মৎস্যপুরাণ

মাছ ছাড়া বাঙালির খাদ্য তালিকা তৈরিই হবে না। কথায় বলে, মাছে ভাতে বাঙালি। কবি ঈশ্বর গুপ্ত আরেক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল / ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।’ শুধু বাঙালিই নয়, পৃথিবীর আরও অনেকেই মাছ খায়, কিন্তু দোষ হয় ‘মছলিখোর’ বাঙালির। বাংলাদেশে মাছ খাওয়া কবে শুরু হয়, তার কোনও সঠিক তথ্য আমাদের জানা নেই। চন্দ্রকেতু গড়ে পাওয়া পোড়ামাটির ফলকে মাছ খোদাই পাওয়া গেছে। ফলকটি চতুর্থ শতকের। অষ্টম শতাব্দী থেকে বাংলাদেশের পাহাড়পুর ও ময়নামতিতে যেসব ফলক পাওয়া গেছে, তার বেশ কয়েকটিতেই মাছ খোদাই রয়েছে। মঙ্গলকাব্যেও মাছের উল্লেখ পাই—

ওগ্গর ভত্তা রম্ভয়া পত্তা 
গাইকো ঘিত্তা দুগ্ধ সযুক্তা 
মইলি মচ্ছা নালিচ গচ্ছা 
দিচ্ছই কন্তা খা পুনবন্তা।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বেনের মেয়ে’ উপন্যাসের শুরুতেই সাতগাঁয়ের পুকুরের মাছ ধরার বর্ণনা রয়েছে। রাজার গুরু লুইপাদ মাছের তেল খেতে পছন্দ করেন, তাই ঘটা করে জাল ফেলে শয়ে শয়ে মাছ ধরিয়ে ভাজা, চচ্চড়ি, ছেচকা, বড়ি— এসব রাঁধালেন। গুরু লুইপাদ খেয়েদেয়ে শিষ্যকে আশীর্বাদ করলেন, ‘তোমার ধর্মে মতি হোক।’ (কল্যাণী দত্ত)

রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম জীবনে লিখেছিলেন, “মীনগণ হীন হয়ে ছিলো সরোবরে / এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে”। তিনি কবিতায় ‘দামোদর শেঠ কি’র সঙ্গে ‘ভেটকি’কে মিলিয়ে দিয়েছেন। চিতল মাছকে বলেছেন, মিঠাই গজার ছোট ভাই। ‘নৌকাডুবি’তে খেতে বসে মাছের মুড়ো দেখে রমেশ কালিদাস আউড়ে বলেন, “স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রম নয়, এ যে রুই মাছের মুড়ো বলে রোহিত মেস্যর উত্তমাঙ্গ।” অনেকে মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং রমেশের জবানীতে এ উচ্ছ্বাস প্রদান করেছেন। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরও তাঁর আত্মজীবনী ‘তুজুক’-এ লিখে গেছেন যে, মালব থেকে গুজরাটে যেতে পথে সর্দার রায়সান তাঁকে একটা বড় রুই মাছ দেন। তার বদলে তিনি সর্দারকে একটি উৎকৃষ্ট ঘোড়া উপহার দিলেন।

রুই মাছের কদর শরৎচন্দ্রের লেখাতেও পাওয়া যাবে। শরৎচন্দ্রের ‘মেজদিদি’তে হেমাঙ্গিনী যেই তাঁর সৎভাই কেষ্টকে আস্ত একটা রুই মাছের মুড়ো খেতে দিলেন, অমনি শুরু হয়ে গেল অশান্তি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, সমরেশ বসু, হরিশঙ্কর জলদাসের লেখারও প্রতিপাদ্য ছিল জেলেদের জীবন।

আমরা যখন বলি অমুক ব্যক্তি সাক্ষাৎ রাঘব বোয়াল, তখন কী বলা হচ্ছে শ্রোতার বুঝতে দেরি হয় না। ঠিক তেমনই যখন বলি—গভীর জলের মাছ, মাছের মা, মাছের তেলে মাছ ভাজা অথবা শাক দিয়ে মাছ ঢাকা কিংবা ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না, মাছের মায়ের পুত্রশোক—তখন আর টীকা-টিপ্পনীর দরকার হয় না। অরাজক পরিবেশের কারণে সৃষ্ট রাষ্ট্র বিপ্লবের পটভূমি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মৎস্যকুলের দৃষ্টান্ত বাংলার পাল রাজাদের তামার ফলকে লিপিবদ্ধ রয়েছে। মাৎস্যন্যায় শব্দটির উৎপত্তি সেই থেকে।  

বিদ্যাসাগরের জননী ভগবতী দেবী খুব জেদি ও অভিমানী ছিলেন। বিদ্যাসাগরের পিতা ঠাকুরদাসকে পত্নীর মান ভাঙাতে একটা কৌশল শিখে ফেলেছিলেন। ভগবতী দেবী রাগ করে দরজা বন্ধ করলে তিনি বেশ ভারী ওজনের একটি রুই-কাতলাজাতীয় মাছ কিনে উঠানে সশব্দে ফেলে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে উঁচু গলায় বলতেন, “খবরদার, আমার মাছ কেউ যেন না ছোঁয়।” এখানে উদ্দিষ্ট ‘কেউ’ আর অন্য কেউ নন, ভগবতী দেবীই। এতে ম্যাজিকের মতো কাজ হত। ভগবতী দেবী রাগ ভুলে তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানে বঁটি নিয়ে মাছ কুটতে বসে যেতেন।

ছেলেমেয়ে বা নাতিপুতির রাগ-অভিমান মেটাতে গৃহকর্তারা যে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের মন পেতে চেষ্টা করতেন, তার চমৎকার ছবি আঁকা রয়েছে বর্ধমান জেলার মুসলিম পরিবারের দাদা-নাতনির একটি ছড়ায়।

ওরে আমার পারুল বিবি
ওরে আমার জুঁই,                            
হিয়ার মাঝে ধরি তোরে,
বুকের মাঝে থুই।
আম দিলাম, কলা দিলাম
দিলাম চিনি পাতা দই,
তাতেও আমার পুতিন বিবির
মন উঠল কই?
নোনতা পানির ভেটিক, ইলিশ
মিষ্টি পানির রুই,
তাতেও দেখি খাবার সুমায়
বায়না ধরিস তুই।

মাছের দৃষ্টান্ত দিয়ে ছড়া শেখানোর কৌশল যে গ্রামীণ শিক্ষাবিদ বা ছড়াকারদের ভালো করেই জানা ছিল, সে কথা উইলিয়াম কেরি তাঁর ‘ইতিহাস মানা’র একটি ছড়া বাঙালি পাঠককে উপহার দিয়ে কৃতার্থ করেছেন।

এক কৃষক চাষ করতে গিয়ে কোনও খালে গোটা চব্বিশেক মাছ ধরে বাড়ি এসে তার স্ত্রীকে মাছ রাঁধতে দিয়ে আবার চাষের ক্ষেতে চলে গেল। কৃষকপত্নী যথাসময়ে রান্না শেষ করে মাছ রান্না কেমন হল পরখ করতে একটি মাছ চেখে দেখল। এরপর আরেকটি মাছ খেয়ে স্বাদ পরীক্ষা করে সে সন্তুষ্ট হতে চাইলে ‘এই রূপে খাইতে খাইতে একটি মাত্র অবশিষ্ট রাখিল।’ বাড়ি ফিরে একটি মাছ পাতে দেখে কৃষক বিস্মিত হয়ে বাকি মাছের কী হল, জানতে চাইলে তার স্ত্রী মাছের হিসাব বুঝিয়ে দিল এভাবে—

মাছ আনিলা ছয় গণ্ডা
চিলে নিলে দু-গণ্ডা
বাকি রহিল ষোলো।
ধুতে আটটা জলে পলাইল,
তবে থাকিল আট।
দুইটায় কিনিলাম দুই আটি কাঠ
তবে থাকিল ছয়।
প্রতিবাসিকে চারিটা দিতে হয়
তবে থাকিল দুই।

আর একটা চাখিয়া দেখিলাম মুই।
তবে থাকিল এক;
এখন হইস যদি ভালো মানুষের পো,
কাঁটাখানা খাইয়া মাছ খান থো।

যোগীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর সংকলিত ‘খুকুমণির ছড়া’য় এ মজার ছড়াটি হিসাব শেখানোর উদ্দেশ্যেই অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।

বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল খুলে একটু দেখা যাক। কারণ বিজয় গুপ্ত বরিশালের মানুষ—তাঁর রান্নায় পূর্ব বাংলার মধ্যযুগের রান্নার একটা ছবি পাওয়া যাবে, যা আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক।

মৎস্য কাটিয়া থুইল ভাগ ভাগ।
রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে নলতার আগ
মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাছ গাছা।
ঝাঁজ কটু তৈলে রান্ধে খরসুন মাছ
ভিতরে মরিচ গুঁড়ো বাহিরে জুড়ায় সুতা।
তৈলে পাক করিয়া রান্ধে চিংড়ির মাথা
ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল।
কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল

তালিকাটি মূলত হিন্দুবাড়ির রান্না—পেঁয়াজ, রসুন, অনুষঙ্গ বাদ দিলে মুসলিমবাড়ির দৈনন্দিন রান্নার সঙ্গে খুব একটা তফাত নেই। আশ্চর্যের বিষয় বিজয় গুপ্তর তালিকায় ইলিশ মাছ নেই।

বাংলায় আঠারো শতক থেকে মসলাহীন ইংরেজের খাবারে স্বাদের স্রোত বয়ে এনেছিল ওস্তাদ মুসলিম রন্ধনকুশলীরা। ইংরেজের স্বল্প স্বাদ (পড়ুন বিস্বাদ) মাছ-মাংস—এসব রন্ধনশিল্পীদের হাতে পড়ে আদা, পেঁয়াজ, রসুনের রসে জারিত হয়ে প্রায় সম্পূর্ণ রূপান্তর হয়ে গেল। এমন রন্ধন-বিপ্লবের কারণে বাংলার মাছ ‘ভেটকি’ (যাকে সাহেবরা আদর করে বলত বেকটি) আর তপসে মাছ সাহেব-মেমদের আরাধ্য হয়ে উঠল। এক কেজি ইলিশে প্রায় ৯০০ কাঁটা থাকায় অপঘাতে মৃত্যু এড়াতে সাহেবরা প্রথমে ইলিশের দিকে হাত বাড়াতে সাহস করেনি। ষড়যন্ত্র করে পলাশী যুদ্ধ জয় করা আর ছুরি-কাঁটা দিয়ে ইলিশকে জব্দ করা যে এক নয়, তা সাহেবরা মনেপ্রাণে মেনে চলেছেন (কাঁটা ছাড়া ভাপা ইলিশ রান্নার প্রচলন শুরু না হওয়া পর্যন্ত)। ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুন এদের স্মৃতি কথা ঘেঁটে এসব তথ্য আমাদের উপহার দিয়েছেন।

কবি ঈশ্বর গুপ্ত এই সাহেব আরাধ্য তপসে মাছের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘এমত অমৃত ফল ফলিয়াছে জলে / সাহেবরা সুখে তাই ম্যাঙ্গো ফিস্ বলে।’ মাছটির দৈহিক রূপে গুপ্ত কবি মোহিত, লিখেছেন, ‘কনককান্তি কমনীয় কায় / গালভরা গোপদাড়ি—তপস্বীর প্রায়’। তপস্বীর মতো চেহারার কারণেই এর নাম তপস্বী তথা তপসে। আর এ মহাসুস্বাদু মাছের জন্য সাহেবরা মোটেই ব্যয়কুণ্ঠ নন। তাই কবির ভাষায় সাহেবরা—

ব্যয় হেতু না হয় কাতর
খানায় আনায় কত করি সমাদর
ডিস ভরে কিস লয় মিসি বাবা যত
পিস করে মুখে দিয়ে কিস খায় কত।

শুধু এই নয়, সাহেব-মেমরা নাকি তপসে মাছের মৌসুমে মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়ে শুধু এ অমৃত ফলটি খেয়ে দেহরক্ষা করেন।

তাদের (সাহেবদের) পবিত্র পেটে তুমি কর বাস
এই কয় মাস আর নাহি খায় মাস (মাংস)

তপসে মাছের নাম ও স্বাদ ইংরেজি সাহিত্যেও বেশ কিছু আলোচনা রয়েছে। একজন সাহেবের মতে, যেহেতু আমের মৌসুমে এর আবির্ভাব, সেহেতু এর নাম ম্যাঙ্গো ফিশ। শেষ কথা বলেছেন গুপ্ত কবি তপসেকে অনুনয় করে, ‘ভিটে বেচে পুজো দিব মিঠে জলে এনে’।

সাহেবরা এসব কবিতা পড়েছেন কিনা জানি না, কিন্তু তাঁদের মনের কথাই কবি বলেছেন তার নিজের মতো করে। শুধু দুঃখ এই যে, ইলিশের স্বাদ-গন্ধ নিয়ে গুপ্ত কবি কিছুই লেখেননি। তাঁর পূর্বসূরি বিজয় গুপ্তের মতো ঈশ্বর গুপ্তের কবিতাতেও বাঙালির পরমপ্রিয় ইলিশ গুপ্তই রয়ে গেল।

এবার একটি মুচমুচে ভাজা ইলিশ সুঘ্রাণ ছড়ানো কাহিনি বলে এ মৎস্যপুরাণের ইতি টানব। একবার কলকাতা থেকে সিরাজগঞ্জে এসেছেন কবি নজরুল সেখানকার সুধী সমাজের আমন্ত্রণে। কবির সম্মানে ইলিশের নানা পদ রেঁধে এক মহাভোজের আয়োজন করা হয়েছে। কবি দু-চার টুকরো ইলিশ মাছ খেয়ে হাত জোড় করে আর ইলিশ খেতে অপারগতা জানালেন। এরপর নজরুল জানালেন, আর খেলে তাঁর সারা গা থেকে ইলিশ মাছের সুবাস বের হবে, ক্ষুধার্ত বিড়াল তেড়ে আসবে। কবি এই বয়সে বিড়ালের কামড় খেতে ইচ্ছুক নন।

মাছ শুকিয়ে যে শুঁটকি করা হয়, সেই শুঁটকিও দেশে বিদেশে সমান জনপ্রিয়। চ্যাপা হল পুঁটি মাছের শুঁটকি। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে যেসব মাছের শুঁটকি করা হয়, তার মধ্যে পুঁটি মাছ অন্যতম। পুঁটি মাছ ধরার পর ভুঁড়ি ফেলে দিয়ে মাছের তেল দিয়ে মাছ মেখে একটু রোদে শুকিয়ে হাঁড়িতে ভরে বায়ুরোধী করে মাটিতে পুঁতে রেখে ৪/৫ মাস পর মাটির নিচ থেকে উঠিয়ে ঢাকনা খুলে স্তরে স্তরে সাজানো পুঁটিমাছ বের করে বাজারে বিক্রি করা হয়। ঝাল কাঁচালংকা বেশি করে দিয়ে রসুন-পেঁয়াজসহ ভালোভাবে হাত দিয়ে মিহি করে সাবধানে মেখে গরম ও নরম আঠালো ভাত দিয়ে খাওয়া হয়। চ্যাপা শুঁটকির রান্না তীব্র গন্ধপ্রদ। 

সিদল হল সিলেটের বিখ্যাত ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের, বিশেষ করে গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও রংপুর অঞ্চলে বিশেষ পছন্দনীয় খাবার। বর্ষার সময়ে টাকিমাছ ও কচু ঢেঁকি বা সামগাইন দ্বারা একত্রে মিশিয়ে মুঠো বা চাকার মতো করে তৈরি করা হয়, তারপর তা শুকিয়ে তাওয়ায় ভেজে তেল, লংকা, আদা, রসুন, এবং পেঁয়াজ একত্রে পিষে খাওয়া হয়।

মাছ রান্নার এমন নানারকম উপায় ও প্রণালী রয়েছে বিভিন্ন জেলায়, রাজ্যে বা প্রদেশে। মোটের ওপর মাছেভাতে বাঙালির বদনাম এখনও বজায় আছে বহাল তবিয়তে। 


• পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

menu
menu