দেশান্তর : মা ও মাটির আখ্যান  

কবিদের গদ্য সরস হয়। কারণ একটাই। ওই যে শব্দের খেলোয়াড় তাঁরা । নির্মলেন্দু গুণ আমাদের অন্যতম কবি। তাঁর উপন্যাসিকা না নভেলা আছে আগে তা জানতাম না। অন্তর্জালে স্ক্রল করতে গিয়ে একদিন চোখ পড়লো ঢাকার খ্যাতনামা প্রকাশনা অনার্য'র পেইজে দেশান্তর নামক এই টেক্সটে। সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহ প্রকাশ করে মন্তব্য করলাম সেখানে। প্রকাশক আমাদের বড়ভাই শফিকুর রহমান। উল্লেখ্য আমার অনুবাদে রুমির কবিতা প্রকাশ করেছেন অনার্য (সলজ্জ আত্মপ্রচার)। শফিক ভাই কুরিয়ারে বইটা পাঠালেন। পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পড়া শুরু করলাম। ছোট একটা  বই। সর্বমোট আশি পৃষ্ঠার এই উপন্যাসিকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দেশ ভাগের পর দেশান্তরি হতে বাধ্য হওয়া মানুষের দুঃখের কথা ফুটে উঠেছেন গুণ কবির সাবলীল উপস্থাপনায়। 

উপন্যাসের শুরুটা হয় অবিভক্ত বাংলার প্রেক্ষাপটে। মণীন্দ্র স্মৃতি হাতড়ে বের করেন তাঁদের গ্রামে প্রথম এন্ট্রান্স পাস দিয়েছিলেন রামসুন্দর বাবু।  ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করতেন ভদ্রলোক । কেতাদুরস্ত বিলেতি জীবনযাপন করা এই ভদ্রলোক এলাকায় একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সেকালে ময়মনসিংহ জেলার কোনো গ্রামে সবচেয়ে সুন্দর বাড়িটা ছিল তাঁর।  ওপরওয়ালা চাকুরে ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেট মি. গ্রাহাম তাঁর এই বাসায় এলে সেখানে মণীন্দ্র তাঁর বাবার সঙ্গে দেখা করতে যায়। সাদা চামড়ার ভদ্রলোকের দেখা বা সাক্ষাৎ মেলা তখন স্থানীয় জনগণের জন্য বিরল সুযোগ। মণীন্দ্রের বাবাকে ব্রিটিশ ভদ্রলোক পরামর্শ দিয়েছিলেন ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করে দিতে। ভদ্রলোক চেষ্টার কমতি রাখেনঞ্জ। কিন্তু মণীন্দ্রের কপালে পড়ালেখা ছিল না। ছেলেকে পড়ালেখা করাতে না পারার দুঃখে অল্প বয়সে পটল তুলেন তাঁর বাবা। 

ব্রিটিশ ভদ্রলোকের সঙ্গে মোলাকাত করার রেশ অনেকদিন ছিল মণীন্দ্রের বাবার। সাদ চামড়া মানে উঁচু লেভেলের মানুষ। এদের কথাবার্তা মানা এবং পালন করা বাঙালি চাকুরে সমাজের জন্য অত্যাবশ্যক এরকম একটা নিয়ম তখন চালু ছিল। যাহোক, মণীন্দ্রের বাবা মোটামুটি সহায় সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন। অমল-কমল দুই ছেলের বড়টার পড়ালেখা হয়নি৷ ছোটটা কিছুটা বাবুয়ানা ঢঙে পড়ালেখা চালিয়ে যাবার ভান করে যাচ্ছিল। দুই ছেলের চেয়ে ছোট মেয়ে মনসাকে বেশি ভালোবাসতেন মণীন্দ্র। কারণ সে ছিল তীক্ষ্ম ও সংবেদনশীল। 

এই মনসা-ই পরবর্তী সময়ে উপন্যাসের মূলে চলে আসে তাঁর ইস্পাত কঠিন প্রতিজ্ঞার জন্য। আদরের মনসাকে বাবা একদিন ঢাকডোল পিটিয়ে, জমি বিক্রি করে, তিনশো মানুষ খাইয়ে বিয়ে দেন অনিল ধরের ছেলে হিমাংশুর সঙ্গে। পাত্র শিক্ষিত। স্কুলে পড়ায়। মনসা শিক্ষিত না হলেও রূপে, গুণে, আক্কেলে সে কম ছিল না। তাইতো তার শ্বশুর প্রথম দেখায় পছন্দ করেছিলেন। এবং মণীন্দ্রকে অনেকটা চাপাচাপি করে বিয়েতে রাজি করান।

মণীন্দ্র ঘরে অনেকটা ডেস্পটিক হলেও আশেপাশের দশজনের নিকট তাঁর একটা খ্যাতি ছিল। সম্মানের জায়গা ছিল। কারণ দেশের প্রতি, মাটির প্রতি তাঁর অগাধ প্রেম। পাকিস্তান জন্মের পরপর এলাকার প্রায় সব হিন্দু চেইঞ্জের মাধ্যমে ভারত চলে গেলেও তিনি রাজি হননি। তাঁর আপন চাচা তাঁকে চলে যাওয়ার জন্য জোর করলে মণীন্দ্র জবাব দিয়েছিলেন, 'আমি প্রয়োজনে মুসলমানের সাথে একঘরে থাকব৷ তবুও মাটি ছাড়ব না।' তাঁর এই গুণ পেয়েছে মনসা। 

মনসার বিয়ের একমাসের মাথায় তার কপাল পুড়ে। শ্বশুর তাকে নিয়ে ভারতে চলে যেতে চান। মণীন্দ্র এর বিরোধীতা করলে মফস্বলের সালিশ বসে। তাতে মনসার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জবাবের কাছে তার শ্বশুর হেরে যান। হিমাংশু, মনসার জামাই, বাবার সাথে ভারত চলে যায়। অথচ মনসাকে সে কথা দিয়েছিল সে প্রিয়তমা স্ত্রীকে ছেড়ে যাবে না৷ মনসার কাছে ভারত যাওয়া মানে একটা আতঙ্ক মনে হতো সবসময়। দেশ মাটি ছেড়ে ভারত চলে যাওয়াটা তার কাছে 'মৃত্যুর মতো ভয়ংকর' একটা ব্যাপার ছিল  বাপভক্ত হিমাংশুকে উপন্যাসিক সংজ্ঞায়িত করেছেন 'সত্য ভ্রষ্ট হিমাংশু' হিসেবে।

দেশভাগের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসে দেশভাগের কবলে পড়া মানুষের অস্তিত্বের সংকট,  তাঁদের মাঝে বিরাজমান অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা এবং সর্বোপরি উপয়ান্তর বা বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়া মানুষের বেদনার কথা উঠে এসেছে।  সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো মনসা ও মণীন্দ্রের—বাবা-মেয়ের অন্যরকম দেশপ্রেম ও ত্যাগের কথা পড়ে পাঠক নতুন করে ভাববেন দেশ,মাটি ও মাতৃকার কথা। দেশান্তর পড়তে বড়জোর দুই ঘণ্টা সময় ব্যয় হবে পাঠকের। জানা হবে শেকড়ের কাছাকাছি কিছু কথা। 


আলমগীর মোহাম্মদ, অনুবাদক, কুমিল্লা

menu
menu