পরিচিত পাঠ। কিন্তু সমষ্টিগতভাবে সারা বিশ্বের এভাবে থমকে যাওয়া এবং এক অর্থে আত্মসমর্পণ করার নজির খুব বেশি নাই। তবে অচেনা জীবাণুবাহিত অতিমারি পৃথিবীতে মৃত্যুর ঢল নামিয়েছে কালে কালে, লিপিবদ্ধ ইতিহাসে এর বিশদ বিররণ পাওয়া যায়। সে বৃত্তান্ত এবং এর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের নিবিড় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে প্রতিটি অতিমারি পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক অবস্থানকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছে এবং ভূ-রাজনীতির গতিপথে বাঁক এনেছে। ইতিহাস ঘাটলে উঠে আসে আরও অনেক তথ্য-উপাত্ত, দেখা যায় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মনুষ্য-সৃষ্ট অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ড মহামারির সঙ্কটকে ঘণীভূত করেছে গুণিতক হারে। 
প্রথম প্লেগ বা ‘জাস্টিনিয়ান প্লেগ’-এর সময়কালটা ছিল অধীনস্থ মিসরের কপটিক চার্চের ওপর বাইজান্টাইন চার্চের বলপূর্বক নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করার সময়। এতদিন রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ মিসরের ছিল নিজস্ব বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা এবং নিজস্ব মুদ্রাব্যবস্থা। কিন্তু সম্রাট জাস্টিন অভিষিক্ত হওয়ার পর থেকেই মিসরের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে থাকেন, বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে বাইজান্টিন সামরিক শাসকদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করেন। এর আগেই মিসরের নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হয়েছিল। এবার চার্চের ওপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। মূলত কনস্টিনোপলের খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত এবং নিশ্চিত করাই ছিল এর উদ্দেশ্য। শোষণ ও নিপীড়নের মুখে মিসরের অধিবাসিরা হয়ে উঠে ভয়ানক বিপর্যস্ত ও বিক্ষুব্ধ। এহেন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই আবির্ভূত প্রথম প্লেগ।  
তৎকালীন রোমান সাম্রাজ্যের শস্যভাণ্ডার বলে পরিচিত মিসর থেকে খাদ্যশস্যের চালানের সঙ্গেই প্লেগবাহী ইঁদুর বাইজান্টিন রাজধানী কনস্টাইনটিনোপলে এসে পৌঁছায় ৫৪১ সালের হেমন্তে। আগুনের শিখার মতো প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে প্রায় দশ লক্ষাধিক নাগরিক অধ্যুষিত তৎকালীন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই নগরীতে। মরণযজ্ঞের ভয়াবহ বিবরণ উঠে এসেছে বাইজান্টিন রাজসভার ইতিহাসবিদ প্রকোপিয়াস এর লেখা বই হিস্টরি অফ ওয়ারস এ। বর্ণনায় দেখি, প্রতিদিন পাঁচ থেকে দশ হাজার লোক মারা যাচ্ছে শহরে। অসংখ্য মৃতের সৎকার ও কবর অসম্ভব, নগর দেয়ালের ছাদে ফেলে রাখা হচ্ছে মৃতদেহের স্তূপ। প্রকোপিয়াসের মনে হয়েছিল পুরো মানব জাতি নিশ্চিত উচ্ছেদের পর্যায়ে। মানব জাতি উচ্ছেদ হয়নি, কিন্তু এই মহামারি স্থায়ীভাবেই বদলে দিয়েছিল তৎকালীন পশ্চিমা বিশ্বকে। পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে মহামারি। কৃষিব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় আর মিসরের খাদ্য সরবরাহ না থাকায় দুর্ভিক্ষ চলে আট বছর, জাস্টিনিয়ান রাজত্বের সমাপ্তি ঘটে, এবং এক সময় কেন্দ্রীয় রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে, ইউরোপে ছোট ছোট রাজত্বের জন্ম নেয়। ততদিনে মৃতের সংখ্যা প্রায় ১০০ মিলিয়ন।  
দ্বিতীয় প্লেগ অতিমারির ইতিহাস আরও ভয়াবহ। বলা হয়, এর শুরু ছিল ইতিহাসের প্রথম জীবাণু-যুদ্ধের মাধ্যমে। সালটা ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দ, যখন তাতার বাহিনী এশিয়া মাইনরে অভিযান চালিয়ে কৃষ্ণ সাগরের তীরবর্তী বাণিজ্যকেন্দ্র কাফফা নগরীকে অবরোধ করে (বর্তমানে ক্রিমিয়ার ফিউদসিয়া)। তাতাররাই সঙ্গে নিয়ে এসেছিল প্লেগ। অবরোধ ব্যর্থ হলে তাতার বাহিনী ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু যাওয়ার আগে এক ভয়ানক প্রতিশোধ নিয়েছিল তারা। তাতাররা জানতো এই ব্যাধির সংক্রমণ ক্ষমতা। নগর দেয়ালের উপর দিয়ে সকল প্লেগাক্রান্ত মৃতদেহগুলোকে ছুঁড়ে দিয়েছিল ভেতরে। ফলে যা হওয়ার হলো, হু হু করে ছড়িয়ে পড়ল প্লেগ সারা শহরে। শহর থেকে পালাতে শুরু করল সবাই, সওদাগরেরা ফিরে গেল সমুদ্র জাহাজে, সেই সঙ্গে দূরবর্তী নগরগুলোতে নিয়ে গেল প্লেগ, এরপর পুরো ইউরোপে। এদিকে তাতাররা ফিরে গেল এশিয়ায়, তাদের সঙ্গে প্লেগও আবার ছড়ালো ভারত ও রাশিয়াসহ এশিয়ার নানান অঞ্চলে। পেছন ফিরে দেখি, জীবাণু-যুদ্ধই ছিল সেই প্লেগ ছড়িয়ে পড়ার উৎস।  
ইউরোপের নগরীতে নগরীতে প্লেগের হানা আর বিপর্যস্ত মানবজীবনের ভয়াবহ অবস্থার কথা উঠে এসেছে তৎকালীন সাহিত্য ও চিত্রকলায়। জিওভানি বোক্কাচ্চো’র লেখা বই ডেকামেরন-এ দেখি ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে প্লেগের বীভৎস বিবরণ। নগরীর অর্ধেক লোকের মৃত্যু হয় প্লেগে। বাড়ি বাড়ি আর রাস্তা ঘাটে পচা মৃতদেহ পড়ে থাকত, যাজকের অভাবে সৎকার করা ছাড়াই মাটিতে শব পুঁতে ফেলা হতো। 
ভেনিস, প্যারিস ও ফ্লোরেন্সের মতো নগরগুলোর অর্ধেক লোকই মারা যায় তখন। প্লেগ যখন তুঙ্গে, লন্ডন শহরে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৭ হাজার লোকের মৃত্যু হতো। একই সময় বসন্ত আর কলেরার মতো রোগেও মারা যায় ইউরোপের প্রচুর লোক। শেষমেষ ইউরোপের জনসংখ্যা কমে এর দুইশো বছরের আগের জনসংখ্যায় গিয়ে ঠেকে। শুধু মৃত্যু নয়, দ্বিতীয় প্লেগ প্রচলিত সমাজ জীবনেরও মৌলিক পরিবর্তন আনে, উচ্চবিত্ত আর নিম্নবিত্তের বিভাজনকে ভেঙে ফেলে জন্ম দেয় মধ্যবিত্ত নামের নতুন আর্থ-সামাজিক শ্রেণি।  
ইতিহাসের অপর একটি মরণব্যাধি স্প্যানিশ ফ্লু’র বিস্তৃতিটাও যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত। শুরু হয় আমেরিকায়, অথচ অনেকটা রাজনৈতিক কারণে এর নাম দেয়া হয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু। ক্যানসাসের সেনানিবাসে শুরু হওয়ার কিছুদিনের ভেতরেই এই ফ্লু দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের সর্বত্র, মূলত যুদ্ধরত মার্কিন সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে। অথচ কোনো সাংবাদিক এর প্রচার করতে পারতেন না। সেনাবাহিনীর মনোবল নষ্ট হয় এমন কোনো সংবাদ পরিবেশন তখন আইনগতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। খবর ছাপা হতো শুধু মিত্রশক্তির বলয়ের বাইরের দেশ, যুদ্ধ নিরপেক্ষ স্পেনের পত্রিকায়। ভয়াবহ ফ্লু’র খবরকে হালকা করার জন্যই রটানো হলো এটা হচ্ছে স্পেনের সাংবাদিকদের মনগড়া খবর, এটা স্প্যানিশ ফ্লু। 
এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল যুদ্ধযন্ত্রকে সচল রাখার জন্য জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করার মতো কিছু অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। রোগ ছড়াবে এমনটা জানা সত্ত্বেও যুদ্ধের প্রয়োজনে সরকারি সিদ্ধান্তে সেনা চলাচল অব্যাহত রাখা হয়, রোগ প্রতিরোধক তেমন ব্যবস্থাদি ছাড়াই। দেশের অভ্যন্তরে বেসামরিক নাগরিকদের চিকিৎসায়ও মারাত্মক ত্রুটি ছিল। সমাজে বর্ণবৈষম্য ছিল, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বর্ণবাদের আধিপত্য ছিল, এমনকি রেডক্রসও তখন কৃষ্ণাঙ্গ নার্সদের গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। নার্স ও প্যারামেডিকদের বড় অংশ তখন ফ্রন্টে। ফলে রোগীরা যথাযথ শুশ্রূষা পাচ্ছিলেন না। অন্যদিকে রোগের উৎপত্তি নিয়েও রাজনীতি ছিল। রোগটা যে ভাইরাস দিয়ে ছড়ায় সে তথ্য তখনো জানা ছিল না। জনৈক জার্মান বিজ্ঞানী এইচ ফ্লু নামের একটা ব্যাকটেরিয়ার কথা লিখেছিলেন বৈজ্ঞানিক জার্নালে, যার সঙ্গে ফ্লুর কোনো যোগসূত্র নেই। কিন্তু মার্কিন বিজ্ঞানিরা ধরে নিয়েছিলেন, এই ব্যাকটেরিয়া দ্বারাই হচ্ছে ফ্লু’র সংক্রমণ। জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত আমেরিকায় তখন জার্মানবিরোধী মনস্তত্ত্ব, অতএব অবাক হওয়ার কারণ নেই যে মার্কিন সরকারও এই মতকেই লালন করেন। এইচ ফ্লু নামক সন্দেহজনক ব্যাকটেরিয়ার ওষুধ উদ্ভাবনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশের সেরা সেরা পরীক্ষাগারে প্রচুর অর্থ ও জনশক্তি ব্যয় করা হয়, ফলত মূল জীবাণুটির আবিষ্কার অনেক পিছিয়ে যায়। পরবর্তী  ইতিহাস আমরা জানি, বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৫০ মিলিয়ন, শুধু আমেরিকায়ই ৬ লক্ষাধিক। 
লাতিন আমেরিকায় স্প্যানিশ উপনিবেশ স্থাপনের গোড়ার কথা এখন ট্র্যাজিক রূপকথার মতো, আমরা রুদ্ধশ্বাসে সেই ইতিহাস পড়ি, কী করে ইনকা আর অ্যাজটাকদের মতো বিকশিত সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেল ইউরোপ থেকে বয়ে আনা বসন্তের মহামারিতে। ওই জনগোষ্ঠীর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল অল্প সময়ের ভেতরে। এর পেছনেও দেখি যুদ্ধ আর আগ্রাসনের হাত।

করোনাক্রান্ত পৃথিবীর ইতিহাস যখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানুষ খতিয়ে দেখবে, তখন বর্তমান বিশ্বের অসহিষ্ণু চরিত্রটাও উঠে আসবে সন্দেহ নেই। একবিংশ শতাব্দীর অর্থনৈতিক আধিপত্যের অভিলাষে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্রশক্তিগুলোর মুখোমুখি অবস্থান এখন রাখঢাক ছাড়াই উঠে আসছে খবরে। অতীতে এই ধরনের আধিপত্যের হাতবদল ঘটেছে নানামুখী সংঘাতের মাধ্যমে, এবং অবশেষে সৃষ্টি হয়েছে নতুন ভূ-রাজনৈতিক সঙ্কট। কে জানে করোনা আমাদের সেই পথেই ঠেলছে কিনা?
এতদিন বিশ্বায়নের কথা বলে ধনোন্নত প্রতিটি দেশই নিজ নিজ প্রভাব বলয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত ছিল। অন্যান্য জনবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রগুলোও ক্রমশ জনকল্যাণের পথ ছেড়ে জন নিয়ন্ত্রণের পথে হেঁটেছে। বস্তুত পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই মানব জীবন এখন সরকার, রাজনীতি ও বাণিজ্য—এই ত্রিমুখী শক্তির নিয়ন্ত্রণে। এর ভেতরে সতত উপেক্ষিত হয় জনগণের ইচ্ছা অনিচ্ছা। সঙ্কটকালেও  হারিয়ে যায় বিজ্ঞান। আমি শুদ্ধ বিজ্ঞান হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কার কথা স্পষ্ট করেই বলতে চাই। অতীতে বিজ্ঞানীরা সত্য অনুসন্ধান করেছেন স্বাধীনভাবে, কখনো কখনো রাজশক্তি কিংবা চার্চকে উপেক্ষা করে। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে বিকশিত বিজ্ঞান নিজেই একটা ধর্মের মতো হয়ে উঠে ক্রমশ, বিজ্ঞানী কিংবা সাধারণ বিজ্ঞানমস্করা এর শুদ্ধতাকে পূত-পবিত্র মনে করতেন, ধার্মিকরা যেমন ধর্মকে মনে করেন। কিন্তু এখন ভিন্ন চিত্র দেখি। এই মুহূর্তে বিজ্ঞানের প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো করোনা ভাইরাস। কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে দেখি, পৃথিবীর কোথাও করোনা-সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড রাজনীতির উর্ধ্বে নয়। বিজ্ঞান ও বুদ্ধিচর্চাকে বাণিজ্যিকরণ এবং রাজনীতিকরণও এখন করোনার মতোই ছোঁয়াচে মহামারি। মানবকল্যাণের প্রয়োজনে এর প্রতিষেধক প্রয়োজন এক্ষুনি।
 

বাষ্পযন্ত্রের আবিষ্কার শুধু শিল্প বিপ্লবের সূচনা করেনি বরং মানব সমাজের কাঠামোকে স্থায়ীভাবে পরিবর্তিত করেছে, বিকাশমান যন্ত্রসভ্যতার উন্মেষ কৃষিপ্রধান সামন্ত সমাজকে ভেঙে দিয়ে ধনতন্ত্রের শক্ত শেকড় প্রোথিত করেছে। পরবর্তিতে বিদ্যুতের আবিষ্কার আরও একটি আবিষ্কার যা সমাজকে পুনরায় ঝাঁকি দেয়। শুধু বাড়ির বাইরে রেল আর মোটরবাহিত নতুন সংস্কৃতি নয়, বাড়ি বাড়ি রেডিও, টেলিভিশন, ফ্রিজ, এয়ারকুলার—এসব আমাদের অন্দরমহলের সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন আনল। কম্পিউটার এবং  ইন্টারনেটের আগমন পৃথিবীকে আরও একটি নতুন পথে হাঁটতে শেখাল, যে পথ মাত্র কিছুদিন আগেও ছিল সম্পূর্ণ অচেনা। সবশেষে স্মার্টফোন ও সোশ্যাল মিডিয়া সমাজ জীবনের হাজার বছরের ধারণায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে এল। একই গ্রহে বসবাস করেও মাত্র কয়েক পুরুষ পরেই আমরা এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রজাতির মানুষ। এই ভিন্নতা শুধু আমাদের সক্ষমতায় নয়, আমাদের অক্ষমতায়ও। সমাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র—ইত্যাদি নানাবিধ সমাজব্যবস্থার নিরীক্ষা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের নানামুখী প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত থাকার ক্ষমতা নেই এই সমাজের মানুষের। আমাদের মন ও মননকে নিয়ন্ত্রণকারী অসংখ্য ক্ষুদ্রযন্ত্রের ভার্চুয়াল প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার ক্ষমতা নেই এই সভ্যতার মানুষের। প্রগতি ও অগ্রগতির পাশাপাশি এ-ও এক প্রকৃত সমাজ-সঙ্কট। 
জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুস্থ প্রতিযোগিতা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায় কিন্তু অসুস্থ প্রতিযোগিতা মানব জাতির ধ্বংসের পথকেই উন্মুক্ত করে। অতীতে মহাকাশ বিজ্ঞানকে নিয়ে আমরা দুই পরাশক্তির অসুস্থ প্রতিযোগিতা দেখেছি, দেখেছি পরমাণু বিজ্ঞানকে নিয়ে পীড়িত প্রতিযোগিতা। এবং দেখেছি কীভাবে এই দুই বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষের কল্যাণ নয় বরং আকাশচুম্বী অর্থ ব্যয়ে কুৎসিত মরণাস্ত্র-বিজ্ঞানের জন্ম দেয়া হয়েছে। 
করোনার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে বিজ্ঞানীদের সুস্থ প্রতিযোগিতা শেষাবধি কোথায় ঠেকে সেটাই দেখার বিষয়। সঙ্কটকালীন সময়ে জাতিতে জাতিতে প্রতিযোগিতা উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়, অতীতে বহুবার আমরা এর কুফল দেখেছি। এছাড়া এখন ভ্যাকসিনের সঙ্গে এসে জুটেছে বাণিজ্যের বিষয়। জুটেছে প্রভাব বলয়ের বিস্তার ও সংহত করার বিষয়। উন্নত বিশ্ব এই সব সামলে নিবে, কিন্তু ভাবা প্রয়োজন তৃতীয় বিশ্বের জনগোষ্ঠীর কথা। জ্ঞান-বিজ্ঞান একসময় উন্মুক্ত ছিল। কিন্তু করোনা এসে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে এটা আর উন্মুক্ত নয়, তৃতীয় বিশ্বে তো নয়ই, উন্নত বিশ্বেও নয়।
আরও একটা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ প্রয়োজন। সারা বিশ্বে এখন তাণ্ডব চলছে, পৃথিবী মূলত জিম্মি হয়ে আছে করোনার কাছে। মানব জাতির জন্য এর চেয়ে অশান্তি ও অনিরাপত্তা আর কী হতে পারে? অথচ বিশ্বশান্তির জন্য যারা কথা বলেন তারা সম্মিলিতভাবে কিছুই করছেন না। দেখি নানা বিষয়ে ঘন ঘনই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসে। করোনা বিষয়ে করণীয় নিয়ে কিন্তু কোনো বৈঠক নেই।

মানব ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে মহামারির ইতিহাস দেখলে চোখ খুলে যায়। আগের প্রায় প্রত্যেকটির সঙ্গে ছিল যুদ্ধ, রাজনীতি ও আধিপত্যের সম্পর্ক। সেই সঙ্গে ছিল সুশাসনের অভাব ও বিজ্ঞানকে অবহেলা। বর্তমান অতিমারিতেও এটা দেখা যায়। আমরা দেখেছি আগের মহামারির পরে ভূ-রাজনীতি ও বৈশ্বিক প্রভাব বলয়ের আমূল পরিবর্তন এসেছে। এবারও কী তাই হবে? নির্দিষ্ট বিষয়ে একমত না হলেও দেশ-বিদেশের প্রায় সব বোদ্ধারাই বলছেন, পরিবর্তন একটা আসবে। আমাদের প্রার্থনা, এই পরিবর্তন হোক কল্যাণকর।

হুমায়ূন কবির
১১৫ কবির লেন, জেলিকো, টেনেসি। যুক্তরাষ্ট্র।
সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০।

menu
menu