লুইস গ্লিকের কবিতা

[ভীষণ এক অন্তর্মুখী কবি লুইস গ্লিক। মানুষের না বলা কথা, আবেগ ও কষ্টের অনুভূতি তিনি কবিতায় এনেছেন নিজের কাব্যিক ভাষায়। Winter Recipes From the Collective কাব্যগ্রন্থে আমরা অনেকগুলো নতুন ভাবনার সন্ধান পাই। তিনি পছন্দ করতেন প্রকৃতির কোন উপাদানের সঙ্গে জীবনটাকে মিলায়ে কবিতা নির্মাণ। এই কাব্যগ্রন্থে মানব জীবনের সঙ্গে সরাসরি মানব জীবনের। মানুষকে দাঁড় করিয়েছেন মানুষের সামনে।  আগের কাব্যগ্রন্থগুলোতে রোমান ও গ্রিক মিথোলজির যথেষ্ট উপাদান আছে। এই গ্রন্থে জীবনের জন্য সন্ধান করেছেন প্রাচীন চীনের দার্শনিকদের শিক্ষা। আরও একটা বিষয় লক্ষণীয় যে সু্য়েরিলজম, পূর্ব আধুনিক বা আধুনিক উত্তর—কোনো কিছুকেই তিনি তোয়াক্কা করেননি, সহজ, সরল ও শিল্পিত করে প্রকাশ করেছেন তার বক্তব্য। 

কবি লুইস এলিজাবেথ গ্লিক ১৯৪২ সালের ২২ এপ্রিল জন্ম নেন নিউ ইয়র্ক সিটিতে। বেড়ে উঠেন লং আইল্যান্ড সিটিতে। তাঁর মা রুশ দেশের। বাবার পূর্বসূরীরা এসেছে হাঙ্গেরি থেকে। বাবার নাম ড্যানিয়েল গ্লিক। আর মা বিয়েট্রিস গ্লিক। 
২০২০ সালে লুইস গ্লুক সাতাশ বছর যাবৎ সৃষ্টি অসামান্য সাহিত্যে কর্মের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তার আছে অবিশ্বাস্য কাব্যিক ক্ষমতা। সরল ও সাবলীল ভাষায় তুলে ধরেন তিনি নিজের অন্তর্লীন কথা যা ব্যক্তিগত অস্তিত্বকে ছাপিয়ে সর্বজনীন হয়ে ওঠে। 
গ্লুকের কবিতার শব্দগুলো উঠে এসেছে নিজের অন্তর থেকে। সেই কবিতার কথাগুলো হয়তো হতাশা, প্রত্যাখ্যান, ক্ষতি এবং বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে কিন্তু পাঠক শেষে তৃপ্ত হয় অপরিসীম তৃপ্তিতে। 
তিনি ইয়েলে অধ্যাপক ও আবাসিক কবি হিসেবে কাজ করছিলেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান ১৩ অক্টোবর ২০২৩ এ।]


 
মৃত্যুকে অস্বীকার
(এক \ একটা ভ্রমণের দিনলিপি)

আমার পাসপোর্ট ফেলে রেখে এলাম একটা হোটেলে যেখানে ছিলাম একরাত বা এরকম কিছু 
যার নাম আমি মনে করতে পারিনি। 
এই ভাবেই হলো শুরু। 
পরের হোটেল আমাকে গ্রহণ করবে না, 
ভীষণ সুন্দর হোটেল একটা কমলার বাগানের ভেতর, আবার সেখান থেকে দেখা যায় সমুদ্র, 
কতটা অকপটে মেনে নিলে যে ঘরটা আমাদের হবাব কথা 
আর তুমি তার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কত আনন্দের সাথে,
ছুড়ে মারছো আমার দিকে ফয়েল-মোড়ানো চকলেট।  
পরের দিন পুনরায় শুরু করলে সফর তোমার নিজের পথ,
যা আমরা শুরু করেছিলাম এক সাথে। 

হোটেলের সেবক একটা পুরোনো কম্বল যোগাড় করলো আমার জন্য। 
দিনের বেলা কাটে রান্নাঘরের বাইরে বসে। রাতে আমি থাকি কমলা গাছের মাঝে কম্বল বিছায়ে। 
প্রতিদিন যায় এই একই নিয়মে যদি আবহাওয়ার হেরফের না হয়। 

একটা সময় পর আমার ওপর মায়া মায়া হলো হোটেলের কর্মচারীদের।
এক বাসবয় সন্ধ্যার খাবার থেকে আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতো,
অদ্ভুত আলু বা ভেড়ার মাংস। মাঝে মাঝে একটা পোস্টকার্ড আসত।
যার সামনে ঝকমকা দালানবাড়ি ও প্রসিদ্ধ চিত্রকর্ম।
একবার পেলাম একটা কার্ড বরফে ঢাকা পাহাড়। প্রায় মাস খানেক পর,
একটা পোস্টকার্ড পেলাম, তাতে পুনশ্চতে লেখা : অচেনা কেউ পাঠালো সম্মান। 

আমি বলবো এক মাস, কিন্তু সত্যি বলতে সময় সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না।
সেই বাসবয় একদিন অদৃশ্য হয়ে গেল। এখন নতুন একজন,
তারপর আরও একজন, আমার যতটুকু মনে পড়ে। 
সময়ে সময়ে একজন যোগ দিতো আমার জন্য কম্বল নিয়ে। 

সেই দিনগুলো ছিল আমার খুব ভালোবাসার!  প্রতিটা দিন একদম আগের দিনের মতো। 
আমরা একসাথে পাথরের ধাপ বেয়ে উঠেছিলাম
একটা ছোট শহর যেখানে আমরা সকালের নাস্তা করেছি। বেশ অনেক দূরে,
দেখতে পাচ্ছি আমি সেই খাঁড়ি যেখানে আমরা সাঁতার কাটতাম, 
কিন্তু এখন আর শুনি না শিশুদের একে অপরকে ডাকতে, আর শুনতে পাই না তোমাকেও, 
আমাকে জিজ্ঞেস করতে আমি ঠান্ডা পানীয় চাই কি না, যা আমি সবসময় চাইতাম। 

পোস্টকার্ড আসা যখন বন্ধ হয়ে গেল,
আমি আবার পুরোনোগুলো মেলে পড়ি। 
আমি ফয়েলে মোড়ানো কিসেস চকলেটের বৃষ্টিতে বারান্দায় দাঁড়ায়ে নিজেকে দেখলাম
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে আমাকে ছেড়ে চলে গেছো তুমি,
তোমাকে চেয়েছি মনে প্রাণে কতবার যদিও প্রকাশ করিনি মুখে—

আমি বুঝলাম, হোটেলের সেবক আমার পাশে দাঁড়িয়ে,
বলল, দুঃখ করো না, তুমি শুরু করেছো তোমার নিজের অভিযাত্রা, 
সেই জগতে তোমার বন্ধুর মতো, 
কিন্তু তোমার নিজের ভেতর ও নিজের স্মৃতিতে। 
দূরে সড়ে গেলে, হয়তো নাগাল পাবে তুমি সেই একান্ত চাওয়া শূন্যতা 
যার ভেতর দিয়ে যাবতীয় বিষয় প্রবাহিত হয়, দাওদেজিং-এর খালি পেয়ালার মতো। 

আরো বলল, সবকিছুই পরিবর্তনশীল, এবং সবকিছুতেই আছে নাড়ির যোগ,  
অবশ্য সবকিছু ফিরে আসে, কিন্তু যা ফিরে আসে তা ঠিক তার মত নয় যে চলে গেছে—

আমরা তোমাকে চলে যেতে দেখলাম
পাথরের সিঁড়ি ভেঙে নেমে ছোট্ট শহরে। 
অনুভব করলাম কিছু সত্য কথা যা বলা হয়ে গেছে 
এবং যদিও আমি এই কথা বলতে পছন্দ করতাম 
নিজের ভেতর একাকী,
অন্তত আমি খুশি হয়েছিলাম সেই কথাগুলো শুনে।
 

(দুই \ পাসপোর্টের গল্প)

পাসপোর্ট ফিরে এলো কিন্তু তুমি ফিরে এলে না।
ব্যাপারটা ঘটলো এভাবে :

একদিন একটা খাম এলো যার গায়ে আটকানো ডাকটিকিট, 
এসেছে ছোট একটা ইউরোপীয় প্রজাতন্ত্র থেকে। 
এই সেই সেবক যে আমাকে একটা দুর্দান্ত উৎসবের আবহ দিয়েছিল; 
আমিও একই উদ্দীপনায় খামটা খোলার চেষ্টা করলাম। 
খামের ভেতরে আমার পাসপোর্ট।

আমার মুখের ছবি তাতে, আমার মুখে কী ছিল কোনো এক সময়ে, অতীতের অতলে। 
কিন্তু আমার সাথে আলাদা হয়েছে তার পথ 
যে মুখ হাসে এমন দৃঢ় প্রত্যয়ে,
আমাদের একসাথে ভ্রমণের তাবৎ স্মৃতি এবং অনেক অভিযাত্রার স্বপ্নে পূর্ণ—

আমি সমুদ্রে ছুড়ে ফেলে দিলাম পাসপোর্ট। 

সাথে সাথে ডুবে গেল। 
নিচের দিকে, আস্তে আস্তে নিচের দিকে, আমি তখন শূন্য পানির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। 

হোটেলের সেই সেবক আমার ওপর নজর রেখেছিল সব সময়। 
আমার বাহু ধরে সে বলল, আসো।
আমরা হ্রদের চারপাশে হাঁটতে থাকি, যা ছিল আমার প্রতিদিনের অভ্যাস। 

সে বলল, আমি বুঝতে পারছি তুমি আর আবার শুরু করতে চাও না আগের জীবন,
এই যে আমাদের পা বাড়ানো সময়ের তাগিদে একটা সরল রেখায়, 
সে হ্রদের দিকে শরীর ঝুঁকায়ে বলল, যা বরং বাঁক নেয় বৃত্তে 
যা উদ্বেলিত করে জড়তাকে কোন কিছুর কেন্দ্রে, 
যদিও আমি ভাবতে পছন্দ করি পুরো বিষয়ের সাথে আছে একটা ঘড়ির সাযুজ্য। 

এরপর সে পকেট থেকে বের করলো
বড় ঘড়ি যা সবসময় তার সাথে থাকে। 
সে বলল, আমি বাজি ধরে বলে পারি তোমাকে দিনের নাম সোমবার বা মঙ্গলবার এই ঘড়ি দেখে। 
কিন্তু তুমি যদি তাকাও হাতটার দিকে যা ধরে আছে, 
তুমি বুঝবে আমি আর যুবক নই, আমার চুলের রং হয়েছে রুপালি। 
আমি বলতে চাইলাম, জানি তুমিও জেনে অবাক হবে না যে এক সময় 
এই চুল ছিল ঘন কালো যেমন তোমার চুল ছিল অবশ্যই ঘন কালো ও কুঁকড়ানো 

এই কথাবার্তার ভেতর আমরা দুজনে
দেখছিলাম হ্রদের অগভীর জলে একদল শিশুদের খেলতে 
তাদের শরীর ঘিরে রাবারের টিউব। 
লাল এবং নীল, সবুজ এবং হলুদ,
স্বচ্ছ হ্রদে শিশুদের জলের ছিটায় রংধনু।

আমি ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম 
ইঙ্গিত করছিল সম্ভবত সময়ের বিবর্তনের দিকে 
বাস্তবে তখন এটাকে অসাড় করে দিচ্ছিল।  

নিজেকে প্রতারিত করছো কি না জিজ্ঞাসা করতে হবে অবশ্যই নিজেকে, সে বলল। 
এই কথা বলে আমি বোঝাতে চেয়েছি আমি ঘড়ির দিকে তাকাতে চাই, 
ঘড়িটা ধরে রাখা হাতের দিকে নয়। 
আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম হ্রদের দিকে তাকিয়ে, 
আমরা ভাবছিলাম আমাদের নিজেদের চিন্তা-ভাবনাগুলো নিয়ে। 

এটা কিন্তু ঠিক দার্শনিকের জীবন নয় ঠিক যেমন বলে বলে গেলে, আমি বললাম। 
ভেসে যাই একই ধারার আবর্তে, অপেক্ষা শুধু সত্যটার জন্য 
যখন সে নিজ থেকে উদ্ঘাটিত হয়। 

কিন্তু তুমি ভাবনা করা বন্ধ করে দিয়েছো, সে বলল, এটাই তো দার্শনিকরা করে। 
মনে আছে যখন তুমি লিখে রাখতে যার নাম দিয়েছিলে তোমার পথযাত্রার দিনলিপি?
আমাকে পড়ে শোনাতে, আমার মনে পড়ে সব ধরনের গল্পে ভরা ছিল, 
বেশিরভাগ প্রেমের ও হারানোর গল্প, 
বিরাম চিহ্ন দিয়ে খুঁটিনাটি চমৎকার বর্ণনায় যেমনটা আমাদের সবার বেলায় ঘটে না,

তবুও সে সব শুনতে শুনতে আমার ভেতরে একটা অনুভুতি হতো আমি যেন শুনছি
আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা
যা আমি করতে পারতাম না তার চেয়েও চমৎকার ভাবে সম্পর্কিত। 

আমি অনুভব করতাম 
তুমি আমার সাথে কথা বলছো বা আমার সম্পর্কে বলছো
যদিও আমি কখনই তোমার পাশ ছেড়ে যাইনি। 
এটাকে কী বলে?  একটা অভিযাত্রার কাহিনি, আমার মনে হয় তুমি বলেছিলে, 
যদিও আমি প্রায়ই বলি এটাকে ‘মৃত্যুকে অস্বীকার’ আর্নেস্ট বেকারের বইয়ের নাম থেকে নেয়া। 
এবং তুমি একটা অদ্ভুত নামে ডাকতে আমাকে, আমার মনে পড়ে। 

‘সেবক’, আমি বললাম। ‘সেবক’ বলে আমি তোমাকে ডাকি। 
এবং তার আগে ডাকতাম ‘তুমি’ বলে যা আমি বিশ্বাস করি 
একটা অলীক গল্পের সম্মিলন।


তূয়া নূর অনুবাদক। বর্তমানে ওয়ালমার্ট ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট হিসেবে কর্মরত। কবিতা, ছড়া, গল্প ও অনুবাদ প্রিয় বিষয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতে বসবাস করেন। 

menu
menu