আল মাহমুদের কবিতা : শিল্প ও লোক-নন্দনের ঐকতান 

কবিতা মানুষের অন্তরীণ চেতনার পরম প্রকাশ। এই প্রকাশ স্বতঃস্ফূর্ত বা সচেতন দু’ভাবেই হতে পারে এবং দুদিকের সপক্ষেই বিস্তর যুক্তি তর্ক রয়েছে। অধিকাংশ কবি-শিল্পীগণ মনে করেন, কবিতা বিশেষ মুহূর্তের স্বতোৎসারিত পঙ্ক্তিমালা। সংখ্যায় অল্প হলেও কতক কবি মনে করেন বুদ্ধি, মনন ও অনুধ্যান ব্যতীত মহৎ কবিতার সৃষ্টি হতে পারে না। জ্যাঁ পল সার্ত্র বলেছেন : ‘স্বয়ংক্রিয় লেখাকে আমি কোন দিনই ঠিকমতো গ্রহণ করিনি। কিন্তু খেলার খাতিরেই খেলাটা উপভোগ করেছিলাম মাত্র।’ কবিতার ভাব কিংবা চিন্তাসূত্র কবিকে আকর্ষণ করবে, কখনও পর্যুদস্ত করবে; স্বত:স্ফূর্ত সেসব পঙ্ক্তিমালা বেরিয়ে আসবে তারপর বিশেষ স্থির মুহূর্তে কবি সেই উচ্ছ্বসিত বাকমালাকে শিল্পের বিবিধ অনুশীলনে পরিমার্জনে পরিবেশনযোগ্য করে তুলে ধরবেন। বহুল পঠিত চর্চিত কবিতাগুলো এরূপেই সৃজিত হয়ে থাকে এবং উন্নত কবিতার সৃজন-প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিশেষ কবি ও সমালোচকমণ্ডলি স্বল্প-শব্দে এভাবেই জ্ঞান করেছেন।

আল মাহমুদ বাংলা ভাষার একজন বড় কবি। একজন বড় কবির কবিতায় যে শিল্প-সম্পন্নতা, ছন্দশীলন, আত্মবোধ, বৈচিত্র্য, জাতীয়তাবোধ, প্রেম ও পরিপার্শ্বভাবনা এবং বিশ্ববীক্ষা প্রয়োজন তার সবই তাঁর কবিতায় সযত্নে প্রযুক্ত রয়েছে। একটি-দুটি বা পাঁচটি ভালো কবিতার জন্য আমরা কোনো কবিকে বড় কবি বলতে পারি না; একজন বড় কবি অনেক  মহৎ কবিতার জন্ম দেবেন, সেটা শতাধিকও হতে পারে । আমরা আল মাহমুদ এর কবিতাসমগ্রে শতাধিক উন্নত কবিতার সন্ধান পাবো, পাবো শত শত মহার্ঘ পঙ্ক্তিমালা। তাঁর কবিতা পড়তে গিয়ে, কবিতার রচনা প্রক্রিয়া নিয়ে আপনার  প্রশ্ন জাগবে, আসলে কী স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাক্য এমন নন্দন-বিভায় অনুপম হয়ে উঠতে পারে! অবশ্যই না। প্রবল ভাবোচ্ছ্বাস তাঁকে হয়ত প্রেরণাটুকু দিয়েছে কিন্তু কবির নির্মিতিবোধ, সতর্কতা, মনন ও শব্দ-সক্ষমতা অপূর্বরূপে এই দেহ সৌষ্ঠব সৃষ্টিতে  ভূমিকা রেখেছে। ‘বাঙালি কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী / জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী।’( সোনালি কাবিন-২)
স্বত:স্ফূর্ততা, ভাবোচ্ছ্বাস, বুদ্ধি, মনন, সতর্কতা, ছন্দবোধ, ইতিহাস-বীক্ষণ, শিল্পচেতনা, সমাজ ও বিশ্বভাবনার অনুপম আশ্রয়ে আল মাহমুদের কবিতা হয়ে উঠেছে বিচিত্র ও অভিনব। 

(দুই)
ইভান তুর্গেনেভ মনে করতেন—সাহিত্যকর্মের জন্য একজন প্রতিভাবানের নিজস্ব কণ্ঠস্বর আবশ্যক। বস্তুত নিজস্ব কণ্ঠস্বর ব্যতীত কোনো লেখকই তার অবস্থানকে সংহত করতে পারে না। এই নিজস্বতা হচ্ছে—তার প্রবণতা, ভাবধারা, সৃজন প্রক্রিয়া, বিচরণ-ক্ষেত্র কিংবা নির্মাণশৈলী যা অন্যদের থেকে তাকে  বিশেষভাবে উপস্থাপন করে; এটি কাব্য, চিত্র, চলচ্চিত্র বা শিল্পকলার যেকোনো মাধ্যমের জন্যই তাৎপর্যপূর্ণ। আল মাহমুদ বাংলা কবিতায় নিজস্ব স্বরভঙ্গি ও নির্মাণশৈলী  অর্জনে সক্ষম কবিদের একজন, যাঁরা দারুণ মুন্সিয়ানায় নিজেদের প্রকাশ করার পাশাপাশি বাংলা কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন। এখানে প্রসঙ্গ বিবেচনায় বাংলা ভাষার পূর্ববর্তী কয়েকজন বড় কবি সম্পর্কে দু’কথা বলতে চাই যা বাংলা কাব্যধারায় আমাদের উদ্দিষ্ট কবির অবস্থান ও অর্জনকে প্রকাশে গুরুত্ব বহন করবে। 

মাইকেল মধুসূদন দত্ত এঁর মাধ্যমে বাংলা কবিতা আধুনিকতায় প্রবেশ করে। তিনি সনেট, অমিত্রাক্ষর ছন্দসহ বাংলা কবিতায় বহু আধুনিক অনুষঙ্গের সংযুক্তি ঘটান। বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি তিনি। অবশ্য এই  আধুনিক অবিধা যে বিভিন্ন বিষয়বস্তু আমদানির জন্য তা নয় বরং তিনিই প্রথম রাজা-রাজড়া, দেব-দেবী-মূর্তি, তোষণ-পরিতোষণের বাইরে এসে নিজের দিকে চেয়েছেন, মানুষের কথা এনেছেন, কবিতার পটভূমে ঠাঁই দিয়েছেন অনেক ক্ষুদ্র তুচ্ছ-অচ্ছুৎ বিষয়বস্তুকে এমনকি ‘রসাল ও স্বর্ণলতিকা’ পর্যন্ত তাঁর কবিতায় ভাষা পেয়েছে এবং এজন্যই তিনি আধুনিক। 

‘মুকতা ফলের লোভে ডুবে রে অতল জলে
যতনে ধীবর
শত মুক্তাধিক আয়ু কালসিন্ধু জলতলে
ফেলিস পামর। 
ফিরে দিবে হারাধন কে তোরে, অবোধ মন,
হায়রে ভুলিবি কত আশা কুহক-ছলে! ’

প্রথম সার্থক মহাকাব্য ‘মেঘনাধব কাব্য’-এর রচয়িতা মধুসূদন বাংলা ভাষার প্রথম আধুনিক কবি এবং  কাব্যবোধ ও শিল্প-সম্পন্নতার দিক থেকে একজন বড় কবি। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষার সবচেয়ে প্রভাবশালী শিল্পী পুরুষ; সেটা গানে, কবিতায়, গল্পে এবং প্রায় সবখানে। প্রথম দিকে তিনি রোমেন্টিক ধারার গীতিকবিতা রচনা করেছেন। তাঁর সেসব কবিতায় সুর চারিয়ে  দিলেও শুনতে বেশ হবে। গীতবিতানের টেক্সটগুলোকে কবিতা হিসেবেও পড়া যায়, প্রতিটির মধ্যে গীতিময়তার পাশাপাশি রয়েছে গভীর চিন্তা, সৌন্দর্য এবং দর্শনের নিবিড় অবস্থিতি। তিনি প্রচুর কবিতা লিখেছেন, শেষ দিকের গদ্য কবিতাগুলোর মধ্যেই তাঁর আধুনিক জীবন ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে। বিচিত্র বিষয়, সমাজ সংসারের বর্ণিল অভিজ্ঞতা এবং দীর্ঘ শিল্পী-জীবনের সারাৎসার তাঁর কবিতাকে উন্নত ও শিল্পীত করেছে। 

পূর্বে দু’চারটি কবিতা প্রকাশিত হলেও ১৯২১ সালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রমত্ত নিশান উড়িয়ে বাংলা কবিতায় আবির্ভাব ঘটে এক তরুণের তাঁর নাম কাজী নজরুল ইসলাম। এই আগমন হঠাৎ বজ্রবিদ্যুতের মতো শাণিত, চমকজাগা এবং একেবারেই পূর্বাভাসহীন। কবিতা লিখে মুহূর্তের মধ্যে এমন ছড়িয়ে পড়া, দৃষ্টি আকর্ষণ করা বাংলা কবিতায় আর ঘটে নি, বিশ্ব কবিতায় এমন নজির আছে কিনা সেটা গবেষণার বিষয়। সেই  সময়টা ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে গভীরভাবে মজ্জমান। নজরুল উত্তুঙ্গ আগুনজ্বালা শব্দ-সামন্ত নিয়ে সেই ঘুম ঘুম আবেশ ভাঙলেন। তাঁর কবিতার মধ্যে ব্রিটিশ ভারতের বিদ্রোহের কথা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি কেবল  সমাজ বিদ্রোহের কবি নয়, কবি তিনি ভাষা বিদ্রোহেরও। বাংলা ভাষা যে এত প্রবল, এমন সশস্ত্র, বর্মশীল ও শক্তিমত্ত হতে পারে সেটা প্রথম দেখিয়েছেন নজরুল ইসলাম। সাম্যবাদ, বিদ্রোহী, তারুণ্য, প্রেম, জাতীয়তাবোধ এবং প্রবল প্রাণোচ্ছ্বাসে নন্দিত নজরুল ইসলামের কবিতা বাংলা সাহিত্যের অনিবার্য পাঠ। 

জীবনানন্দ দাশ বাংলা ভাষার আরেক মহৎ কবি প্রতিভা। তাঁর সময়কালে আরও কতক কবি নতুন ধারায় কবিতা রচনায় সচেষ্ট হলেও তিনিই সফল হয়েছেন বেশি। বাংলার বিজন প্রকৃতির নিবিড় রূপের পাশাপাশি নগর জীবনের হতাশা, নিঃসঙ্গতা, বিচ্ছিন্নতা, বিষাদ ও বিপন্নতা তাঁর অভিনব কাব্যভাষ্যে নন্দিত হয়ে উঠেছে। জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর একটি মন্তব্য তুলে ধরছি “জীবনানন্দ প্রকৃত কবি ও প্রকৃতির কবি। আমাদের কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ সবচেয়ে কম-আধ্যাত্মিক, সবচেয়ে বেশি শারীরিক তাঁর রচনা সবচেয়ে কম বুদ্ধিগত, সবচেয়ে বেশি ইন্দ্রিয়-নির্ভর। তাঁর একটি কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন ‘চিত্ররূপময়’ জীবনানন্দের সমগ্র কাব্য সম্বন্ধেই এই আখ্যা প্রযোজ্য।” তাঁর কবিত্বের ওপর ইংরেজ কবিদের ব্যাপক প্রভাব থাকলেও তিনি বাংলা ভাষার একজন বড় কবি। ভাষা এমন চিত্ররূপে, নিসর্গের সুষমা এমন মধুর স্বরে, আত্মবঞ্চনা এমন মগ্নচৈতন্যে জীবনানন্দের কবিতার  মতো আর কোথাও আসন পাতেনি। ভাষণের চেয়ে দৃশ্য তাঁর কবিতায় অধিক প্রাণবন্ত। 

আল মাহমুদের কবিতা আলোচনার সাথে ঘনিষ্ঠ বিবেচনায় পল্লীকবি জসীম উদ্দীন সম্পর্কেও এখানে দুকথা বলা জরুরি । বাংলার লোকজীবন ও সংস্কৃতি জসীম উদদীন-এর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। তিনি গ্রাম বাংলার জনমানুষের কথা বলতে গিয়ে তাঁদের কথ্য শব্দকেই ব্যবহার করেছেন। কোন কৃত্রিম আভরণ তিনি যোগ করেন নি বরং গ্রাম বাংলার লতাগুল্ম-ফুল-পাখি-মাছ-নাও-নাদীকেই তিনি কবিতায় ঠাঁই দিয়েছেন। সাদা কথা তিনি স্পষ্ট করে বলেন। কোন ভণিতা বা ছলনা তাঁর পল্লীমগ্নতাকে আকীর্ণ করতে পারে নি। ফলে সহজেই তিনি জনমানুষের কাছে পৌঁছুতে পেরেছেন। কবর, রাখালী, মুসাফির, প্রতিদান এসব তাঁর বিখ্যাত কবিতা। জসীম উদ্দীন-এর  ভাষা অন্য সকলের থেকে ভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন এজন্য তাঁকে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর নিজস্বতা লোক-মানুষের কথকতার মতোই প্রাণবান। আল মাহমুদ এর অবস্থান জীবনানন্দ দাশ এবং জসীম উদ্দীন এর মাঝামাঝি। তাঁর অধিকাংশ কবিতার পটভূমি গ্রাম কেন্দ্রিক আবহ নিয়ে হলেও তাঁর উপস্থাপনা একবারেই আধুনিক। নাগরিক মানুষের মধ্যে গ্রামীণ জীবন ও নিসর্গের প্রতি গভীর অনুরাগ এবং সেজন্য তারা বারবার গ্রাম, নদী ও  নিসর্গের দিকে পর্যটন করে; নগরের মানুষের এই অনুরাগকে  আরও উস্কে  দিয়েছেন আল মাহমুদ। এটি তার কবিতার প্রতি নগর-মানুষের প্রীতির একটি বড় কারণ। হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য ও উপাদান, কৃষ্টি ও লোকাচার, প্রাচীন ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ গ্রীক ও বিভিন্ন মিথ-উপকথা-লোককথার সারাৎসারসহযোগে আল মাহমুদ এক ধ্রুপদী কাব্যভাষা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন যা কেবল বিচিত্র লোক-আঙ্গিকের সমবায়ে পূর্ণ নয় বরং শিল্পকলার নান্দনিক অভিরূপেও প্রাণময়। তাঁর কবিতা সম্পর্কে মাহমুদা পারভীন এর মন্তব্য হচ্ছে ‘ইউরোপীয় ঢংয়ে দেশীয় অনুষঙ্গে নির্মিত চিত্রকল্প এবং উপমা আল মাহমুদ এর কবিতার অমূল্য সম্পদ।’ আল মাহমুদের গ্রাম শোভায় পরিপূর্ণ। তিনি গ্রামের সুন্দর সজীব দিনমানকে তার নদী-নিসর্গকে সযত্নে তুলে এনেছেন নগরবাসীর সামনে; গ্রামের অশিষ্টতাকে গভীর অনুরাগস্নানে শুদ্ধ করে তুলতেও তিনি যে বড় কাতর ছিলেন, সেই দরদ তাঁর অনেক কবিতায় উঠে এসেছে। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছেন : ‘আল মাহমুদের গ্রাম মুগ্ধতার সংকট কেটে গেছে হৃদয়  ও বুদ্ধির যৌথ প্রয়োগে। আল মাহমুদ এর  শক্তি তাঁর কবিতার গভীরতায় ও আন্তরিকতায় এবং সমগ্র কবিতাকে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করেছে।’ 

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীর বিস্তার ও বিপুলতা এদেশের মাটিকে করেছে উর্বরা । এদেশের অর্থনীতিও একসময় নানাভাবে নদীনির্ভর ছিল, সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গজুড়ে নদীর প্রসঙ্গও নদীর সৌন্দর্যের পাশাপাশি তার অবদানকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। আল মাহমুদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা তিতাস নদীর পাড়ে, তিতাসের উছলে পড়া ঢেউ, এ নদীকে কেন্দ্র করে মানুষের যাপনপ্রবাহ বারবার আমরা তাঁর কবিতায় প্রকাশ হতে দেখি । আজ তিতাস সেরূপে না থাকলেও আল মাহমুদের কবিতা পড়ে বা অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাসে আজও আমরা তিতাসের সেই অপরূপ শোভা অনুভব করতে পারি । আল মাহমুদের লোক-সম্প্রীতি ও নদীর প্রতি অতি-আকর্ষণ বিষয়ে মহীবুল আজিজ এর একটি মন্তব্য এখানে উল্লেখ করছি : ‘বাংলাদেশের মানুষ, প্রকৃতি ও ঘটনাপুঞ্জ আল মাহমুদের কাব্যবিশ্বের মৌল উপাদান । প্রকৃতি তাঁর কাব্যে আরও পূর্ববঙ্গময় হয়ে উঠেছে নদীর মুহুর্মুহু আবির্ভাবে। তিতাসের সক্রিয়তা তাঁর কবিতাকে করে সজিব, নবপলিময় ও অতিগৌরবী ।’

কবি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে কর্মরত ছিলেন এর ফলে শিল্পকলার বিভিন্ন ধারা, উপ-ধারা সম্পর্কে তাঁর প্রতীতি তৈরি হয়, যা তাঁর কবিতাকে শিল্পীত ও নন্দিত হতে সহযোগিতা করেছে। কবির ভাষ্য থেকেই এ বিষয়ে কিঞ্চিৎ পাঠ নিচ্ছি : ‘শিল্পকলা একাডেমিতে সঙ্গীত, চারুকলা, নাট্যকলা, নৃত্যকলা বিষয়ে শিল্পীদের সঙ্গে আমার যে মাখামাখি হয়েছে তাতে আমার নানা বিষয়ে সিদ্ধিলাভ ঘটেছে। এখান থেকে শিক্ষণীয় বিষয় আমি শিখে নিয়েছি।’ বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জাতিসত্ত্বাকে কবিতায় অনুধাবনের জন্য আমাদের আল মাহমুদের কবিতার সামনে দাঁড়তে হবে। বাংলার লোকসমাজ, নদী, মৃত্তিকা, নিসর্গ, মধ্যবিত্ত জীবনের সারল্য, শস্য ও সম্ভার, কৃষ্টি ও উপকথা, সংগ্রাম ও স্বাধীনতা এমন প্রবহমান ব্যঞ্জনায় আর কোথাও ধ্বনিত হতে দেখি না। সচল প্রমিত শব্দের একঘুয়েমি দূর করতে তিনি প্রায়ই আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করতেন এবং সেটা এতটাই যথাযথরূপে হয়েছে যে, সাধারণ প্রাণপ্রবাহ রক্ষণের পাশাপাশি কবিতার আবেদনকেও তা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এই প্রক্রিয়া অবশ্য রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতার মধ্যেও লক্ষণীয়। 

জাতির লোকরূপ ও ঐতিহ্যকে ভাষাদানের জন্য, জনসমষ্ঠির আচার ও প্রথাকে তুলে আনার জন্য প্রতিটি দেশেই কেউ না কেউ কণ্ঠ তুলেছেন; বোধ করি এদেশের লোকজ কৃষ্টির প্রধান ভাষ্যকার কবি আল মাহমুদ। তাঁর কবিতার স্বরূপ ও  প্রবণতা সম্পর্কে আমিনুল ইসলাম এর একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য : “আল মাহমুদ বাঙালি জাতিসত্তার ও ঐতিহ্যের প্রধানতম কবি। তিনি বাঙালি জাতির ঐতিহাসিক-নৃতাত্ত্বিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক উৎসের সন্ধান তুলে ধরেছেন সবচেয়ে গম্ভীরভাবে, নিবিড়ভাবে এবং সবচেয়ে শিল্পসম্মতভাবে। তিনি পশ্চিমামুখী আধুনিক বাংলা কবিতাকে ফিরিয়ে এনেছেন বাংলায়, ভারতীয় উপমহাদেশে এবং এশিয়ায়। ‘দেশত্যাগী কবির হৃদয়’ কে তিনি ফিরিয়ে এনে বসিয়েছেন এশীয় এবং বিশেষ অর্থে—ভারতীয়  ভূগোলের প্রাঙ্গণে।”

লোক জীবনের পাশাপাশি নারী, প্রীতি, যৌনতা, যুদ্ধ, রীতি-প্রবাহ, আন্তর্জাতিকতা ও দেশমাতৃকাসহ বিচিত্র বর্ণিল বহু বিষয়-আশয় আল মাহমুদের কবিতায় হিরন্ময় হয়ে উঠেছে। বিচিত্র বিষয়ে প্রবল অভিপ্সা ও প্রকাশের মুন্সিয়ানা তাঁর বড় শক্তি। এ বিষয়ে মাহবুবুল হক এর মন্তব্য হচ্ছে : ‘কবি আল মাহমুদ জীবনের বিচিত্র পরিবেশের মধ্যে সৌন্দর্য ও  জীবনরস আস্বাদনে প্রয়াসী।’ বিশ শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষার্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত তাঁর কবি জীবন। এই দীর্ঘ সময় পরিক্রমায় বিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতায় প্রাচুর্যমণ্ডিত তাঁর অভিযাত্রা; যার অনুশীলনে পরিশীলনে নন্দিত তাঁর কবিতামালা। আল মাহমুদের এ যাবৎ প্রকাশিত ২৬টি কবিতাগ্রন্থের নন্দন-কাননে রয়েছে অসংখ্য স্বর্ণশোভা; যা দেশ-জাতি, প্রীতি, সৌন্দর্য, মানবতা ও ব্যক্তির মনোভঙ্গির বিবিধ স্ফূর্তি প্রকাশে চিরদিন কার্যকর থাকবে। কবির সেই অনুপম নন্দনলোক থেকে বিচিত্র বিষয়ে মার্গসূচক কিছু স্বর্ণলেখা  উদ্ধৃত করে এই রচনার পরবর্তী পর্বে  আমরা আরও ক্ষাণিক আলোচনা করতে চাই।

(তিন)
শুভ-অশুভ নির্ণয়ক এক নিপুণ নিক্তি রয়েছে মানুষের হৃদয়ে। মানুষ তার বেড়ে ওঠা পরিপার্শ্ব থেকে তার পঠন-পাঠন থেকে, হৃদয়ে এক চৈতন্য পেয়ে থাকে এবং সেটা তার কাজে কর্মে ইতিবাচক-নেতিবাচক কিংবা দ্বিধান্বিত প্ররোচনা যোগিয়ে থাকে। প্রতিটি সজ্ঞান মানুষের মধ্যেই এই চৈতন্য সক্রিয় থাকে। বিভিন্ন মুহূর্তে এই বোধ মানুষকে চরম দ্বিধায় ফেলে দেয়; সেটি কামনার পথে যাবে নাকি সেই অন্তরীণ সাড়াকে আমলে নেবে, সে ঠিক বুঝতে পারে না। এই সংকট অত্যন্ত প্রাণবন্তভাবে আল মাহমুদ- এর  প্রথম দিককার ‘বিষয়দর্পণে আমি’ শীর্ষক কবিতায় ফুঠে উঠেছে : ‘কখনো অসৎ থাবা আকস্মাৎ উত্তোলিত হলে / দেখি সেই বিম্বিত পশুর / দর্পিত হিংস্র চোখ আমাকেই লক্ষ্য করে জলে / চিবুক লেহন করে; সে অলীক মুহূর্তের ক্রোধ জয় করে দেখি আমি / কেবলই আমার মধ্যে যেন এক শিশু আর পশুর বিরোধ।’‘

প্রকৃতি’ শীর্ষক কবিতায় আমরা দেখি দারুণ শব্দ-কুশলতায় তিনি একজন কবির প্রতিকৃতি এঁকেছেন। এই বর্ণনা কোনও মহার্ঘ চিত্রকর্মকেও হার মানায় যেনো। কবির ধরণ, চলন, স্বপ্নযাপন ও উন্মুলতা সব এই কবিতায় অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে ফুঠে উঠেছে। ‘আবার দুপুরে দেখি ঘুমিয়েছে প্রাচীর ছায়ায় / কী জানি কী স্বপ্ন নিয়ে কঠিন পাথরে মাথা রেখে / সে এক অবাক লোক মুখ তার ধূসর ধূমল / কোন নারী কোনদিন তার তরে মাখেনি কাজল।’ ‘

‘আল মাহমুদ গভীর ভাবের কবি। তাঁর কবিতার ভাবগত গভীরতা, আন্তরিকতা এবং শিল্প-দক্ষতা তাঁকে বাংলা কাব্য জগতে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।’ আল মাহমুদের কবিতা সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন শাহজাহান হাফিজ। এই মন্তব্যের সহগামী অর্থাৎ ভাবের গভীরতা, আন্তরিকতা ও শিল্প-দক্ষতার অসংখ্য নিদর্শন তাঁর কবিতাগুচ্ছে পাওয়া যাবে। এখানে আদিম নিষাদ ও সমুদ্রচারী জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রকাশক কয়েক ছত্র তুলে ধরছি : ‘স্বপ্নের মতো মেয়েটিকে বলি শোন / ঢেউয়ে ভেসে গিয়ে নামবো অথৈ তলে / কেনো মিছেমিছি তটের বালুকা গোনো / নেমে এসো সাথে মানিক কুড়াবো জলে। / মেয়েগো হৃদয়ে সাগরের সুরজাল / জীবন কেটেছে কত টাইফুন ঝড়ে / জলদস্যুরা করবে যে গালাগাল / জন্ম নিয়েছি জলদস্যুর ঘরে।’ 

কবির দৃষ্টি কত সূক্ষ্ম হতে পারে আর ভাষা সেই সূক্ষ্মতাকে প্রকাশে কতটা যথার্থ হতে পারে তার অনন্য এক দৃষ্টান্ত আমরা ‘পিপাসার মুখ’ কবিতার শেষ স্তবকে খুঁজে পাই। কতটা গভীর ও তীক্ষ্ম-দৃষ্টি হলে এমন বর্ণনা সম্ভব, আপনি চমকে উঠবেন এবং আপনাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করবে এই জাদুময়তা : 

‘সতর্ক আত্মার ওপর কড়ির মতন
দুটি চোখ অনুভবের জাদু দিয়ে
পাশাপাশি সাজিয়ে রেখেছি
নিসর্গের ফাঁকে ফাঁকে যখন বিষণ্ন হাওয়ার রোদন
দুঃখের নিঃশ্বাস ফেলে, আমি সেই ধ্বনির জাদুকর।
চিতল হরিণী তার দ্রুতগামী ক্লান্তির শেষ জামে
যখন প্রস্রবণে পিপাসায় মুখ নামায়
আমি সেই জলপান শব্দের শিকারি।’

আল মাহমুদ-এর কবিতা সম্পর্কে বিপ্লব রায়-এর ভাষ্য হচ্ছে : ‘প্রতিদিনের লোভ-ক্ষোভ-রিরংসায় পর্যুদস্ত মানুষের জন্য তিনি নির্মাণ করেছেন নিসর্গশোভিত এক আশ্চর্যময় কবিতালোক। দেশজ সংস্কৃতি, লোকায়ত জীবনকে আধুনিকতার সঙ্গে সার্বিকভাবে সমন্বিত করে ঐতিহ্যের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছেন আল মাহমুদ।’ আমরা তাঁর ‘প্রকৃতি’ শিরোনামের কবিতায় দেখবো, মানুষ ও প্রকৃতির সাজুয্যতাকে কি গভীর মমতায় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। কর্দমাক্ত নরম মৃত্তিকায় ধানের চারা রোপণের সাথে এ কবিতায় তিনি নারীগর্ভে মনুষ্যজন্মের সঞ্চারণ-ক্রিয়াকে তুলনা করেছেন। আসলে মানুষ জন্ম এবং প্রকৃতির অপরাপর প্রাণী ও জীব-চরাচরে জৈবসাধন তো প্রায় একই, এই সাদৃশ্যকেই আমরা কবিতাটিতে দুর্দান্তভাবে প্রকাশ হতে দেখি :

‘কতদূর এগোলো মানুষ!
কিন্তু আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে
আজও উবু হয়ে আছি। ক্ষীরের মতন গাঢ় মাটির নরমে
কোমল ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে
ভাবলাম, এ-মৃত্তিকা প্রিয়তমা কিষাণী আমার।
বিলের জমির মতো জলসিক্ত সুখদ লজ্জায়
যে নারী উদাম করে তা সর্ব উর্বর আধার।’

‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ আল মাহমুদের অন্যতম পঠিত-চর্চিত কবিতার একটি। এই কবিতার মধ্যে তৎকালীন মুসলিম মধ্যবিত্ত জীবনের পাশাপাশি গ্রামীণ সৌন্দর্য ও সারল্য নিবিড় শব্দ-সৌকর্যে প্রকাশিত হয়েছে। দীর্ঘজীবন নগরে থেকেও গ্রামের দিকে, গ্রামের সুন্দরের দিকে কবির বিবাগী মনের বারবার প্রত্যাবর্তনের প্রবণতাকেও এই কবিতা নির্দেশ করে। সমালোচকগণ কবিতাটির মাধ্যমে আল মাহমুদের গ্রামীণ জীবনের প্রতি সখ্যের সারল্যকে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন। এই কবিতার পুরোটিই উদ্ধৃতিযোগ্য, বিশেষ অংশ এর সৌন্দর্যকে ধারণ করতে পারে না। তাঁর প্রথমদিকের কবিতাগুলোর অধিকাংশই ছন্দে লেখা। ছন্দের সার্থক প্রয়োগ, শব্দানুপ্রাসের ব্যঞ্জনা তাঁর কবিতাকে বিশেষভাবে পরিবেশনযোগ্য করে তুলেছে। কবিতার নাম ‘তোমার হাতে’: ‘তোমার হাতে ইচ্ছে করে খাওয়ার /  কুরুলিয়ার পুরোনো কই ভাজা / কাউয়ার মতো মুন্সী বাড়ির দাওয়ায় / দেখবো বসে তোমার ঘষা মাজা।’ গ্রাম-সমাজে প্রেমিকরা তীর্থের-কাকের মতো প্রেমিকার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে, আড়াল থেকে একটিবার প্রেমিকাকে দেখার জন্য। গ্রামের গোঁয়ার বালকের প্রেমের কাতরতা চমৎকারভাবে উদ্ধৃত পঙ্তিগুলোতে ছন্দে ছন্দে উঠে এসেছে। 

নির্মলেন্দু গুণ ও আসাদ চৌধুরী বাংলাদেশের দুই বিশিষ্ট কবি। দুজনেই ভিন্ন ভিন্ন লেখায় আল মাহমুদের প্রতি তাদের মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করেছেন। তাস খেলা তথা ‘ব্রে’ খেলা নিয়ে আল মাহমুদ-এর একটি কবিতা রয়েছে। কবিদ্বয় অবাক হয়েছেন এই কবিতা পড়ে, ‘ব্রে’ নিয়ে যে এমন একটি কবিতা হতে পারে তাদের কাছে সেটা অভাবনীয় ছিল। আসলে এটাই প্রকৃত কবির লক্ষণ। অবিশ্বাস্য রকমে বড় কবিরা এমনসব বিষয়ে সফল কবিতা লিখবেন যা অভূতপূর্ব। এখানে আমরা ‘ব্রে’ কবিতার একটু পাঠ নিচ্ছি: ‘যখন জীবনে শুধু লাল হরতন / একে একে জমা হলো, বলো এ কী অসম্ভব বোঝা / মুক্ত হয়ে হাঁটবার বন্ধ হলো সব পথ খোঁজা/ এদিকে তুমিও এলে ইসকার বিবির মতন।’

‘সোনালি কাবিন’ কবিতাগুচ্ছ আল মাহমুদের সৃজনশীলতার সোনালি শস্য, এ নিয়ে প্রচুর লেখা ও আলোচনা হয়েছে। কেবল এই চৌদ্দটি সনেট নিয়ে ভিন্ন রচনা হতে পারে। এর প্রতিটি অংশই উদ্ধৃতিযোগ্য। সৌন্দর্য, লোকজ কৃষ্টি, কৌম-সমাজ, সাম্যবাদ, যৌনতা ও বাঙালি যাপনচিত্র সবকিছু অক্ষরবৃত্তের অনুপুঙ্খ বিন্যাসে এই কবিতাগুচ্ছে দুর্দান্তভাবে উঠে এসেছে। এই কবিতাগুচ্ছ তাঁর কাব্যকীর্তির অনন্য স্মারক। 

আল মাহমুদের কবিতার মধ্যে শরীর ও যৌনতা বিশেষ মাহত্বে প্রযুক্ত রয়েছে। শারীরিতার উপমা তাঁর কবিতায় স্থূলভাবে আসেনি, এসেছে নন্দনবিভায় ভাস্কর্যের অভিরূপে, যা কেবল দোলায় না, পাঠককে তেমন দৃশ্যের সামনে হতবিহ্বল করে দাঁড় করিয়ে দেয়। কবিতা, ‘শোনিতে সৌরভে’, ‘তোমার নাভি দেখে হাঁটছি একা আমি / দেবে কি গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ? / যেখানে পাখি নেই রক্ত দ্রুতগামী / তোমার নাভি দেখে হাঁটছি একা আমি / মধ্যযুগী এক যুবক গোস্বামী / দেহেই পেতে চায় পথের নির্দেশ / তোমার নাভিমূলে দেখেছি একা আমি / নরম গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ।’

‘জুলেখার আহ্বান’ এবং ‘ইউসুফের উত্তর’ আল মাহমুদের দুটি অনন্য-সাধারন কবিতা; এ দুটি কবিতা বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। নবী ইউসুফের হৃদয়স্পর্শী কাহিনী নিয়ে পবিত্র কোরআনে একটি সুরা রয়েছে। পরবর্তীতে ‘ইউসুফ-জুলেখা’ শিরোনামে পারস্যের কবি আরেফ জামী কাব্য রচনা করেছিলেন, বাংলায় এ নিয়ে কাব্য লিখেছেন- শাহ মোহাম্মদ সগীর। বিশ্বসাহিত্যে এই ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকগণও লিখেছেন। আল মাহমুদ লিখেছেন দুটো দীর্ঘ কবিতা। ‘জুলেখার আহ্বান’ কবিতাটি আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতার একটি, তাঁর শিল্প-সক্ষমতার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে এই কবিতায়। ইতিহাস, উপযুক্ত বর্ণনা শৈলি (diction ), বাক্-প্রবাহ, বীর-ব্যঞ্জনা, মিথের ব্যবহার ও শব্দচয়ন সবই অসাধারণ নৈপুণ্যে এ কবিতায় ফুটে উঠেছে। কবিতার বিচ্ছিন্ন কিছু পঙ্ক্তিমালা এখানে তুলে ধরছি।

(ক) ‘হাতির দাঁতের মতো বাহু দুটি অসহায় আস্তিনে লুকায় / যেন পোষা হরিণীর ডাকে এস্ত হয়ে মরুর মৃগেরা দিশেহারা, পালায় প্রেক্ষণসহ ঊর্ধ্বশ্বাস পর্বত সানুতে। এখানে প্রস্তুত আমি / এই দেহ / উষর মরুর মাঝে আচ্ছাদিত উদ্যানের মতো। / দেখেনি যা কোনোদিন কোনোকালে কোনো সাধারণ। / অস্ত্রের ঝংকারে শুধু বীরত্বের পুণ্যফল ভেবে / মাঝেমধ্যে ভোগ করে পৃথিবীর বিজয়ী রাজারা।’ 

(খ) ‘যে ক্ষণ-স্ফূর্তিতে লোকে জীবনের সার্থকতা ভাবে/  ভাবে তার মানবজন্মের কোনো পুণ্যফল দৈব্যদেশে পাওয়া, আমি সেই পুণ্যফল / স্বপ্ন নয় / সম্মুখে হাজির। / কানাকড়ি মূল্য নয়, সুন্দরের স্পর্শ পেয়ে আমি কেবল বুঝতে চাই। আমিও সুন্দর।’
    
(গ) ‘শিহরিত ডাইনিরা ভুলে গিয়ে বাহ্য শালীনতা মেওয়ার বদলে চাকু বসিয়েছে মেন্দিরাঙা আঙুলের গিঁটে। আমার কুৎসার মেঘ বাষ্পীভূত হয়েছিল কাল।’

(ঘ) ‘তখন স্বপ্নের মতো মনে হবে, মিশরের জুলেখা মালেকা দুবাহু উন্মুক্ত করে ডেকেছিলো / চিরবন্দী লাঞ্ছিত তোমাকে / ডেকেছিলো / কুসুম শয্যায় তার খুলে ফেলে নীবির বাঁধন। / খুলে ফেলে কেশপাশ দূরে রেখে রানীর সম্মান / চেয়েছিল তোমার মতন কোনো ভাগ্যহত/ দাসের চুম্বন।’

‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ আল মাহমুদের আরেক শিল্প-সফল কবিতা। এ কবিতায় মিথ্যাবাদী রাখালের প্রচলিত কাহিনীকে তিনি ভেঙে বিনির্মাণ করেছেন। ইংরেজ কবি শেলি বলেছিলেন: ‘Poets are the unacknowledged Legislators of the world.’ একজন মহৎ কবি সর্বদাই সজ্ঞান এবং পূর্বাভাস  সম্পর্কে তার অনুভূতিই সর্বাধিক অগ্রবর্তী। ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ কবিতায় আল মাহমুদ মূলত একজন কবির অধিচৈতন্যকেই শব্দের দুর্দান্ত ক্রীড়ায় তুলে আনতে চেয়েছেন। কবিতাটির দুটো ভিন্ন অংশ তুলে ধরছি :

(ক) এই পথেই তারা গন্তব্যে পৌঁছুবে, যেখানে শ্বাপদারণ্যের পাশেই আছে নদী। / মানুষের জন্য পারাপারের পানসি বাঁধা। / গোটানো পালে জলপুষ্পের প্রতীক। দণ্ড আর দাঁড়।
    
(খ) ছেলেটার কি তবে আগাম মৃত্যুর গন্ধ টের পাওয়ার কোন অস্বাভাবিক ইন্দ্রিয় ছিলো? যার দুর্গন্ধে শত তিরস্কার উপেক্ষা করে সে চিৎকার করে উঠতো বাঘ বাঘ বলে, ঠিক কবির মতো? আহ, আবার যদি ফিরে আসতো সেই মিথ্যেবাদী ছেলেটা, জনমত ও তিরস্কারের পাশে দাঁড়িয়ে প্রান্তরের চারণের মতো বলে উঠতো, ‘মৃত্যু এসেছে, হে গ্রামবাসী- হুশিয়ার।’

‘বিপাশার চোখ’ আল মাহমুদের অসাধারণ এক প্রেমের কবিতা। বিপাশা নামের এক মেয়ের চোখের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি ভারত, চীন, পারস্য ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীনসব মিথ ও কিংবদন্তীর প্রয়োগ ঘটিয়ে পাঠকদের অভূতপূর্ব এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখী দাঁড় করান। কবিতাটির শেষাংশ তুলে ধরছি:

‘আমি প্রেমিক ভাস্কর ফরহাদকে পাথরের ওপর স্থায়ী কালো মিনেয় আঁকতে দেখেছি শিরির কালো আঁখিপল্লব / মরুভূমির এক দ্রুতগামী উস্ট্রীর পিঠে ধাবমান লায়লার চোখের কথাও আমি জানি। / বিপাশা এই চোখ তুমি কার কাছ থেকে চুরি করলে, তস্করী! / এক্ষুনি ফিরিয়ে দিয়ে এসো, নইলে রাজা সোলায়মানের রথের শব্দে সারা জীবন তোমার ঘুম ভেঙে যাবে। / আর তোমার চোখের জলে তৈরি হবে নতুন ফোরাতের স্রোত’

‘ভাঁজ’ কবিতাটি মধ্যে নিরব নিষ্ঠার সাথে কবি নারীর সৌন্দর্যকে তুলে এনেছেন। ভাঁজ করা জামদানির পরতে পরতে যেমন চুমকির কাজ থাকে, নারীদেহের খাপে খাপে রয়েছে তেমনই মনোরম উষ্ণ-বিভূতি; উদয়প্রহর থেকে সন্ধ্যায় অবসন্ন হওয়া পর্যন্ত কবির দৃষ্টি তাকে পরখ করেছে—চেতনায়। কবিতাটির সামান্য পাঠ তুলে দিচ্ছি : ‘কিছু নারী আছে শুধু ভালোবাসতেই জন্মায় / যেমন সন্ধ্যামালতি, সাঁঝের সেঁজুতি জ্বলার সাথে সাথেই / অবসন্ন সৌন্দর্যের ভেতর সুন্দর হয়ে মরে যায়।’

আল মাহমুদ বিখ্যাত কবিদের বেশ কিছু কবিতা অনুবাদও করেছেন। অনুবাদগুলোর মধ্যেও তাঁর শিল্প-সক্ষমতা ধরা পড়ে। বস্তুত কবি ছাড়া, কবিতার উৎকৃষ্ট অনুবাদ প্রায় অসম্ভব। উৎকৃষ্ট অনুবাদে ভাষান্তরিত হবার পরও সেটি আবার কবিতা হয়ে ওঠে। এখানে হোর্হে লুইস বোর্হেস-এর ‘ডাকার’ শিরোনামের কবিতার প্রথম স্তবক তুলে ধরছি : ‘ডাকার দাঁড়িয়ে আছে সূর্যের উদয়রেখা, বালুবেলা ও সমুদ্রের সামনে। রোদের তেজে অন্তরীক্ষ আবৃত। আবর্জনার কুণ্ডুগুলো ঘেউ ঘেউ করে রাস্তাটাকে ধমকে চলেছে। আর আঘাতকারী ঢেউয়ের আগারের মতো হয়ে আছে সমুদ্র এখন।’ 

দেশমাতৃকা, আমাদের মুক্তিসংগ্রাম, একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে আল মাহমুদ অনেক কবিতা লিখেছেন। সেগুলোতে দেশমাতার প্রতি ভালোবাসার কথা, প্রত্যয় ও প্রত্যাশার কথা অত্যন্ত দৃঢ় ও আবেগঘন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। কিছু কবিতা আছে এমন যে, বিশ্লেষণ করে, পাঠোদ্ধার করে কেউ কবিতাটি সম্পর্কে বর্ণনা করলে যা অনুভূতি জাগে; তার চেয়ে শতগুণ প্রবল আবেগ জাগ্রত হয় সেটি পাঠের কিংবা উচ্চারণের মাধ্যমে। এখানে তেমনি দুটো কবিতাংশ উপস্থাপন করছি।

(ক) একজন কবি আর কি দিতে পারে? এই নাও আমার পরিশ্রুত ভাষা, নাও কবিতা—আমার রক্ত। কলমের কালির চেয়েও মহার্ঘ। নাও আমার অশ্রুজল, দ্যাখো এতে যদি তোমার মরে যাওয়া স্রোতগুলো নদীকে বিহ্বল করে ঘোলা পানির তোড় নিয়ে সমুদ্রের দিকে ধাবমান হয়। নাও অক্ষিগোলাক। যদি এতে তোমার ভবিষ্যৎ দৃষ্টি একবিংশ শতাব্দীকে দুটি তীক্ষ তীরের মতো গেঁথে ফেলে। আমার চামড়া দিয়ে তোমার রাঙা পায়ের জুতা বানিয়ে দিলাম। পরো, আর হেঁটে যাও আগামী দিনের দিগবলয়ের দিকে। পৃথিবী দেখুক আমার সমস্ত গান পাখি হয়ে তোমার শরীরে বাসা বেঁধেছে। আমার শব্দ তোমার শাড়ির পাড়ে মাছের আকৃতি নিয়ে ঝাঁক বেঁধে সাঁতার কাটছে তোমার ঘোমটায়। দেখুক, আমার ছন্দ তোমার কণ্ঠহার হয়ে দুলছে। (দেশ মাতৃকার জন্য)
    
(খ) আমিও অন্তরঙ্গ হয়ে যাই হঠাৎ তখন, জনতার সমুদ্রের সাথে / বাঘের হাতের মতো সনখ শপথ / সোহাগের গাঢ় ইচ্ছা নিয়ে / নেমে আসে মনের ওপর! / নির্মম আদর পেয়ে আমিও রক্তাক্ত হবো / বরকতের শরীরের মতো? (অসহ্য সময় কাটে)

ছড়া রচনার মধ্যেও আল মাহমুদ দারুন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ গ্রন্থের বাইরেও বিভিন্নগ্রন্থে সূচিবদ্ধ তাঁর অনেক শিল্পসফল ছড়ার সন্ধান পাওয়া যায়। শিশুকালের যে দু’একটি স্মৃতি আজও আমার মনে উজ্জল রয়েছে, তার একটি হলো, সন্ধ্যাবেলা মাতামহীর কাছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জসীম উদদীন-এর ছড়ার পাশাপাশি আল মাহমুদের নিম্নোক্ত ছড়াটির গীতিময় শ্রবণ : 

‘আম্মা বলেন, পড়বে সোনা / আব্বা বলেন, মন দে;
পাঠে আমার মন বসে না / কাঁঠালচাঁপার গন্ধে।
আমার কেবল ইচ্ছে জাগে / নদীর কাছে থাকতে
বকুলডালে লুকিয়ে থেকে / পাখির মতো ডাকতে।
....................................................
তোমরা যখন শিখছো পড়া/ মানুষ হওয়ার জন্য
আমি না হয় পাখিই হবো/ পাখির মতো বন্য।’

(চার)
আল মাহমুদ সমগ্র বাংলা ভাষার একজন বড় কবি। তাঁর কবিতার শিল্পগুণ, বৈচিত্র্য এবং ধ্রুপদী মান ও মাত্রা উদ্ঘাটনের জন্য বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন যদিও তাঁকে নিয়ে প্রচুর নিবন্ধ-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে; কৃত্তিবাস, প্রেক্ষণ, নোঙরসহ বেশকিছু ছোটকাগজ বিশেষ সংখ্যাও করেছে কিন্তু বাংলার লোকমানুষের কাছে একজন প্রধান কবিরূপে বিস্তারণের জন্য তাঁকে নিয়ে আরও প্রচুর কাজ প্রয়োজন। তাঁর সাহিত্যকর্ম বিশেষত কবিতা ব্যাপক আলোচনা ও চর্চার দাবি রাখে। সম্প্রতি তিনি প্রয়াত হয়েছেন, তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বিশেষ বার্তা বা অংশগ্রহণ না থাকলেও বিষয়টি যে এদেশের কবি-লেখক ও শিল্পসুধীগণের কাছে বিশাল ব্যাথার কারণ হয়ে এসেছিল, তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আল মাহমুদ তাঁর যাপনকালের শেষ পর্যায়ে, আমি বলবো—পৃথিবীতে জীবিত (বর্তমান) কবিদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বেঁচেছিলেন। এই বক্তব্যের অনুগামী অসংখ্য কথকতা ও যুক্তি রয়েছে, যা প্রকাশের জন্য ভিন্ন একটি রচনা লিখতে হবে। আমরা আসলে কেবল আল মাহমুদ নয়, আমাদের আরও অনেক কবি-লেখক ও তাঁদের শিল্পকর্মকে ঠিকভাবে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করতে পারিনি। যদি সেটা সম্ভব হতো, যদি পৃথিবীর প্রভাবশালী বিভিন্ন ভাষায় যথাযথভাবে আমাদের কবি ও ঔপন্যাসিকদের ভালো কাজগুলো অনুবাদের মাধ্যমে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়া যেত, তবে রবীন্দ্রনাথের পর গত একশ বছরে আরও দু’চারটি নোবেল পুরস্কার বাংলা ভাষার লেখকরা নিশ্চয়ই অর্জন করতো।

আমাদের জন্য আফসোস, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো এদেশে কোন জাতীয় পর্যায়ের অনুবাদ ইন্সটিটিউট নেই। বাংলা একাডেমিতে অনুবাদ উপ-বিভাগ থাকলেও সেটি যে, একবারেই চাহিদার সাথে সংগতি বজায় রেখে কাজ করতে পারছে না, সেটা আমরা প্রত্যেকেই জানি; তাই একটি বিশেষায়িত অনুবাদ ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা এদেশের শিল্প-সাহিত্যের জন্য আজ অত্যন্ত জরুরি।

আল মাহমুদ-এর কবিতার মধ্যে বক্তব্যের চেয়ে সৌন্দর্য এবং প্রকাশভঙ্গির সম্মোহন অনেক বেশি, এর ফলে তাঁর কবিতার অনুবাদও অত্যন্ত কঠিন। বাংলাদেশ, বাঙালি, এদেশের আঞ্চলিক শব্দ, লোকাচর, বিভিন্ন মিথ, ধর্ম, কিংবদন্তী সম্পর্কে ব্যুৎপত্তি এবং প্রখর কবিত্বশক্তি ব্যতীত তাঁর কবিতার ভাষান্তর প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। কবির চৌধুরী’র অনুবাদে ১৯৮১ সালে তাঁর নির্বাচিত কবিতার অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেটির ভূমিকা রচনায় লেখা কবির চৌধুরী একটি মন্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ : ‘I think most people would agree with me when I say that Al Mahmud is one of the most important living poets of Bangladesh and that his poetry is unique in many ways.’ ২০১০ সালে সায়ীদ আবুবকর-এর অনুবাদে যুক্তরাষ্ট্রের ‘I-PROCLAIM PRESS’ থেকে ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যটি ‘The Golden Kabin’  শীর্ষনামে প্রকাশিত হয়েছে। আল মাহমুদ-এর কবিতার অসাধারণত্ব বা বিশেষত্ব প্রকাশের জন্য আমার এই রচনা যথেষ্ঠ নয়। আমি কেবল তাঁর কবিতাসমগ্রের অসাধারণ সব কবিতা থেকে বিশেষ কিছু স্বর্ণশোভিত পঙ্ক্তিমালা উদ্ধার করে তুলে ধরেছি; এতে যদি তাঁর অসাধারণ কবি-প্রতিভা কিঞ্চিত হলেও আপনার সামনে প্রকাশ পায়, আপনার চৈতন্য চমকে ওঠবে, তাঁর কবিতার প্রতি সজ্ঞান দৃষ্টিপাতের আকর্ষণ জাগ্রত হবে। দীর্ঘ কবি জীবনে তিনি যে অনুপম, বিচিত্র, অভিনব ও শিল্পঋদ্ধ প্রচুর কবিতা লিখেছেন সেদিকে পাঠক-সমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করাকেই একজন শব্দশ্রমিক হিসেবে আমি কর্তব্য মনে করেছি। তাঁর সমকালে আরও যাঁরা কবিতা লিখেছেন, প্রায় সকলেই আজ প্রয়াত; শারীরিক অবর্তমানতার ফলে আজকাল তাদের অনেকেই খুব একটা চর্চায় কিংবা আলোচনার মধ্যে নেই যদিও দু’একজন জীবিতকালে বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। তবে এটা আজ সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি যে, আল মাহমুদ-এর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটবে না, ঘটতে পারে না; তার কারণ- নিজের সংহত অবস্থান রক্ষণের জন্য একান্ত আবশ্যক সে সৃজন-দক্ষতা তথা শিল্প-নির্মিতির প্রয়োজন সেটি আল মাহমুদ-এর কবিতায় বিপুলভাবে উপস্থিত। যে স্বতন্ত্র শিল্পস্বর একজন বড় কবির জন্য একান্ত আবশ্যক, আল মাহমুদ তাঁর জীবন ও শিল্প-সাধনা দিয়ে সেটা অর্জন করেছেন। আল মাহমুদ-এর কবিত্ব ও সৃজন প্রতিভা সম্পর্কে এই রচনায় উচ্চারিত শংসা-বচনগুলো কারো কারো কাছে বাড়াবাড়ি মনে হতেও পারে, তবে আমার বিশ্বাস, আগামীদিনের উচ্চ-শিল্প High-Art সভায় এর সবকটি মন্তব্য একদিন সাদরে আদৃত হবে। 

আবারও কবিতায় ফিরে যাই, কবি আল মাহমুদের কবিতার স্বর্ণ-সরণিতে এবং ‘নদীর ভিতরে নদী’র রূপ দেখতে দেখতে, বাংলার চিরচেনা কোন নদীপথে গুণগুণ রবে আরও একবার হারিয়ে যাই—আনমনে :

‘তোমার গোসল আমি দেখেনি কি একদা তিতাসে? / মনে পড়ে? শ্মশানঘাটের সেই সিঁড়ি ছুঁয়ে নেমে যাওয়া জল / ডোবায় সে পাদপদ্ম। / সফরী পুঁটির ঝাঁক আসে আঙুল ঠুকরে খেতে। / নদী যেন নদীতে পাগল। / নদীর ভিতরে যেন উষ্ণ এক নদী স্নান করে। / তিতাসের স্বচ্ছজলে প্রক্ষালনে নেমেছে তিতাসই। / নিজের শাপলা লয়ে খেলে নদী নদীর ভিতরে। / ঠাট্টা বা বিদ্রুপ নেই, / নেই শ্যেনচক্ষু, নেই চারণের বাঁশি/ অমন নাহানা আর দেখি নাকো, ঘুরি দেশান্তর / সাগরের বেলাভূমি ঘুরি আমি, তামাম হাম্মাম,  / সিনানের ছবি দেখে ম্যুজিয়মে কাটাই প্রহর / পাই না সে দৃশ্যপট তিতাসের। / প্রক্ষালনে নারীর আরাম। / ঈভের শরীর যত কেলি করে প্যাসিফিকে, ভূমধ্যসাগরে / নুনের দাহিকা হয়ে জ্বলে তারা অধরে, নধরে।’


গ্রন্থ নির্দেশ :
    ০১.শ্রেষ্ঠ কবিতা : আল মাহমুদ, আদর্শ- ২০১০
    ০২. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস : মাহবুবুল আলম
    ০৩. আল মাহমুদের কবিতা : বিষয় ও শিল্পরূপ—ড. ফজলুল হক তুহিন
    ০৪. আল মাহমুদ : কবি ও কথাশিল্পী— কমরুদ্দিন আহমদ
    ০৫. বিশ্বায়ন বাংলা কবিতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ : আমিনুল ইসলাম 
    ০৬. নির্বাচিত প্রবন্ধ : মতিন বৈরাগী
    ০৭. নান্দীপাঠ-৫, সম্পাদক : সাজ্জাদ আরেফিন, ২০১৩
    ০৮. বাংলা কবিতায় ঐতিহ্য : বীরেন মুখার্জী সম্পাদিত গ্রন্থ
    ০৯. বুদ্ধিজীবী : ইতিহাস অনুসন্ধান ও আত্মপাঠ— সৈকত হাবীব সম্পাদিত
    ১০.আল মাহমুদের কবিতা : সত্তার ভারমুক্ততার ভাষ্য—মহীবুল আজিজ। 

• ঢাকা

menu
menu