সমর্পণ বিশ্বাস

আচমকা বাস হইতে নামিয়া পড়িলাম। 
সড়কের প্রতিটি ইঞ্চি হইতে পৃথক তাপোৎসসম উষ্ণতা শোষণ করিয়া এই ভারি দেহখানি মূর্ছিত হইবার উপক্রম। নির্ভেজাল তাপদাহ মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ চিন্তাধারার প্রখরতাকে বিবশ করিয়া তুলিতেছে। তখনই ভদ্রলোকের সহিত দেখা হইলো। তেল জর্জরিত কেশদাম ঘাড় ছাপাইয়া আরও নিচে নামিবার প্রয়াসে রত। ঠোঁটের ওপর অতি সরু গোঁফ জোড়া পুরাতন কোনো এক অভিনেতাকে মনে করিয়া দিতেছিল। আমাকে দেখিয়া ভদ্রলোক বড্ড আগ্রহভরে আগাইয়া আসিলেন। 
‘অনেক দিন পরে হে! কোথায় থাকা হয় আজকাল?’
বলা বাহুল্য, আমি একেবারেই তাঁহাকে চিনিতে পারি নাই। তবু বদনে তাহা প্রকাশ করিতে না দিয়া পালটা হাসি ফিরাইয়া দিয়া কহিলাম,
‘এই তো পাশেই। এই রাস্তা বরাবর গিয়ে হাতের ডানপাশে একটা গলি পড়ে না? ওটা থেকে খানিকটা গেলেই একটা ৬ তলা বাড়ির দোতলায় থাকি।’
‘বাহ! বাহ! বেশ বেশ!’ পরিতৃপ্তির হাসি হাসিয়া ভদ্রলোক কহিলেন। 
আমার হাতে তেমন ব্যস্ততা ছিল না। এইজন্য এই বিচিত্রদর্শন ভদ্রলোকের সহিত আরও খানিকক্ষণ কাটাইবার লোভ ঠিক সামলাইতে পারিতেছিলাম না। আশেপাশেও মানুষজন হাঁটিয়া যাইবার সময় লোকটির দিকে তাকাইয়া তাকাইয়া দেখিতেছিল। 
‘চলো হে, চা খাই কোথাও’
‘চলুন’
অন্যসময় চায়ের প্রতি বিশেষ আগ্রহী না হইলেও আজ বিশেষ কারণে গিয়া হাজির হইলাম। 
‘তুমি আমাকে চিনতে পারোনি, তাই না?’ মুখে একখানি হাসি ঝুলাইয়া ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করিলেন। 
আমি ভয়াবহ রকমের অপ্রস্তুত হইয়া পড়িলাম। অনেকটা চুরি করিতে গিয়া ধরা পড়িয়াছি এরকম মুখভঙ্গি করিয়া হাত কচলাইতে লাগিলাম। 
‘চিনবার কথাও না। আমাদের আগে কখনো দেখা হয়নি। তুমি কে তাও আমি জানি না, কিন্তু তোমাকে দেখামাত্র আমার বোধ হলো যে তুমিই কাজটা করতে পারবে।’
ওই স্থানে বসিয়া থাকা আমার জন্য ক্রমশ কঠিন হইয়া পড়িতেছিল। ভাবিলাম, উঠিয়া যাইবো কিন্তু এক অমোঘ শক্তি যেন আমাকে সেই স্থানেই বাঁধিয়া রাখিয়া দিলো। 
‘আপনি কে?’ কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন করিলাম। ভদ্রলোক উত্তর করিলেন না।
চায়ের দোকানদার সবেমাত্র চা লইয়া আসিয়াছিল। তাহার আগেই আমার হাত ধরিয়া টানিয়া দোকানের বাহিরে লইয়া আসিলেন। 
‘তোমাকে কিছু করতে হবে না। শুধু আমার সাথে একটু থাকো। আর বেশি প্রশ্ন কোরো না। আস্তে আস্তে সব জানাবো আমি তোমাকে।’
বলিয়া ভদ্রলোক হাঁটিতে আরম্ভ করিলেন। কেমন যেন মন্ত্রাচ্ছন্নের মতো আমিও তাঁহার পিছে পিছে হাঁটিতে থাকিলাম। হাঁটিতে হাঁটিতে পশুপাখির দোকানের সামনে হাজির হইলেন। ততক্ষণে ঘর্মবিন্দুগুলি সংযুক্ত হইয়া আমার সারা শরীরকে আচ্ছন্ন করিয়া তুলিয়াছে। নিঃশ্বাসের সহিত যেন অগ্নিবাষ্প নিঃসৃত হইতেছে। তাহার ভেতরই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ দামাদামি করিয়া ভদ্রলোক একখানি মিশমিশে কালো বিদেশি বেড়াল কিনিলেন, খাঁচাসমেত বেড়ালখানা আমাকে দিলেন ধরিতে। ইহার পর খানিকটা আবার হাঁটিয়া গিয়া কয়েকটা রজনীগন্ধা কিনিলেন। কিনিবার পর সেগুলিও আমার হস্তে চালান করিলেন।
অসম্ভব অস্থিরতা বোধ হইলেও এক অদম্য কৌতূহলে আমি তখনো অন্ধের মতো তাঁহাকে অনুসরণ করিয়া যাইতেছি। ইহার পর আমাকে লইয়া এক রিক্সায় উঠিলেন। এমন এক ঠিকানা বলিলেন যাহার অস্তিত্ব যে এই শহরে ছিল আমি তাহাই জানিতাম না। পুরো রাস্তায় আমি আবারও কী ঘটিতেছে জিজ্ঞাসিবার বিপুল আকর্ষণ বোধ করিলেও মুখ হইতে একখানি শব্দও বাহির হইলো না। রিক্সা যখন আসিয়া ওই ঠিকানায় থামিয়াছে, ততক্ষণে আকাশ কালো হইয়া আসিতেছে। বৃষ্টি ঝরিবে ঝরিবে এমনই ভাব। 
দরজা ঠেলিয়া বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করিলাম, কেহ আটকাইলো না। বাড়িখানা দোতলা, সামনে একখানি ছোটোখাটো উঠান। তবে যাহা আমাকে সবচাইতে বিস্মিত করিলো তাহা হইলো সদর বারান্দার সন্নিকটেই একখানি কুয়া, যাহা এখন আর কোনো বাড়িতে একেবারেই দেখা যায় না। ভদ্রলোক যন্ত্রের ন্যায় কুয়ার দিকে আগাইয়া গেলেন। আমিও আগাইলাম। উঁকি মারিতেই আচমকা বুক কাঁপিয়া উঠিলো, যেন এক অতল কুয়া। বিধাতা যেন সকল নীরবতা একজোট করিয়া এই কুয়ার মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়া দিয়াছেন। ইহার গভীরতা যেন পৃথিবীর কেন্দ্রে পৌঁছাইয়া গিয়াছে। 
আমাকে আরও একবার বিস্মিত করিয়া ভদ্রলোক আমার হাত থেকে রজনীগন্ধা ফুল লইয়া একটি একটি করিয়া কুঁড়ি কুয়ার মধ্যে ফেলিতে লাগিলেন। এরকম করিতে লাগিলেন যতক্ষণ না সবগুলি ফুলের রিক্ত দণ্ড অবহেলায় পড়িয়া রইতেছে। বোধহয় খানিকটা বিরক্ত হইয়া উঠিতেছিলাম, আমি বরং বেড়ালটির দিকে মনোযোগ দিলাম। নিচু হইয়া খাঁচার দরজা খুলিয়া দিলাম, তথাপি সে বাহিরে আসিবার কোনোপ্রকার আগ্রহ দেখাইলো না। কী এক মহাজাগতিক আলস্যে একই রকম গম্ভীর মুখে গুটিশুটি মারিয়া বসিয়াই রইলো। আমি এক হাত বাড়াইয়া দিয়া মুখ দিয়া চু চু করিয়া শব্দ করিলাম। খানিকটা অনিচ্ছাভরেই যেন বেড়ালটি তখন খাঁচা ছাড়িয়া বাহিরে আসিয়া পড়িলো। ঠিক একই মুহূর্তে অকস্মাৎ আকাশ চূর্ণ করিয়া বৃষ্টির বিন্দুগুলো ধরণীকে সিক্ত করিতে আরম্ভ করিয়াছে। 
বৃষ্টি পড়া শুরু হইতেই শ্রীমান মার্জার এক দৌড় দিয়া পাশের একখানা গাছের নিচে আশ্রয় লইলো। ভদ্রলোক ততক্ষণে সকল রজনীগন্ধাকে কুয়াতে নিমজ্জিত করিয়া আমার দিকে ফিরিয়াছেন। আমার চোখে চোখ রাখিয়া তাকাইলেন। মনে হইলো, ওই মুহূর্তে আমার সকল প্রশ্নের উত্তর দিয়া আমার কৌতূহলের অগ্নিকে মমতার সহিত নির্বাপন করিতে তিনি প্রস্তুত। বৃষ্টির ধারা তখন আমার শরীর বাহিয়া ভেতরকার সকল অস্থিরতা শুষিয়া লইয়া যাইতেছে। হতাশ জীবনের সকল নিরাশা যেন ওই রজনীগন্ধার সাথে সাথে কুয়াতে হারাইয়া গিয়াছে, আর আমার নিঃসঙ্গ দিনগুলির বিষণ্নতা ধারণ করিয়া ওই বেড়ালটি আমাকে পুনর্জন্মের আহ্বান করিতেছে। কেমন একটা সমাধিস্থ হইবার অনুভূতি হইলো, মনে হইলো ভদ্রলোকের ভিতর হইতেই আমার ভিতর এই অনুভূতি সঞ্চারিত হইয়াছে। 
ইহাকে আর নষ্ট করিবার ইচ্ছা হইলো না। ভদ্রলোককে আর কিছু উচ্চারণ করিবার সুযোগ না-দিয়াই আমি তাহাকে প্রস্তরবৎ সেখানে রাখিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিলাম। 
কিছু কিছু দিন অজ্ঞাত থাকাই শ্রেয়ান। 


সমর্পণ বিশ্বাস কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি শিল্পের নানা মাধ্যমে স্বাচ্ছেন্দ্যের সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি ঢাকায় বসবাস করেন।

menu
menu