সুকান্ত ভট্টাচার্য : সেই নির্ঘুম বাতিওয়ালা

বইটি প্রথম হাতে এসেছিল গত শতাব্দীর ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছাড়পত্র । এক শীতের বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আমার বাবার আলমারি ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে গেলাম সেই ঝকঝকে, পরিপাটি, কৃশকায় বই। সত্যজিৎ রায়ের আঁকা প্রচ্ছদ, পরিষ্কার নিটোল ছাপা। হাতে নিয়ে পাতা উল্টাতেই চোখে পড়ল এক দীপ্তিমান কিশোরের ছবি। মুখে স্মিত হাসি, গালে হাত দিয়ে বসে আছে। দেখতে আমার চেয়ে আর কতই-বা বড়! কী এক অজানা আত্মীয়তা বোধ করলাম। পড়ে ফেললাম প্রথম কবিতা ছাড়পত্র। তারপর একে একে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়লাম 'চারাগাছ,' 'প্রার্থী,' 'একটি মোরগের কাহিনী,' 'সিঁড়ি' এবং আরও অনেক কবিতা। পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, প্রতিদিন চারপাশে দেখা প্রাণী ও বস্তুনিচয় নিয়ে এত সহজ, নিরলংকার ভাষায় গল্পের মতো করে এমন হৃদয়স্পর্শী কবিতা লেখা যায়! আর কথাগুলো যেন এক নতুন বোধের উন্মীলন ঘটাল আমার মনে। বইয়ের শেষদিকে এসে পড়লাম 'আঠারো বছর বয়স।' তখনো আমার আঠারো হতে বেশ কিছুটা বাকি। কিন্তু আঠারোর সেই উদ্দীপ্ত, রক্ত-কাঁপানো জয়ধ্বনি গেঁথে রইল মনে। বারবার অনুরণিত হতে লাগল এই পংক্তিমালা : 
 
এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয় 
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে, 
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়— 
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।
 
সময়টা ছিল আমাদের জাতীয় জাগরণের এক রৌদ্রতপ্ত ঋতু। মুক্তির নতুন স্বপ্নে উজ্জীবিত হয়ে উঠছিল গোটা দেশ। দেখতে দেখতে চলে এল ১৯৬৯। দেখলাম জাগ্রত মানুষের স্বপ্নরাঙা মুখ, শুনলাম তাদের আকাশ-ফাটানো মহানাদ, আর দেয়ালে দেয়ালে, ব্যানার-ফেস্টুনে চোখে পড়ল এইসব তাওয়ায় তাতানো কথা :
 
রক্তে আনো লাল,
রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল
 
কিংবা 
 
বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি? 
এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি, 
আমরা সবাই যে যার প্রহরী  
উঠুক ডাক' কিংবা 'দেখব, ওপরে আজো আছে কারা,
খসাব আঘাতে আকাশের তারা,
সারা দুনিয়াকে দেব শেষ নাড়া,
ছড়াব ধান।  
জানি রক্তের পেছনে ডাকবে সুখের বান। 
 
গান-নাচ-শ্লোগানের পাশাপাশি এইসব কবিতাচূর্ণ মুক্তিপাগল মানুষের রক্তে জাগিয়ে তুলল মহাসমুদ্রের কলরোল।
ইতোমধ্যে আমি বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী হয়েছি, যুক্ত হয়েছি শিশু-কিশোর সংগঠন 'খেলাঘরে'র সঙ্গে। সারা দেশে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর পাশাপাশি পালিত হতে দেখছি সুকান্ত জন্মজয়ন্তী। বন্ধুদের নিয়ে নানা আয়োজনে আমি নিজেও পালন করছি সুকান্তের জন্মদিন। পড়ে ফেলেছি তাঁর আরও দুটি কাব্যগ্রন্থ : ঘুম নেই ও পূর্বাভাস। এভাবেই সুকান্ত জড়িয়ে গেলেন আমার জীবনের সঙ্গে। তার পর যখন মুক্তিযুদ্ধ এল—মৃত্যু আর আগুনের বিপুল  উদ্গিরণের মধ্যেও নানাদিকে বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধ গড়ে উঠল—আশা-নিরাশায় দোলায়িত সেই  দিনগুলোতে আকাশবাণী কলকাতা ও স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আর হাসান ইমামের উদ্দীপ্ত কণ্ঠে আবারও শুনলাম এই অবিস্মরণীয় জাগরণ মন্তর :
 
সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয় :
জ্বলেপুড়ে মরে ছারখার তবু   
মাথা নোয়াবার নয়।
 
এবং 
 
বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, 
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।
 
আমার ছোট পৃথিবী উদ্ভাসিত হয়ে উঠল সাহস আর আশায়। সুকান্তের কবিতা আমাকে যেন নতুন জীবন দিল।
এই আগস্টে, সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মমাসে, যখন চারদিকে কোথাও তাঁকে স্মরণ করতে দেখলাম না, তখন ভাবছিলাম : তিনি আছেন তো আমাদের স্মৃতিতে? জানি, একজন কবিকে পাঠ করার জন্য জন্ম ও মৃত্যুর উপলক্ষ গণনা করার প্রয়োজন নেই; তিনি সবসময়ই আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেন। আর বহমান জীবনের বিবিধ অনুষঙ্গে যে কবির বাণী আমাদের চেতনায় জীবন্ত-জাগ্রত হয়ে ওঠে, যিনি ভাষা দিতে পারেন আমাদের ক্ষোভ-দুঃখ-প্রতিবাদ-স্বপ্নকে, বাঁচিয়ে রাখতে পারেন আলো এবং উত্তাপের অভীপ্সাকে, তিনি তো সবসময়ই আমাদের মুগ্ধতা ও অভিনিবেশ দাবি করেন। সুকান্ত ভট্টাচার্য কি সেরকম একজন কবি নন? 
কেউ কেউ হয়তো বলার চেষ্টা করবেন, যেহেতু সুকান্ত একজন কমিউনিস্ট ছিলেন, তাই পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের পরাভবের মধ্য দিয়ে নিঃসংশয়ে প্রমাণ হয়ে গেছে যে, তাঁর স্বপ্ন আর অঙ্গীকার ভুল ছিল। কেউ-বা বলবেন, এই কবি-কিশোরের কাব্যকলা অনাধুনিক, ভাষা আজকের দিনে মৃত ও অচল। লেখা ভাবালুতায় চটচটে। বাংলাভাষী কাব্য-পাঠকের কাছে এখন কীই-বা এমন প্রাসঙ্গিকতা আছে তাঁর? মোটামুটি একই সুরে একদা কথা বলেছিলেন 'আধুনিক বাংলা কবিতা'র অন্যতম ধাত্রীপুরুষ, নান্দনিকতার প্রতিভূ বুদ্ধদেব বসু।
সুকান্তের কবিশক্তিকে স্বীকার করে নিয়েও তিনি বলেছিলেন : 'রাজনৈতিক পদ্য লিখে শক্তির অপচয় করেছো তুমি; তোমার জন্য দুঃখ হয়।' তাঁর অকালমৃত্যুর পর কবিতা পত্রিকার জুন-জুলাই ১৯৪৭ সংখ্যায় লিখেছিলেন : 
 
তার কবিতা প'ড়ে মোটের উপর একথাই মনে হয় যে তার কিশোরহৃদয়ের স্বাভাবিক উন্মুখতার সঙ্গে সঙ্গে পদে-পদে দাঙ্গা বাধিয়ে দিয়েছে একটি কঠিন, সংকীর্ণ, তথাকথিত বৈজ্ঞানিক মতবাদ। কবিতাগুলি যেন সেই মতবাদের চিত্রণ মাত্র; জোর গলায় চেঁচিয়ে বলা, কবিতা না-হ'য়ে খবরকাগজের প্যারাগ্রাফ হ'লেই যেন মানাত।... বস্তুত ধনিকের দ্বারা শ্রমিকের রক্তশোষণ সুকান্তের রীতিমতো একটা ম্যানিয়া হয়ে উঠেছিল, চিত্তের একটা অসুস্থতা; সর্বত্রই যেন সে বিভীষিকা দেখছে, আর তা থেকে পালাতে গিয়ে বারবার ডুব দিচ্ছে ভাবালুতার পাতালে। সূর্যকে সে বলছে—"হে সূর্য, তুমি তো জানো আমাদের গরম  কাপড়ের কত অভাব!" সে দেখছে, অসহায় সিঁড়িকে পা দিয়ে পিষে মারছে "গর্বোদ্ধত অত্যাচারী," "মৌন মূক কলম"কে দিয়ে কলঙ্কময় দাসত্ব করিয়ে নিচ্ছে হৃদয়হীন লেখক; সে উত্তেজিত করছে সিগারেটকে "হঠাৎ জ্ব'লে উঠে বাড়িসুদ্ধ পুড়িয়ে" মারতে, "যেমন করে তোমরা আমাদের পুড়িয়ে মেরেছ এতকাল;" সে কাঁদছে ডাকঘরের রানারের দুঃখে— "পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া!" (ছুঁতে পারলে কি ভালো হ'তো?) [...] কোনো মতবাদের দাসত্ব স্বীকার করলে, শক্তিশালী কবিরও কী-রকম অপমৃত্যু ঘটে, তারই উদাহরণ সুকান্ত [...] কবির কায়িক মৃত্যু যত দুঃখের, তার মানসিক পক্ষাঘাত কি তার চেয়ে কম?'
 
বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর বহুমুখী অবদান স্বীকার করেও এই তরলমতি মূল্যায়নের সঙ্গে কিছুতেই একমত হওয়া যায় না। নিজের সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় সুকান্তের দুটি কবিতা তিনি ছেপেছিলেন। আধুনিক বাংলা কবিতা নামের কাব্য-সংকলনে গ্রহণ করেছিলেন তিনটি কবিতা। কিন্তু এই উদার গুণগ্রাহিতা এবং সুকান্তের প্রতি অগ্রজসুলভ মমতাও মুক্ত রাখতে পারেনি তাঁর দৃষ্টিকে। 'মতবাদের দাসত্ব'কে ধিক্কার দিতে গিয়ে তিনি নিজেই শিকার হয়েছেন অন্য একটি সংকীর্ণ মতবাদের, যার নাম 'কলাকৈবল্যবাদ।' আমরা জানি, সাধারণভাবে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার ইতিহাস গণনা করা হয় উনিশ শতকের মধুসূদন থেকে। আধুনিকতার দ্বিতীয় পর্যায় ধরা হয় বিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে—জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু এবং বিষ্ণু দে যার ঘোষিত প্রতিনিধি। নিঃসন্দেহে বুদ্ধদেব ছিলেন তিরিশি আধুনিকতার সবচেয়ে সরব, সক্রিয় মুখপাত্র। তবে এই কালপর্বে এসে বাংলা কবিতায় 'আধুনিকতা' আর 'আধুনিকবাদ' একাকার হয়ে গিয়েছিল। উনিশ শতকের শেষের ও বিশ শতকের গোড়ার দশকগুলোতে শিল্প-সাহিত্যের কিছু আভাঁ-গার্দ আন্দোলন থেকে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে আধুনিকবাদ তার আকার পায়। সাগরপারের সেই গাছ থেকে বীজ এনে বাংলা সাহিত্যের জমিতে তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিরিশের কবিরা। তিরিশের দশকেই বাংলা কবিতায় ফ্রয়েডবাদ, প্রতীকবাদ এবং কিছু পরিমাণে হলেও ইমেজবাদ ও পরাবাস্তববাদ জায়গা করে নিয়েছিল।
ইউরোপীয় আধুনিকবাদের মধ্যে কলাকৈবল্যবাদের একটি উপস্রোত গোড়া থেকেই প্রচ্ছন্ন ছিল। এর আদি উৎস পাওয়া যাবে ইমানুয়েল কান্ট, ফ্রিডরিশ শেলিং, ইয়োহান উলফগ্যাং ফন গোয়েটে এবং ফ্রিডরিশ শিলারের মতো জার্মান রোম্যান্টিকদের শিল্পাদর্শে। কলাকৈবল্যবাদের এই পিতৃপুরুষদের ধ্যান-ধারণাগুলো ধীরে ধীরে ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও ফ্রান্সে ছড়িয়ে যায়। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে তেয়োফিল গোতিয়ে ফ্রান্সে 'শিল্পের জন্য শিল্প' মতবাদকে জনপ্রিয় করে তোলেন। শার্ল বোদল্যের, আর্তুর র‌্যাঁবো ও স্তেফান মালার্মে এবং তাঁদের প্রতীকবাদী সতীর্থরা এই ভাবধারাকে সাদরে বরণ করে নেন। ইংল্যান্ডে কলাকৈবল্যবাদের পুরোধা হিসেবে আবির্ভূত হন অক্সফোর্ডের অধ্যাপক ওয়ালটার পেইটার। 'জীবন নয়, শিল্প। শিল্পকেই আবাহন করতে হবে জীবনের বিকল্প হিসেবে' —এই আকাঙ্ক্ষা কলাকৈবল্যবাদীদের যাবতীয় শিল্প-প্রয়াসে বিম্বিত হয়েছে। তার পরিণতিতে কখনো কখনো শিল্প ও জীবনের যোগ নিদারুণভাবে ছিন্ন হয়েছে, জীবনের সচল প্রবাহ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে নন্দনবাদীরা বাসা খুঁজেছেন শিল্পের কল্পহর্ম্যে। ভিলিয়ার্স দ্য লা'আইল-অ্যাডামের Axel (১৮৯০) উপন্যাসের নায়ক একবার বলেছিল : 'বাঁচা? সে তো চাকর-বাকররাই আমাদের হয়ে করে দেবে।' ঐহিক জীবনের প্রতিদিনের সাধারণ অনুষঙ্গগুলো এই দিব্যালোকসন্ধানী রূপদর্শীদের কাছে মনে হয়েছে অসার, স্থুল, পরিত্যাজ্য। বাংলা সাহিত্যে আধুনিকবাদের যাজ্ঞিক বুদ্ধদেব বসু প্রাণভরে টেনে নিয়েছিলেন ইউরোপীয় কলাকৈবল্যবাদের আরক। তাই তিনি অকপটে বলতে পেরেছেন :
 
তাই বলি, জগতেরে ছেড়ে দাও, যাক সে যেখানে যাবে; 
হও ক্ষীণ, অলক্ষ্য, দুর্গম, আর পুলকে বধির।
 
এই নন্দনতাত্ত্বিক অবস্থান থেকে কমিউনিস্ট সুকান্তের রাজনীতিলিপ্ততাকে কী করে অনুমোদন করতে পারেন তিনি! সত্য যে, ইতোমধ্যে সময় অনেক এগিয়েছে, তবে তিরিশি আধুনিকবাদের কিছু রূপবদল ও ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে কলাকৈবল্যবাদের বিভিন্ন স্রোত-অন্তঃস্রোত এখনো বয়ে চলেছে বাংলা কবিতায়। যাঁরা এই মতবাদের পোষক, তাঁদের কাছে সুকান্তের কবিতা সবসময় গলার কাঁটা হয়েই থাকবে।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯২৬ সালের ১৬ আগস্ট আর মৃত্যু ১৯৪৭ সালের ১২ মে তারিখে। এই অকালমৃত্যুর কারণ ছিল তখনকার দিনের দুরারোগ্য ব্যাধি যক্ষ্মা। তাঁর পরিবার কলকাতায় স্থিত হলেও আদিনিবাস বৃহত্তর ফরিদপুরে। পিতা নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন একজন পুস্তক ব্যবসায়ী ও প্রকাশক। বেলেঘাটার দেশবন্ধু হাই স্কুলে পড়ার সময় শিখা পত্রিকায় সুকান্তের প্রথম কবিতা ছাপা হয়। ১৯৪১-৪২ সালেই প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যোগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুগপৎ ছাত্র আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট পার্টির কাজে সক্রিয় হন তিনি। ১৯৪৩ সালের শুরুতে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে 'কিশোর বাহিনী' নামে যে কিশোর সংগঠন গড়ে ওঠে, তিনি তার কর্মসচিব ছিলেন। মন্বন্তরের সময় পার্টির পত্রিকা জনযুদ্ধ-এর সংবাদদাতা হিসেবে সুকান্ত জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। তখন 'ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘে'র উদ্যোগে প্রকাশিত সংকলন আকাল সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি। 
সুকান্তের কবিজীবনের বিস্তার ছিল মাত্র সাত বছর। চৌদ্দ থেকে একুশ বছর বয়স পর্যন্ত। বেঁচে থাকতে তাঁর কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। মৃত্যুর পর একে একে বের হয় কবিতার বই ছাড়পত্র (১৩৫৪), ঘুম নেই (১৩৫৫) এবং পূর্বাভাস (১৩৫৭)। তিনটি বইয়ের কবিতা ও অন্যান্য রচনা একত্র করে সুকান্ত সমগ্র প্রকাশিত হয় ১৩৭৪ সালে।
চল্লিশের দশকে লিখতে শুরু করলেও তার অব্যবহিত আগের দশকে বাংলা কবিতায় আধুনিকবাদের যে কাড়ানাকাড়া বেজেছিল তা সুকান্তের মনে তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। তিরিশের সাহিত্য যতটুকু নিচুতলার মানুষের জীবনের দিকে ঝুঁকেছিল ততটুকুতেই তাঁর আগ্রহ ছিল। কেউ কেউ তাঁর কবিতায় বিষ্ণু দে ও সুধীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত কিছু শব্দ ও উপমা লক্ষ করেছেন, কিন্তু তা তেমন তাৎপর্যপূর্ণ কিছু নয়। বরং তিনি স্থিত ছিলেন বাংলা কবিতার বৃহত্তর ঐতিহ্যে। তাঁর প্রাণের টান ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রতি। নিজের সংক্ষিপ্ত কবিজীবনে মোট চারটি কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। সেইসঙ্গে লিখেছেন সূর্যপ্রণাম নামে একটি কাব্যনাটক। চেতনা ও প্রকরণের দিক থেকে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেও তাঁর আত্মীয়তা ছিল। 'ছন্দ ও আবৃত্তি' নামের একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন :
 
নজরুলের ছন্দে ভাদ্রের আকস্মিক প্লাবনের মতো যে বলিষ্ঠতা দেখা দিয়েছিল তা অপসারিত হলেও তার পলিমাটি আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে সোনার ফসল ফলানোয় সাহায্য করবে।

সুকান্তের কবিতায় ছন্দের স্বতঃস্ফূর্ত ও উচ্ছল প্রবাহ যে সোনার ফসল ফলিয়েছিল, তার প্রাণরস এসেছিল এই মহাকায় পূর্বসূরিদের উদার উৎস থেকেই। আর আধুনিকতার বোধ তাঁর মধ্যেও ছিল, তবে তা প্রকাশ পেয়েছিল ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে নিজ দেশ ও কালের পরিপ্রেক্ষিতে নবায়িত করার এক বলিষ্ঠ তাগিদের মধ্য দিয়ে। তীক্ষ্ণধী বামপন্থী চিন্তক রণেশ দাশগুপ্ত সুকান্তের এই চেতনাকে বলেছেন 'ভবিষ্যৎবাদী আধুনিকতা।'
তবে এ কথাও প্রাসঙ্গিক যে, উত্তাল চল্লিশের দশক বাংলা কবিতার ভুবনে এমন একটি নতুন রাজনীতিস্পৃষ্ট ধারা সৃষ্টি করেছিল যা তিরিশের ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিদ্রোহ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদের উত্থান ও দুনিয়াজুড়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-সংগ্রাম, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ক্রমাগত তীব্র হয়ে ওঠা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং এখানে বামপন্থার বিস্তার সমাজ-রূপান্তরের স্বপ্নে মঞ্জরিত এই নতুন কাব্যধারার পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল। দিনেশ দাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, গোলাম কুদ্দুস এবং আরও অনেকেই নিয়ে এসেছিলেন এই ভিন্ন সুর। সমর সেন তো আগে থেকেই ছিলেন। যাঁর যাঁর শক্তি ও কুশলতা অনুযায়ী কবিতাকে তাঁরা দায়বদ্ধ করতে চেয়েছিলেন সমাজের কাছে, মেটাতে চেয়েছিলেন দেশকালের দাবি। সুকান্ত এঁদেরই সহযাত্রী হয়েছিলেন তাঁর অপূর্ব বস্তুনির্মাণক্ষমাপ্রজ্ঞা নিয়ে। তবে তাঁর বলিষ্ঠ প্রত্যয়ের অকৃত্রিম, সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রকাশ তাঁকে অন্যদের থেকে বিশিষ্ট করে তুলেছিল দ্রুত।
আবার ফিরে আসি সমালোচকদের কথায়। বুদ্ধদেব বসু সুকান্তের কবিতায় যে ভাবালুতার অভিযোগ তুলেছিলেন, যে অপরিণতির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তা কতটুকু বস্তুনিষ্ঠ? শব্দের এমন হৃদয়-নিঃসৃত সহজ উৎসার এবং স্বচ্ছ বাণীর এমন টানটান ঋজুতাকে কি ভাবালুতা বলা যায়? যে কবি এমন অবলীলায় প্রাত্যহিক জীবনের অনুভবকে নবজন্ম দিতে পারেন আশ্চর্য ঝংকৃত কবিতায়, তাঁকে কেন অপরিণত বলব আমরা? তাকাই না আবার একটু সুকান্তের কবিতার দিকে। এক নিরন্ন-রক্তাক্ত-ক্ষুব্ধ উপনিবেশের সন্তান হিসেবে কী অসাধারণ সরল, নির্মেদ ও মর্মভেদী তাঁর উচ্চারণ :
 
অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।
অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন
অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন;
অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো—
দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারো।
অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার
দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার।
হিসেবের খাতা যখনই নিয়েছি হাতে
দেখেছি লিখিত—'রক্ত খরচ' তাতে,
(অনুভব)
 
মন্বন্তরক্লিষ্ট, দুঃখী স্বদেশের যে হৃদয়স্পর্শী ছবি তিনি এঁকে গেছেন, এত বছর পরেও তো মনে হয় সে ছবি কোনো দূর অতীতের নয়, আজকের কিংবা গতকালের :
 
এখানে মৃত্যু হানা দেয় বারবার;
লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে জমেছে অন্ধকার।
এই যে আকাশ, দিগন্ত, মাঠ স্বপ্নে সবুজ মাটি
নীরবে মৃত্যু গেড়েছে এখানে ঘাঁটি;
কোথাও নেইকো পার
মারী ও মড়ক, মন্বন্তর, ঘন ঘন বন্যার
আঘাতে আঘাতে ছিন্নভিন্ন ভাঙা নৌকার পাল
এখানে চরম দুঃখ কেটেছে সর্বনাশের খাল,
ভাঙা ঘর, ফাঁকা ভিটেতে জমেছে নির্জনতার কালো
হে মহামানব, এখানে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালো।
(বোধন)
 
১৯৪৬-এর যে ভয়াবহ দাঙ্গার দুঃসহ স্মৃতি এখনো তাড়িয়ে ফিরছে কয়েকটি প্রজন্মকে, তার তীব্রতার মধ্যে বসে লেখা কবিতায় পাই অবরুদ্ধ, অসহায় মানুষের স্তব্ধ প্রতীক্ষার আর্তি :
 
সন্ধ্যা থেকে প্রত্যুষের দীর্ঘকাল
প্রহরে প্রহরে
সশব্দে জিজ্ঞাসা করে ঘড়ির ঘণ্টায়
ধৈর্যহীন শহরের প্রাণ :
এর চেয়ে ছুরি কি নিষ্ঠুর?
(সেপ্টেম্বর '৪৬)
 
ছোটগল্পের কৌশল ব্যবহার করে লেখা কবিতাগুলোতে যেমন আছে সংহত ঋজুতা, তেমনি আছে শানিত, চাপা ব্যঙ্গের ঝিলিক। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে :
 
খাবার! খাবার! খানিকটা খাবার!
অসহায় মোরগ খাবারের সন্ধানে
বারবার চেষ্টা ক'রল প্রাসাদে ঢুকতে,
প্রত্যেকবারই তাড়া খেল প্রচণ্ড।
ছোট্ট মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে— 
'প্রাসাদের ভেতর রাশি রাশি খাবার'!
 
তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল,
একেবারে সোজা চলে এল
ধবধবে সাদা কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে;
অবশ্য খাবার খেতে নয়—
খাবার হিসেবে।
(একটি মোরগের কাহিনী)
 
দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার যাবতীয় ক্লেশ এবং যাতনার মধ্যেও তিনি দেখতে ভুলেননি জনজীবনের চিরকালীন ছন্দ এবং ছড়ানো সৌন্দর্য ও আশার আয়োজন। কোনো সূক্ষ্ম-জটিল বাকপ্রতিমার সাহায্য ছাড়াই তাকে রূপ দিয়েছেন অনুপম নিরাভরণ ভাষায় :
 
দুর্ভিক্ষের আঁচল জড়ানো গায়ে
এ গ্রামের লোক আজো সব কাজ করে, 
কৃষক-বধূরা ঢেঁকিকে নাচায় পায়ে
প্রতি সন্ধ্যায় দীপ জ্বলে ঘরে ঘরে।
... ...  ... 
হঠাৎ সেদিন জল আনবার পথে
কৃষক-বধূ সে থমকে তাকায় পাশে,
ঘোমটা তুলে সে দেখে নেয় কোনোমতে,
সবুজ ফসলে সুবর্ণ যুগ আসে।।
(চিরদিনের)
 
বিশৃঙখল ও বিমূঢ় অথচ মুক্তিকামী মানুষের কাছে ইতিহাসের পক্ষ থেকে তাঁর মহাজাগতিক বার্তা :
 
মনে রেখো, দেরি হয়ে গেছে, অনেক অনেক দেরি।
আর মনে ক'রো আকাশে আছে এক ধ্রুব নক্ষত্র,
নদীর ধারায় আছে গতির নির্দেশ,
অরণ্যের মর্মরধ্বনিতে আছে আন্দোলনের ভাষা,
আর আছে পৃথিবীর চিরকালের আবর্তন।।
(ঐতিহাসিক)
 
প্রচলিত বিদ্যায়তনিক নন্দনতত্ত্বের ছুরি দিয়ে খণ্ড খণ্ড করে বিচার করতে গেলে সুকান্তের কবিতার সৌন্দর্যকে বোঝা যাবে না। তাকে পাওয়া যাবে ছন্দ, বাকপ্রতিমা, ব্যঞ্জনা এবং অর্থের সমগ্রতায়। তাঁর কবিতায় কী কী নেই এবং দীর্ঘায়ু হলে এই 'কবি-কিশোর' আরো কী কী হয়ে উঠতে পারতেন, সে ভাবনাও কাজের কিছু নয়। সামান্য আয়ুর পরিসীমায় তিনি যা রেখে গেছেন তা তাঁর নিজের সময়ের দাবি মিটিয়ে উত্তরকালের জন্য কোনো স্থায়ী মূল্য সৃষ্টি করতে পেরেছে কিনা সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
চোখ-ধাঁধানো নতুন সব তত্ত্বে পরিকীর্ণ এই সময়ে, ভাষা আর চিহ্নের নানা জটিল খেলায় মত্ত এই পৃথিবীতে সুকান্তের মতো বিগতদিনের সরল রাজনৈতিক কবির কবিতা কেন পড়ব—এই প্রশ্ন  যদি কেউ তোলেন, তাহলে তো তাঁকে ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি, পল এল্যুয়ার, লুই আরাগঁ, নাজিম হিকমত, পাবলো নেরুদা এবং ফয়েজ আহমদ ফয়েজের মতো কবিদের উজ্জ্বল ঐতিহ্যকে অস্বীকার করতে হবে। সংগ্রাম ও উপপ্লবের যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা এ লেখার শুরুর দিকে বলেছিলাম, আবার সেখানে ফিরে যেতে চাই। এ ধরনের অভিজ্ঞতা কি এই ভূখণ্ডের কয়েকটি প্রজন্মের সামষ্টিক জীবনের অংশ নয়? সুকান্তের কবিতা কি বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও মৃত্যুর অনেক মহালগ্নের সঙ্গে জড়িয়ে নেই? একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা কি পেরিয়ে আসিনি অনেক মারি-মন্বন্তর-লড়াইয়ের দীর্ঘ, বন্ধুর পথ? এবং এখনো কি এই কাঁটাছড়ানো পথেই নিরন্তর রক্তমাখা পায়ে সামনে এগোতে হচ্ছে না আমাদের? এইসব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই তো রয়েছে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রাসঙ্গিকতা।


•  কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক, বাংলাদেশ।

menu
menu