যোগমন

ইয়োগা ইংরেজিতে যার অর্থ ইউনিয়ন। ইয়োগা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ইউজ থেকে। আর বাংলায় ইয়োগা শব্দ বলতে বুঝায় যোগ বা যোগ ব্যায়াম। কিন্তু বহুল প্রচলিত যোগ ব্যায়াম শব্দটিতে আমার একটু আপত্তি আছে। কারণ আদি ইয়োগা বা অষ্টাঙ্গ ইয়োগার একটি অঙ্গ হলো ব্যায়াম বা আসানা তথা আসন। কিন্তু বাকি সাতটি অঙ্গ সহই ইয়োগা পরিপূর্ণ হয়। ইয়োগা অর্থ  হলো মানসিক বা mental, শারীরিক বা physical, আধ্যাত্মিক বা spiritual সমন্বয় ঘটিয়ে ব্যক্তির চরিত্রের সর্বোচ্চ উন্নয়ন সাধন। এই তিনের যেখানে মিলন ঘটবে তাই ইয়োগা। শুধুই শরীরচর্চা কখনো ইয়োগা হতে পারে না। দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের সমাজে ইয়োগার প্রচলন চলে আসছে শুধুই শরীরচর্চার একটি মাধ্যম হিসেবে। শরীরচর্চা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও দরকারি এবং এ কথাও সত্যি যে শরীরচর্চার সঙ্গে ব্যক্তির মন ও মানসিকতার বিকাশ সাধনও ঘটে থাকে। কিন্তু তার জন্য ইয়োগা ছাড়াও অন্যান্য পন্থা অবলম্বন করা যায়। আমি নিজে একজন ইয়োগি হওয়ায় প্রায়ই একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। ইয়োগা করলে আমার ওজন কমবে? ইয়োগা করছি কিন্তু ওজন তো কমছে না। জনে জনে বুঝাতে চাওয়াও বোকামি যে ইয়োগার সঙ্গে ওজন কমা বা বাড়ার কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই।

অষ্টাঙ্গ ইয়োগার তৃতীয় অঙ্গ আসানা এই আসনগুলো নিয়মিত অনুশীলন করলে শরীর ফ্লেক্সিবল বা আমাদের আয়ত্বে আসতে বাধ্য। নিয়মিত কঠিন আসনগুলো করে তখনই কেবল ওজন কমানো ও বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দূর করা সম্ভব। ইয়োগা তথা আসনগুলো নিয়মিত অনুশীলন করে শরীরকে আয়ত্বে আনার জন্যই হলো শরীর তথা মনকে ঐ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই আসনে থেকে ধ্যানে নিজেকে সমর্পণ করা অর্থাৎ শরীর যেখানে কোনো বাধা হবে না। তাই তো মুনি, ঋষি, ইয়োগিরা দিনের পর দিন একই আসনে ধ্যানে নিমজ্জিত হন। ইয়োগার মূল লক্ষ্যই হলো সমাধি বা অসীমে বিলীন হওয়া তা একমাত্র সম্ভব ধ্যানের মাধ্যমে আর এই ধ্যানে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করার জন্য আসনগুলোর নিয়মিত অনুশীলন একান্ত প্রয়োজন। অষ্টাঙ্গ ইয়োগার বাকি সাতটি অঙ্গ হলো :

১. ইয়ামা

২. নিয়ামা

৩. প্রাণায়াম

৪. ধ্যানা

৫. ধারণা

৬. প্রত্যাহারা

৭. সমাধি

উপরের শব্দগুলো থেকে সাধারণভাবে কিছেু বোঝা না গেলেও একেকটি বিষয় নিয়ে পৃথকভাবে আলোচনা এবং বিবরণের সুযোগ আছে।

প্রায় ১৫ হাজার বছর পূর্বে ইয়োগার অস্তিত্বের যে প্রমাণ আমরা পাই—ধারণা করা হয় চুরাশি লাখ আসনের প্রচলন তখন ছিল। সেখান থেকে যুগে যুগে চুরাশিটি আসন সর্বজন স্বীকৃত হয়—যা  আদি চুরাশি নামে পরিচিত।  তবে এর বাইরেও অনেক আসনের প্রচলন আছে। প্রাণিজগতের প্রায় প্রতিটি প্রাণির আকার বা অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে এই আসনগুলোর সাদৃশ্য রয়েছে।

আদি ইয়োগি বা শিবের মাধ্যম যেই ইয়োগার ইতিহাস পাওয়া যায় তা পর্যায়ক্রমে প্রথমে সপ্তঋষি বা সাতজন ঋষির মাধ্যমে পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ইয়োগাকে গোছানো কায়দায় তুলে ধরার পিছনে যিনি অন্যতম তিনি হলেন পতঞ্জলি। তিনিই ইয়োগো সূত্র আবিষ্কার করেন এটি ব্যাকরণ সমৃদ্ধ একটি বিজ্ঞান। যেকোনো বিষয়ের গুছানো রূপকে বিজ্ঞান বলে সে অর্থে ইয়োগাকে বিজ্ঞান বলা যায়।

ধারণা করা হয় সমাজের বিশৃঙ্খলা ও মানুষের বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করতে যুগে যুগে যেমন ধর্মের প্রবর্তন তেমনি ইয়োগার আবির্ভারও ঘটে। কিন্তু সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা বা সহজলভ্য না হওয়ার প্রাথমিকভাবে ইয়োগাকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।

১. কর্ম ইয়োগা—কর্ম বা কাজই যখন ধ্যান হয় ধ্যান-জ্ঞান ও অসীমে বিলীন হওয়ার পন্থা তাকেই বলে কর্ম ইয়োগা। এক্ষেত্রে কর্মের ফল প্রত্যাশা থাকে না।

২. জ্ঞান ইয়োগা—ব্যক্তি যখন জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে ঈশ্বরের সন্ধানে নিজেকে বিলীন করে দেয় তাই জ্ঞান ইয়োগা। পরম সত্য জানার স্পৃহা একে ইয়োগা করে তোলে।

৩. ভক্তি ইয়োগা—সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি প্রেম ও ত্যাগই হলো ভক্তি ইয়োগা। একজন ক্ষুধার্তকে অন্ন দানও ভক্তি ইয়োগা।

৪. রাজা ইয়োগা—অষ্টাঙ্গ ইয়োগা আত্মস্থ করার মাধ্যমে ব্যক্তি যখন ইয়োগার আটটি অঙ্গ নিয়মিত চর্চা করে এবং নিজের অন্তরের সচেতন, অবচেতন, অচেতন ও অতিচেতন সত্তার সাথে পরিচিত হয়—তাই রাজা ইয়োগা।

৫. হাঠা ইয়োগা—ইয়োগার উপরোক্ত শাখাগুলো আত্মস্থ করার জন্য ব্যক্তিকে যথেষ্ঠ পরিমাণে উন্নত মন-মানসিকতা ও জ্ঞানের সন্ধানী হওয়ার প্রয়োজন কিন্তু সবার চরিত্রে এই গুণাবলী থাকা কঠিন। আর তখনই প্রয়োজন অনুভূত হয় শারীরিক আসন বা হাঠা ইয়োগার। যোগী সত্যরাম হাঠা ইয়োগার প্রবর্তক। ‘হাঠা ইয়োগা প্রদিপিকা’ নামক গ্রন্থে আসন, প্রাণায়াম, বান্ধাও মুদ্রা চর্চার মাধ্যমে দেহ ও মনের যে আধ্যাত্মিক পরিস্ফুটন ঘটে তারই ব্যাখ্যা দিয়েছেন যোগী সত্যরাম।

কালের বিবর্তনে বিভিন্ন ইয়োগি, মুনি, ঋষিদের মাধ্যমে যখন ইয়োগা বিস্তার লাভ করে তাদের নাম অনুসারে সেই ইয়োগার পরিচিতি পায়। যেমন আড়াই হাজার বছর আগে যখন পতঞ্জলি ইয়োগা সূত্র আবিষ্কার করলেন তার ইয়োগাটি হয়ে উঠে পতঞ্জলি ইয়োগা। কিন্তু সব ইয়োগার সূত্রপাত হাঠা ইয়োগা থেকে। ‘হা’ মানে সূর্য আর ‘ঠা’ মানে চন্দ্র।

চন্দ্র—সূর্য যেমন পৃথিবীকে সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তেমনি আমাদের দেহের ডানদিকে সূর্য দ্বারা বেশি প্রভাবিত এবং বাম দিক চন্দ্র দ্বারা। হাঠা ইয়োগা এমনভাবে বিন্যস্ত যা অনুশীলনের মাধ্যমে দেহ তথা মনের আধ্যাত্মিক সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে ব্যক্তিকে তার চরিত্রের সর্বোচ্চ গুণাগুণ পরিস্ফুটিত করতে সাহায্য করে।


• মহাখালী, ঢাকা

menu
menu