মহি মুহাম্মদ

রাতের কি নিজস্ব শব্দ আছে? কখনো কি কান পেতেছেন? যারা কান পেতে থাকে, তারা শোনে। রাতের শব্দ তারা খসার মতো খসে যায় নির্জন ছাদের কার্নিশে। বোটা খসা কলিজায় সে শব্দ কখনো ধরা পড়ে। আবার মহাশূন্যের রথে সে শব্দ লীন হয়ে যায়। এমনি এক রাত। ছাদে কারও পায়ের শব্দ। বাতাসে কামিনীর ফুলের সৌরভ। আকাশে জেগে থাকা দীঘল রাত্রি। বকুলের এসব গা সওয়া হয়ে গেছে। এসব কিছুই কামিনীর কারসাজি। সে বোঝে। কামিনীর মন সে ছাড়া আর ভালো কে বোঝে?
কামিনীর খিলখিল হাসি মধ্যরাতে তোলপাড় তোলে। ঘুমের দেশে বেহুশ নগরীর মানুষ কামিনীর এমন হাসির হদিস হয়তো পায় না। কিংবা পাওয়ার ভাগ্য করে আসেনি বলে মনে হয় কামিনীর। এই আফসোস মনে ধরার পর তার মনের গহনে যে ছবিটি থির হয়ে আসে, সে আর কারও নয়-বকুলের। বকুলের গোঁফওয়ালা ব্যক্তিত্বময় চেহারার কাছে শিমুলের উচ্ছ্বল চৌকস চেহারা বেমানান।
তবে পুরুষ বলতে কামিনী এ দুজনকেই বোঝে। একজন তার ঘরের আরেকজন বাহিরের। কখনো কখনো মনের ভেতর আকসার ধুন্ধুমার লেগে গেলে মন খারাপ হয় বই কি! তখন তার করার কিছুই থাকে না। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হবার মতো তার তেমন কিছুই নেই। সারাদিন মোবাইল মোবাইল আর মোবাইল। এর বাইরে কোনো কোনো দিন খেতে যাওয়া কিংবা মার্কেটিং করার মধ্য দিয়ে নিজেকে সে ব্যস্ত রেখেছিল। বকুলের উপস্থিতি তাকে নিঃসঙ্গতার জাল থেকে মুক্ত করে। তারপরেও উদ্বিগ্ন রাত জানে কামিনীর ব্যাকুলতার কষ্ট। কামিনীর চোখমুখ, হাত-পা এমন কি প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই যেন কথা বলে। বকুল কি ক্লান্ত হয়ে পড়ে? কিংবা ঝামেলা মনে করে! এ ভাবনাও তার মাথায় জটিল রসায়নের মিশ্রণের মতো বুদবুদ তোলে।
কিন্তু যাই হবে হোক, বিষয়টি এমন বিস্ময়কর। বকুলকে আজ রাতে সে ঘুমুতেই দিতে চায় না। এমন অনেক রাতই সে বকুলকে নিয়ে জাগতে চায়। ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা চাঁদকে ধরে এনে যতক্ষণ বকুল কামিনীর মুখে ধরতে না পারে, ততক্ষণ সে রাগে অন্ধ হয়ে থাকে বই কি! এ ব্যাপারগুলো আগে থাকতেই বকুলের জানা ছিল বলে হয়তো কামিনীর ওপর তেমন কোনো চোটপাট দেখাতে পারে না সে। কামিনীর বিষয়গুলোর সঙ্গে যদি ভাব লাগাতে না পারত তবে কামিনীকে কিছুতেই বকুল ঘরে তুলতে পারত না। সে কথা এখনো কামিনী ভাবে। তবে বাসর ঘরের অমন একটা সুখকর ছবির কাছে সে এমন একটা কাণ্ড ঘটতে দেখে অনেক নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল। সে কথা আজও বকুলকে বলতে পারেনি কামিনী। কেন শিমুলের মাথায় এমন বুদ্ধি এসেছিল সে নিজেই জানে না। তবে পুরো ব্যাপারটাই তার কাছে একটা অতিপ্রাকৃত ব্যাপার বলে মনে হয়েছে। শিমুল কি এটা স্বীকার করবে যে, কামিনীর বিয়ের সময় সে এই শহরে উপস্থিত ছিল?

শিমুলের উপস্থিত থাকা না-থাকা বিষয়টি এমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু কোথায় যেন কামিনীর বাজে। কেন বাজে? তার উত্তর অনেক ভেবেও সে পায় না। মনের ভেতর একটা খচখচে ভাব নিয়ে সুখকর মুখ করে বেড়ানোও তার সহ্য হয় না। একটা অস্বস্তির ঢেউ বারবার তার মনকে ভেঙে চুরমার করে দিতে চায়। শিমুল একটা রহস্যের মতো হয়ে আছে তার কাছে। আবার মনে হচ্ছে শিমুল অন্যের হাতের ক্রীড়ানক। আসল ব্যাপারটা যে কী সেটাই সে বুঝতে পারছে না।
জীবন এমন জটিলতার আবর্তে এগিয়ে যাবে ভাবেনি সে। শিমুলের হুট করে আর দেখাই নেই। ভার্সিটির ডিগ্রি নিয়ে এভাবে লাপাত্তা হবে ভাবা যায় না। সকল জায়গায় খুঁজেছে। কেউ কোনো খবর দিতে পারে না। চেনা মোবাইল নম্বরটা কেমন বোবা হয়ে থাকে। তখন সেও অফিসে অফিসে ধর্না দেওয়া শুরু করেছে। চাকরির বিশেষ প্রয়োজন। না-হয় বাসা থেকে টিকতে দেবে না দুইদিনও। উঠ ছেরি তোর বিয়ে বলে যেকোনো পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতে পারে।
জীবন এখন কিছুটা থিতু হয়েছে। এখন আর নোটিশ ছাড়া ঘরের বাইরে সে দৌড়ায় না। বাবা মা সাধারণ নিয়মেই বিয়ের এন্তেজাম করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কামিনী এ বিষয়ে এখনো মুখ খোলেনি। কিন্তু বকুলেরও তর সইছে না। সে আগে ভাগে কব্জা করতে চায় কামিনীকে। আচ্ছা, বকুল কি ভয় পায়?  শিমুল ফিরে এলে টিকে থাকা তার জন্য দুষ্কর হবে! তার ভেতরেই তো কিন্তু আছে। বকুলের দোষ দিয়ে লাভ কী!
কেন ভয় পাবে? ওর কি নিজের ওপর আস্থা নেই! না এ ভয় আস্থার নয় এ ভয় জয়ের। কামিনীকাঞ্চনযোগে বকুল নিজেকে প্রীতিধন্য করার জন্য উঠে পরে লেগেছে। আর এদিকে কামিনীই বা আর কত ঠেকিয়ে রাখবে।
শিমুলের বাড়িতে আরেকবার খোঁজ নিলে হতো না! যদি কোনোদিন ফিরে আসে তাহলে আর বড়াই করতে পারত না। প্রতিদিন তো চাকরির খোঁজে বের হয়। একদিন না-হয় শিমুলের বাড়িতে চলে যাবে, কেন সে ঘাপটি মেরে আছে, সেটাই সে জানতে চায়। তবে নিজের মনের ওপর কামিনী একটু বিরক্ত! হাতের কাছে বকুল আছে, অথচ তার এখন শিমুলকে লাগবে। যদি বকুল না-থাকতো তাহলে কি বকুলের জন্যও মনটা এমন করত? বুঝতে পারে না সে। একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের ভেতর সে দুলতে থাকে। এর মানে কী? সে কি দুজনকেই চায়?
 

‘সুন্দরকে সাধনা করতে হয়। ভালোবাসা মানে শরীর নয়, সান্নিধ্য নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। মনের অদম্য টান। মনের ভেতরে মনের মানুষকে সারাক্ষণ স্পর্শ করে রাখা দূরে থেকেও কাছে থাকা, না ছুঁয়েও ছুঁয়ে আছি এমন কিছু বুঝতে হবে।’ কামিনীর কথাগুলো নিয়ে শিমুল আর বকুলের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। কেউ কাউকে অতিক্রম করতে পারে না। দুজনই সমান তালে কামিনীকে ছুঁয়ে থাকে। এই তো দেখা গেল কামিনী বকুলের বাইকে কোথাও যাচ্ছে ওড়না উড়িয়ে। একটু পর দেখা গেল শিমুলের নাটকের ডায়লগ শুনছে মনোযোগ দিয়ে। কেউ কেউ বলে বকুল-শিমুল দুজনেই কামিনীর অলংকার। তো অলংকারবিহীন কামিনীকে তো শূন্য শূন্য লাগবেই। দুজনকে নিয়ে একটানা চলে প্রতিদিনের দিনযাপন। কেউ কেউ আড়ালে আবডালে ঠাট্টা মশকরাও করেছিল। বলেছিল, কামিনীর দুজনকেই যখন লাগবে তাহরে সে একই সঙ্গে দুজনকেই বিয়ে করতে পারে। উড়াধুরা কথাটা কানে এসেছিল কামিনীর। তার মনকে যে কথাটা বিচলিত করেছিল তা সে ঘুণাক্ষরেও কারও সঙ্গে আলাপ করেনি। নিজেও সে কনফিউজড কী করবে সে? আসলেই যদি এমন একটা পরিস্থিতি উঠে আসে তাহলে সে কাকে বেছে নেবে? ভেবেছে সে অনেক। কোনোবার শিমুলের দিকে ভোট বেশি গিয়েছে আবার কোনোবার বকুলের দিকে। তবে একজনকে ছাড়া আরেকজনকে সে বেশিক্ষণ ভাবতে পারেনি। তার মনের এই দ্বিচারিতার জন্য নিজের ওপরেই সে বিরক্ত হয়েছে বারবার।

নিদারুণ ঝড়ের রাত্রি। কামিনী টের পাচ্ছে বকুলের কাঁপুনি। রাতের অন্ধকারে আফসোস বেড়ে ওঠে। রাঙামাটির লেক থেকে কিছুক্ষণ আগে ঘুরে এসেছে। হোটেলে পৌছানোর আগেই অন্ধকার নেমে এলো পথে। এরপর এলো ঝড়। কোনো রকমে হোটেলে পৌঁছল। তারপরেই কি একটা জানালার কার্নিশে একটা ছায়া দুলে উঠলো। শিমুল কি তবে পিছে পিছে রাঙামাটিও চলে এলো? নাকি তার চোখের ভুল? আস্তে আস্তে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল কামিনী। কিন্তু কোথাও কাউকে ওকে দেখা গেল না। মনটা কেমন উচাটন হয়ে গেল।
বকুলের বুকের ওপর গরম নিঃশ্বাস ফেলে রাঙামাটির রাত কাবার হলেও মনের সংশয় ঘোচে না। বকুলের আদরের সময় কেন বকুল, শিমুলে রূপান্তরিত হয়? সে কথা মাথায় ঢোকে না। হয়তো মনের বিভ্রম। কিন্তু এ নিয়ে বেশ কয়েকবার হলো। বিয়ের পর এমন ব্যাপার বকুল কি আদৌও মেনে নেবে, সেটিই সে মনে মনে চিন্তা করে। তাহলে বকুলের চেয়ে কি সে শিমুলকেই বেশি পছন্দ করে?
অবশেষে শিমুলকে পাওয়া গেল।
‘তোর লুকোচুরির নিকুচি করি। হারামি, বদমাশ, খাটাশ, অমানুষ।’ আরও যা মুখে এলো সবই উপহার পেল শিমুল। এসব পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনলো বকুল। শিমুল মুখটি পর্যন্ত খুলল না। সেই চিরাচরিত হাসি ঝুলিয়ে রাখল ঠোঁটের কোণে। কিন্তু তাতে করে কামিনীর দুই হাতের কিলঘুষি থেকে রেহাই পেল না। বকুলের সামনেই শিমুলের জামাটা ছিড়ে ফেলল নখের সাহায্যে। তার পরও শিমুল হাসছে। এ সময় যখন কামিনী থামল। তখন দেখল ছেঁড়া জামার অংশের ভেতর দিয়ে নখের তীক্ষ্ণ আঁচড় কেমন রক্তের রেখা ফুটিয়ে তুলেছে। তারপরও শিমুলের মুখে কোনো অনুযোগের চিহ্ন নেই।
কিন্তু কী কারণে শিমুল এমন উদাসীন কিংবা কামিনীর কাছে থেকে নিজেকে অন্তরীণ রেখেছে তার কারণ কামিনী কিছুতেই বের করতে পারল না।

কামিনীর ঘ্রাণ মৌ মৌ করছে। রাতের বাতাস গোত্তা খেয়ে জানালা গলে ঢুকে পড়ছে ঘরের ভেতর। বকুলের মনে হলো কামিনী দাঁড়িয়ে আছে। নিজে ঠিক আছে কিনা সংশয় জাগল। আলমিরা তো বন্ধ। তা ছাড়া টেবিলে বোতল দেখা যাচ্ছে না। তাহলে নেশা তো হয়নি! বকুল সন্দেহের দোলায় দুলছে। হুম কাউকে যেন দেখল সে। জানালা গলে আলোর বিচ্ছুরণে তার শাড়ির আঁচল উড়ছে। এতদিন পর সে কি ফিরে এসেছে? কেন, কিসের প্রয়োজন তার। কেন সে ফিরবে?
শিমুল কি তাকে সুখে রাখেনি?
কথাগুলো মনে হয় ওকে জিজ্ঞেস করা দরকার। বকুল উঠে আসে দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়। আকাশে ম্লান আলো। ঝির ঝির করে বাতাস বইছে। হিমেল বাতাসে অনেক কিছুই মনে পড়ছে। বকুল এসে কামিনী গাছটার কাছে দাঁড়াল। গাছের ফুলগুলো থেকে ঘ্রাণ ছিটকে আসছে। বাতাসে হালকা দুলছে গাছটা। তারপর সে ফিসফিস করে ডাকল। 
‘কামিনী, শুনতে পাচ্ছো?’
তারপরে কোনো শব্দ এলো কিনা বোঝা গেল না। বকুল মনে হয় কিছু একটা শুনেছে। সে বলতে শুরু করলো, ‘ঝামেলা করছো কেন? যেভাবে আছো সেভাবেই থাক। তোমার তো সুখের সংসার। শিমুলের বুকের ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে আছো। বেশি ঝামেলা করলে কিন্তু দুজনকে আলাদা করে দেব।’ কামিনীর কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। বকুল একটু হাসল। ম্লান আলোয় সে হাসি বোঝা গেল না। পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলো। কামিনী গাছটি দুলে উঠলো। মিষ্টি ঘ্রাণটা ছড়িয়ে পড়ল।


মহি মুহাম্মদ কথাসাহিত্যিক। তার গল্পগ্রন্থ :অহল্যাকথা, সুচেতনা ও হরিশ্চন্দ্রলাইন, কয়েকজন শেফালির গল্প। উপন্যাস : আড়াইপাতা। তিনি চট্টগ্রামে বসবাস করেন।

menu
menu