আনিস স্যার
দুই জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ও আনিসুজ্জামানের প্রথম সাক্ষাৎকারটির একটি বিবরণ পাওয়া যায় আনিসুজ্জামানের জবানিতে। আনিসুজ্জামান বলছেন,
… আমার পরীক্ষার ফল জেনে কিংবা মুনীর চৌধুরীর কাছে আমার প্রশংসা শুনে সম্ভবত রাজ্জাক সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। সেক্রেটারিয়েটে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করলাম। দেখলাম, শেরওয়ানি পরা ছোটখাট মানুষটি চেয়ারে প্রায় ডুবে আছেন। আমাকে বসতে বলে ঢাকার আঞ্চলিক ভাষায় জানতে চাইলেন, এমএ পাশ করে আমি কী করবো। বললাম, ইচ্ছে শিক্ষকতা করার, তবে তার আগে গবেষণা করবো। কী গবেষণা করবো জিজ্ঞাসা করায় জবাব দিলাম, আধুনিক সাহিত্য নিয়ে। রাজ্জাক সাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘ও আধুনিক সাহিত্য? তা আধুনিক সাহিত্য কইতে কী বুঝান আপনারা?’ কী বিপদে পড়তে যাচ্ছি, তা না বুঝেই জবাব দিলাম : উনিশ শতক থেকে রচিত সাহিত্য আধুনিক। এবারের জিজ্ঞাসা, কী কী লক্ষণ হলে আধুনিক হয়? বললাম, মানব প্রধান হলে আধুনিক, ধর্ম প্রধান হলে মধ্যযুগীয়। ‘তাহলে চৈতন্যচরিত কী?’ আমি একটু উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি, তার সূত্র ধরে তিনি আরও প্রশ্ন করেন। শেষ পর্যন্ত মনে হলো পালিয়ে আসতে পারলে বাঁচি। ক্লাসে যা শিখেছিলাম তার অনেকখানি ধুলিসাৎ হয়ে গেল।
আনিস স্যারের সঙ্গে আমার মৌখিক পরীক্ষার একটা স্মৃতি আছে। ১৯৯২ সালে আনিস স্যার আমাদের এমএ পরীক্ষার সময় ভাইভা করতে এসেছিলেন। তখন মৌখিক পরীক্ষায় অনেকক্ষণ প্রশ্ন করা হতো। আমাকে অন্তঃপরীক্ষক দিলওয়ার স্যার জীবনানন্দ আর সুধীন দত্তের কবিতা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। খুব ভালো করেছি এমন নয়। আনিস স্যার প্রশ্ন ধরলেন বঙ্কিম বিষয়ে। তখন একটা প্রশ্নের পর উত্তরদাতার উত্তর থেকে পাল্টা প্রশ্নের রেওয়াজ ছিলো। সেটা ছিলো খুব বিপজ্জনক। সাধারণত সে প্রশ্নে উত্তরদাতার দফারফা হতো। বেশ কিছু প্রশ্নের পর আনিস স্যার জানতে চাইলেন, কুন্দনন্দিনী আর রোহিণীর পরিণতি বিষয়ে। আমি উত্তর পারছি হয়তো সে আনন্দে বলে ফেললাম, কুন্দনন্দিনী নিজে আত্মহত্যা করে আর রোহিণীকে গোবিন্দলাল হত্যা করে। উনি বললেন, এই ছেলে, কুন্দনন্দিনী নিজে আত্মহত্যা করে মানেটা কি? নিজে কীভাবে আত্মহত্যা করে? আমার সব উচ্ছ্বাস শেষ। স্যার হেসে দিলেন। আমি ভাবলাম মনে হয় আমার সব শেষ। রুম থেকে বেরিয়ে আসার পরপরই খুবই উচ্ছ্বসিত ভূঁইয়া ইকবাল স্যারও বেরিয়ে এসে বিমর্ষ আমাকে বললেন, এই ছেলে, তোমার ভা্ইভা খুব ভালো হয়েছে। পরে বুঝেছি স্যারের কথা ঠিক। ফলাফল প্রকাশের পর দেখি সে যুগের তুলনায় প্রচুর নম্বর পেয়েছি।
আনিসুজ্জামান আমার শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক ছিলেন না। সে সুযোগ আমি পাই নি। ১৯৮৫ সালে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, সে বছর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। আমাদের ক্লাস তখনো শুরু হয় নি, কিন্তু বাংলা বিভাগের ছাত্ররা তাঁকে রেখে দিতে আন্দোলন করছে এমন একটি সংবাদ ‘দৈনিক আজাদী’ পত্রিকায় দেখেছিলাম। পরে তাঁর আত্মজীবনীতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার বিষয়ে ব্যাখ্যা পড়েছি। তবু তিনি আমার শিক্ষক। আমি তাঁর নাম নেয়ার সময় ‘আনিস স্যার’ই বলতাম সবসময়। অনার্স প্রথম বর্ষে আমরা চর্যাপদ পড়তাম, একটা প্রশ্ন আসতো ‘টিলায় বসবাসকারী ব্যাধদের জীবনচিত্র বাদ দিলে চর্যাপদের সবটাই নগর জীবনের চিত্র’—এ উক্তি উল্লেখ করে প্রশ্নটা হতো। আমি খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাই তাঁর ‘স্বরূপে সন্ধানে’ বইটা। সে বইয়ের একটা প্রবন্ধ ‘চর্যাপদের সমাজচিত্র’। সে প্রবন্ধে উক্তিটা ছিলো। পরে জানতে পারি এটা তাঁর একটা বক্তৃতার লিখিত রূপ। তাঁর বেশির ভাগ লেখা আসলে দেশ-বিদেশে দেওয়া তাঁর বক্তৃতার লিখিতরূপ। এ ছাড়া আর দুধরনের লেখা বেশি পাওয়া যায়। একধরনের লেখা কোনো বরেণ্য ব্যক্তি সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়নধর্মী স্মৃতিচারণ আর বিভিন্ন সম্পাদনা গ্রন্থের ভূমিকা। এ সব লেখা পড়লে তাঁর প্রাজ্ঞ-মনস্বিতার পরিচয় ফুটে ওঠে। তাঁর জীবনাভিজ্ঞতা ছিলো ব্যক্তিত্ববান মহৎ মানুষদের সঙ্গে ওঠা-বসায় পূর্ণ। কৌতূহলবশত ‘চেনা মানুষের মুখ’ নামের বইটা পড়ে আমি খুব পছন্দ করে ফেলি। সঙ্গে সঙ্গে বইটার একটা দীর্ঘ আলোচনা করে ‘কালি ও কলমে’ পাঠিয়ে দেই। সম্পাদক লেখাটা সঙ্গে সঙ্গে ছেপে দেন। এ বইটাতেও তিনি চারপাশের লোকজন নিয়ে লিখেছেন।
তাঁর আপাত সরল নির্মেদ গদ্যের ভেতরে ছিলো বক্তব্যের স্পটত্ব আর যুক্তির শাণিত প্রয়োগ। সে বইতে আরেকটা প্রবন্ধ আমাকে আলোড়িত করে ‘স্বরূপের সন্ধানে’ নামে। আমাদের জাতিসত্তার উপাদানে নানাবিধ সম্পর্কের যোগ-বিয়োগ নিয়ে আমি ভাবতে থাকি সে সময়ে। দ্বিতীয় বর্ষে অনার্স ক্লাস শুরু হলে ময়ুখ চৌধুরী আমাদের ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ পড়াতে আসেন। তিনি একবার শ্রেণিকক্ষে বলেছিলেন, ‘পরীক্ষার খাতা আপনার জ্ঞান জাহির করার জায়গা না, আপনার অজ্ঞানতা যে নেই সেটা প্রকাশ করার জায়গা। খাতায় সব সময় নির্মেদ সরল গদ্য লিখবেন। আনিসুজ্জামানের গদ্য আদর্শ মানবেন।’ আসলে এভাবেই আনিস স্যারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আমি তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্যের একান্ত অনুরাগী পাঠক হয়ে যাই। অবশ্য এ নিয়ে আমাকে অনেকে ভর্ৎসনাও করেন।
দুই.
আনিসুজ্জামানের ‘মুনীর চৌধুরী’ নামে একটা ছোট বই আছে। সে বইটি পড়ে সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত বলেছিলেন, ‘নিজেকে আড়াল রাখিয়াছেন বলিয়াই মুনীর চৌধুরীর আলেখ্য খুব সুন্দর হইয়াছে।’ আমরা জানতাম মুনীর চৌধুরী ছিলেন তাঁর শিক্ষক ও বন্ধু। ১৯৭১ সলে মুনীর চৌধুরীর অকাল অকাল মৃত্যু তাঁকে প্রবল বেদনাহত করেছে। সে বইয়ের প্রথম অংশে তিনি বলছেন, ‘আমার বিদায়-সভায়… বলেছিলেন তিনি (মুনীর চৌধুরী) : এখন প্রতিদিন আটটা বাজবে, নটা বাজবে, এগারোটা বাজবে—আনিসের সঙ্গে দেখা হবে না।” তখন তিনি কি জানতেন যে আমার জন্যে এমন সময়ও আসবে, যখন দিন যাবে, মাস যাবে, বছর যাবে, তবু তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না—কোনো দিনও না?’ আনিসুজ্জামান এ কাজটি ভালো পারতেন। এ কারণে তাঁর তিন খণ্ডে রচিত আত্মজীবনী কেবল আত্মজীবনী থাকেনি এটা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হয়ে উঠেছে। তিনি নিজে মনে করতেন, আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উত্থান-পতনের সঙ্গে জড়িত বড় বড় মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর জানাশোনা ছিলো। সে কারণে তাঁর আত্মজীবনী লিখে ফেলা দরকার। আমার মতে, এটা ছিলো তাঁর নির্ভুল উপলব্ধি। তাঁর আত্মজীবনীতেও তিনি নিজের কথা বলতে গিয়ে সমাজের কথাই বেশি বলেছেন। আর এ কারণে এ গ্রন্থ আমাদের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে। ইতিহাসকে তিনি দেখতেন নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে। তিনি ২০০৫ সালে ইতিহাস সমিতির বার্ষিক সভায় বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘ইতিহাসের সমগ্রতা আজ নানা কারণে খণ্ডিত। কিন্তু সেই খণ্ডগুলোকে কি আমরা কখনো মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করবো না? দুদিক দিয়ে দেখলে দুরকম দেখায়, তার মধ্য থেকে আমরা কি সত্যকে দেখার প্রয়াস পাবো না?... আমরা সেই সব ইতিহাসবিদদের অপেক্ষায় থাকবো, যাঁরা খণ্ডতার মধ্যে অখণ্ড মানবসত্তাকে, ভিন্নতার মধ্যে জ্ঞানানুসন্ধানের ঐক্যকে আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠা করে আমাদের সন্দেহ ও শঙ্কা দূর করবেন। ‘ইতিহাসকে এভাবে দেখতেন বলে তাঁর আত্মজীবনী সমগ্রতার সন্ধান করতে সক্ষম হয়েছিলো।
তিন.
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আনিসুজ্জামান উচ্ছ্বসিত ছিলেন। এটা তাঁর স্বাভাবিক প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে সবটা যায় না। তিনি সে সময় বলতেন, এ যুদ্ধ আমাদের দুটো জিনিসের চির বিদায় দিয়েছে। সামরিক শাসন ও বাঙালি-জাতিসত্তার পরিচয় সংকট। দুটোই যখন প্রবল বিক্রমে ফিরে এসেছে তখন খুব হতাশও হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে যা যা বলা হয়, তা ১৯৪৯-এর দশকে মুসলিম লিগের দ্বিজাতিতত্ত্বের ব্যাখ্যার সঙ্গে অভিন্ন।’ কিন্তু আশা ত্যাগ করেন নি। তাই বলেছিলেন, “আমার আশা বাঙালি আত্মপরিচয়ের অপরাজেয় ভাব সকল প্রতিকূল বাস্তবতাকে অতিক্রম করে যাবে। ব্যক্তির ও সমষ্টির আত্মপরিচয়ের সঙ্গে বাঙালি আত্মপরিচয়ের নানানরকম সংঘাত ঘটতে পারে ভবিষ্যতে, তবে আমি নিশ্চিত যে, বিশ্বজনীন মানব পরিচয়ের সঙ্গে তাঁর কখনো বিরোধ হবে না।”
আমলাতন্ত্রকে তিনি নিজের জন্য উপযোগী মনে করতেন না। তাই স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু তাঁকে শিক্ষা-সচিব হিসেবে নিয়োগ দিতে চাইলে তিনি তাজউদ্দিনকে গিয়ে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের সামনে আমি না করতে পারবো না। আপনি এ নিয়োগ থামান। মনে রাখবেন আমাকে নিয়োগ দিলে সরকার একজন ভালো শিক্ষক হারাবে আর একজন খারাপ আমলা পাবে। অর্থাৎ তিনি যার যা করা দরকার তার তাতে বিশ্বাস করতেন। এখন আমরা দেখি সে বাস্তবতা পাল্টে গেছে। আমাদের বর্তমান প্ল্যানিং কমিশন আর বঙ্গবন্ধুর প্ল্যানিং কমিশনের সদস্যদের ব্যাকগ্রাউন্ড তুলনা করলে এর সত্যতা মিলবে। এটা জাতির জন্যে সুখকর নয়।
আনিসুজ্জামান সুবিধাবাদের চোরাগলিতে পা দেননি, এটা তাঁর ব্যক্তিত্বের আরেক পরিচয়। তাঁর ছাত্রীকে তিনি দীর্ঘকাল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখেছেন কিন্তু সুবিধা নেওয়ার জন্যে ছুটে বেড়ান নি। তাঁকে তাঁর ছাত্রী নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিয়োগ দিলে খুব খুশি হয়েছিলেন। মজা করে লিখেছিলেন, এটা শিক্ষকের প্রতি ছাত্রীর ‘গুরু দক্ষিণা’। পরে তিনি বাংলা একাডেমির আজীবন চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তাঁর জীবন থেকে আমরা এই সুবিধাবাদকে সরিয়ে রাখার যে মানসিক শক্তি সে শিক্ষাটা নিতে পারি।
চার.
আনিসুজ্জামান একেবারে অসময়ে চলে গেলেন। ৮৩ বছর বয়স হয়তো কম সময় নয়, কিন্তু বাংলাদেশের এ সময়টা করোনা মহামারীর কারণে দুঃসময়। এ সময়ে চলে যাওয়া বড়ই বেদনার। আমি একবার চট্টগ্রাম জেএমসেন হলে বঙ্কিমের ওপর তাঁর একটা বক্তৃতা শুনেছিলাম। বলছিলেন, ইলিশ মাছ যেমন সুস্বাদু কিন্তু কাটাসহ খাওয়া বিড়ম্বনার; বঙ্কিম হচ্ছেন তেমন, ঔপন্যাসিক হিসেবে সুস্বাদু কিন্তু কাঁটা বেছে খেতে হবে আর কি! করোনায় তাঁর মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। হয়তো আরও কয়েকটা বছর বেঁচে থাকতে পারতেন। দিতে পারতেন আরও কিছু প্রাজ্ঞতা আমাদের। করোনা সে সুযোগ থেকে বচ্ঞিত করলো। মুনীর চৌধুরীর মৃত্যুতে বলেছিলেন, “তাঁর (মুনীর চৌধুরী) হৃদয়োন্মাদকর বক্তৃতা আর শুনতে পারবো না আমরা। আমাদের চিত্তে শূন্যতার স্থায়ী উপলব্ধিকে গভীরতা দান করে তিনি হারিয়ে গেলেন, আনিস স্যারের মৃত্যুতে আমিও এ কথাটাই বলি।
• কোটবাড়ী, কুমিল্লা