কাঁটা কম্পাসের মানচিত্র

বলুন তো আমাকে কেমন লাগছে? অবগুণ্ঠন খোলা বন্ধুর সুন্দরী স্ত্রী সামনে বসে চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে কামরুল জাহানকে।
কামরুল কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শম্পা পারুলের দিকে। ধাঁধাটা কিসের—মেলোনোর চেষ্টা করছে মনে মনে। কেন শম্পা ভাবী স্খলিত বসনে মুখোমুখি বসে এমন আন্তরিক আক্রমণ করছে? কোনো পরিকল্পিত ফাঁদ? কিন্তু কি লাভ? আমি তো ছা পোষা মানুষ। কারো সাতেই নেই, প্যাঁচেও নেই। সেই আমাকে কেন বানানো হবে গুটি?
কামরুল জাহানের ভাবনার মধ্যে আরও এগিয়ে এসে একটা হাত তুলে নেয় নিজের হাতে শম্পা ভাবী—মুখে কথা নেই কেন? আমাকে ভালো লাগছে না?
ভাবী! বিচলিতবোধ করে কামরুল, ঠিক বুঝতে পারছি না। কেন আমার সঙ্গে আপনি এমন করছেন?
হাসে শম্পা, ভালো লাগে তাই! কামরুলের হাত ছেড়ে দিয়ে দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরতে যায় শম্পা পারুল, চট করে নিজেকে সরিয়ে নেয় কামরুল। এবং দ্রুত দৌড়ে বেডরুম পার হয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকে দরজা খুলতে যায়। অবাক ঘটনা, দরজা বাইরে থেকে তালা দেয়া। মুহূর্তে ব্লটিং পেপারে শুষে নেয়ার মতো শরীরের সব রক্ত কে যেন ওর শরীর থেকে শুষে নেয়। রক্ত শূন্যতার উদোম মাঠে দাঁড়িয়ে থাকার মতো দাঁড়ায় কামরুল জাহান বন্ধু সহকর্মী আহমেদ আমজাদের বাসায়। শরীর ঘামতে শুরু করেছে, আমজাদ বাইরে থেকে বাসা তালা দিয়েছে কেন? 
কি হলো! দরজা খুলছে না? 
পিছনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে শম্পা ভাবী। চোখে মুখে আমন্ত্রিত মিছরি কাটার হাসি, আপনার বন্ধু বাইরে যাবার সময়ে তালা লাগিয়ে গেছে। জানতো, আপনি দরজা খুলে পালিয়ে যেতে পারেন। কিন্ত আমরা তো সেই সুযোগ আপনাকে দিতে পারি না! 
মানে?
এগিয়ে  আসে খুব কাছে, কামরুল জাহানের শরীর ঘেষে দাঁড়ায় শম্পা, খেলাচ্ছলে তুলে নেয় একটা হাত নিজের হাতে, চলুন।
কোথায়?
কোথায় আবার? আমার বেডরুমে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আপনার সঙ্গে আমার নিবিড় গভীর একটা ঘটনা ঘটবে এখন। না, আপনার কোনো ক্ষতি হোক চাই না। কিন্তু কথা দিচ্ছি চরম সুখ পাবেন।
আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না ভাবী?
শম্পা তাকায় আয়তো গভীর দৃষ্টিতে, আপনি পুরুষ না? পুরুষের চির আকাঙ্ক্ষা নারী পরের স্ত্রী। আমিও পরের স্ত্রী। আমি জানি, দেখতে শুনতে ভালোই। আমাকে দেখে আপনার লোভ জাগে না?
আমি আপনাদের কি ক্ষতি করেছি?  কেনো আমাকে বাসার মধ্যে আটকে রেখে গেলো আমজাদ?
যা করেছি পরিকল্পনা করেই করেছি। বলেছিতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সুখ পাবেন, অনেক সুখ—ভেতরে চলুন, টানছে  শম্পা পারুল। 
কামরুল জাহান বুঝতে পারে, কিচ্ছু করার নেই। আটকা পড়েছে চক্রান্ত ফাঁদে। ফাঁদ থেকে বের হওয়ার জন্য আপতত বাধ্য হয়ে থাকবো... নিজের মনে সিদ্ধান্ত নেয় কামরুল জাহান। এবং শম্পার সঙ্গে আবার বেডরুমে ফিরে যায়। খাটের উপর দুজনে মুখোমুখি বসে। শম্পার শরীরে ব্লাউজ আর পেটিকোট। বুকের নিচ থেকে শরীরের অনেকখানি প্রকাশ পাচ্ছে তীক্ষ্ণ তরবারির স্রোতে। ব্লাউজের বাঁধন ছিঁড়ে বের হয়ে আসতে চাইছে স্তন জোড়া। আটোসাটো নিকানো শরীর শম্পার। রঙ লাল ফরসা। মাথায় বিশাল খোপা করা চুল। চোখ দুটো ভীষণ কাজল কালো।
কামরুলের বুকের লম্বা চুলের ওপর হাত বোলায় শম্পা, মনে হয় অনেক দিনের পরিচিত প্রিয় পুরুষ। কিন্তু অজানা ভয়ে, আতংকে কাঁপছে কামরুল। কান পেতে আছে, কখন শুনবে দরজা খোলার শব্দ। আমজাদ পরিচিত লোক নয়তো পুলিশ নিয়ে ঢুকবে। পরের পরিস্থিতি ভাবতেই পারে না কামরুল, কি হবে দুটো বাচ্চা ছেলের? আর ওদের মা নির্মলার? নির্মলা ভয়ানক সহজ সরল মেয়ে। জীবনের জটিলতার জ ও বোঝে না, যখন শুনবে আমি পুলিশের হাতে ধরা পড়েছি কলিগের স্ত্রীর সঙ্গে… নির্ঘাত আত্মহত্যা করবে ছেলে দুটোকে নিয়ে। 
গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কামরুল জাহানের। কেন আহমেদ আমজাদের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে বাসায় বেড়াতে এলাম? কেন? কেন? আর হারামজাদা ঘরের মধ্যে বৌয়ের কাছে রেখে গেছে পুলিশ ডাকতে? তোর টাকার দরকার? আমাকে বললেই হতো, যা আছে সব দিয়ে দিতাম। বন্ধু, সহকর্মী—এক অফিসে প্রায় দশ বছরের মতো চাকরি করছি। পারিবারিকভাবে আসা যাওয়া আছে দুই পরিবারের মধ্যে। আর তুই কি না হায়েনার মতো আমার জীবন আর সংসারটাকে চিবিয়ে খেতে চাচ্ছিস? গোপন ক্রোধে শরীরের মধ্যে ঝড় ওঠে। 
কামরুল ভাই! আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন। আমার দিকে তাকান, দেখেন আমাকে, উপভোগ করতে করতে আমাদের পরিকল্পনা শুনুন, ধীর লয়ে কটাক্ষের ছুরিতে শান দিতে দিতে বলে শম্পা পারুল। 
আমজাদ পুলিশ নিয়ে কখন আসবে?
পুলিশ আসবে কেনো? অবাক শম্পা পারুল।
আমাকে বাসায় আটকে রেখে আমজাদ পুলিশ ডাকতে গেল না? 
কামরুল জাহানকে প্রায় জড়িয়ে ধরে শম্পা পারুল, পুরুষ এতো বোকা হয়? শুনুন, আপনার দুটি ছেলে সন্তান না?
মাথা নাড়ায় কামরুল জাহান, হ্যাঁ।
আর একটা সন্তান আমাদের দেবেন, তাই আপনাকে ডেকেছি।
আমি কীভাবে একটা সন্তান আপনাকে দেবো?
যেভাবে আপনি আপনার স্ত্রীকে দিয়েছেন, সব পুরুষ যেভাবে দেয় নারীর সোনার শরীরে…
কামরুল জাহান নির্বাক নির্বোধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, মনে হয় দূরাগতভাবে কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে শম্পা পারুল আর আহমেদ আমজাদের পরিকল্পনা। কিন্ত বাস্তব? সম্ভব? করোটির ভেতরে আবারও জেগে ওঠে পুলিশের হাতের হাতকড়া! 
শুনুন ভাই, আপনার বন্ধু আর আমি গত বছর ইন্ডিয়া গিয়েছলাম, আপনি জানেন! জানেন না?
জানি, মাথা নাড়ায় কামরুল।
কেন গিয়েছিলাম জানেন? আমাদের বিয়ের বয়স নয় বছর। কিন্তু কোনো বাচ্চা হচ্ছে না। এই দেশের ডাক্তার ওঝা করিবাজ বৈদ্য সব দেখানো হয়েছে। আমার ডাক্তারি রিপোর্টে কোনো ঝামেলা নেই কিন্ত আমজাদের সমস্যা। দেশের ডাক্তারদের ওপর ভরসা না পেয়ে ইন্ডিয়া যাই দুজনে গত বছর। যাওয়ার পর ব্যাঙ্গালোরের এই বিষয়ে সবচেয়ে বড় ডাক্তার দেশাই ভট্টাচার্যকে দেখাই। সব রির্পোট দেখে জানিয়ে দেয়, আমজাদের বীজে সন্তান জন্মানোর উপাদান স্পার্ম নেই বললেই চলে। ফলে আমাদের কখনো সন্তানের মুখ দেখা হবে না। দেশে আসার পর এক পীরের খবর পেয়ে গিয়েছিলাম সেখানে। কিন্ত যাওয়ার পর বুঝতে পারলাম রাতের অন্ধকারে আমার গর্ভে কেউ বীজ দিয়ে যাবে। আমি  চলে এলাম। এবং আমজাদকে বোঝালাম—অন্ধকারে অচেনা পুরুষের বীজ কেন নেবো? সংসার টেকানোর জন্য যদি অন্যের স্পার্ম নিতেই হয়, পরিচিতজনের  কারোর নেয়াই ভালো।  বুঝতে পারছি, আপনি অস্বস্তিবোধ করছেন কিন্তু আমার সামনে কোনো বিকল্প নেই। কারণ, আমি আপনার বন্ধু আমজাদকে ভীষণ ভালোবাসি। ইউনিভারসিটিতে পড়ার সময়েই দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি। ওর এই একটা অসুবিধা ছাড়া একজন অসাধারণ মানুষ। চাইলে ওকে ছেড়ে আমি অন্যকারো সঙ্গে যেতে পারি কিন্ত ও যাবে কোথায়? অনেক ভেবে চিন্তে দুজনে মিলে দিনের দিন পরামর্শ করে সিদ্ধান্তে এসেছি..
অবাক শুনছে কামরুল জাহান মানুষের জীবনের দহন রাত্রির গান। গান লেখে মানুষ, সুর করে মানুষ, গায়ও মানুষ কিন্ত সব গানের কী এমন তিমির হনন দহন থাকে? সামনে বসা বুভুক্ষ নারীর গান কেউ কী লিখতে পারবে কখনো? শুনতে শুনতে নিজের ভেতরটাই ক্ষয়ে যাচ্ছে কামরুলের। আহমেদ আমজাদ সব সময়ে হাসিখুশি প্রাণবন্ত মানুষ। অথচ ভেতরে ভেতরে কী অসহ্য যন্ত্রণায় পুড়তে পুড়তে বেঁচে আছে!
শুরুতে রাজি হয়নি আমজাদ, এমন কে আছে?
আমি বললাম, খোঁজো। এমন কাউকে খুঁজবে যে বিশ্বস্ত। পরোপোকারী। অনেক শোনে বাছ বিছার করে আমজাদই বলল আপনার নাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো, আমিও আপনাকে খুঁজছিলাম। কারণ, আপনার ঔরসে দুটি পুত্র সন্তান। দেখতেও চমৎকার। দুজনে—আমি আর আমজাদ বিষয়টা নিয়ে অনেক অনেক ভেবেছি, পরিকল্পনা করেছি, আদৌ এই কাজটা করা ঠিক হবে? যদি না হয় আমাদের কোনো উত্তরাধিকারী থাকবে না দুনিয়ায়। যেদিন মরে যাবো বলার কেউ থাকবে না—আমার মা শম্পা পারুল! কিন্ত আমার ভীষণ মা হতে ইচ্ছে করছে। আমি রাস্তায় রাস্তায় হাঁটি,  শপিংমলে যাই, পার্কে গিয়ে বসে থাকি—শিশুদের দেখার জন্য।  
সন্তান পেটে আসার পর আর আপনাকে বিরক্ত করব না। কোনো সম্পর্ক রাখব না আপনার সঙ্গে। আমি চাইব না, আমার সংসারের জন্য আপনার সংসারের কোনো সমস্যা হোক। ভাবী বাচ্চাদের নিয়ে আপনি আপনার স্বাভাবিক জীবনে থাকবেন। আমি বা আমজাদ আপনাকে ফোনও দেব না। আমার পেটে ভ্রূণ আসার পর আমরা এই শহর ছেড়ে চলে যাব। এইটুকু করতে পারবেন না? 
শম্পা পারুলের চোখে পানি। গলা অনেকটা ভারী। বিহ্বল কামরুল জাহান বিমূঢ়। গল্প অনেক পড়েছে জীবনে, পড়তে ভালোবাসে গল্প উপন্যাস। কিন্ত নিজেই একদিন গল্পের বা উপন্যাসের অলৌকিক চরিত্র হবে, ভাবেনি। অথচ ভয়াল সর্বনাশের একটি চরিত্রের মর্মাথ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গোপন সুরঙ্গের গোপন দৃশ্যপট কামনায়। বুঝতে পারছে, এই জন্যই মাস দুয়েক ধরে বলছে আমজাদ, এ্যাই তোকে শম্পা বাসায় যেতে বলেছে।
কেন? 
আমি জানি না। আমাকে বলেছে খবরটা পৌঁছে দিতে, দিলাম।
আরে মাস খানেক আগে না  সপরিবারে তোর বাসায় গেলাম। সারাদিন আড্ডা দিলাম, ভাবীর হাতের হরেক রকম রান্না খেলাম। আবার কেন?
সেটা শম্পা জানে। আর এখন তো তোকে যেতে বলেছে, বাসার সবাইকে নিয়ে না।
আরও অবাক কামরুল জাহান, আমি একা গিয়ে কী করব?
সেটা আমি জানি না, আমাকে বলেছে তোকে দাওয়াত দিতে দিলাম। এখন যাওয়া না যাওয়া তোর...।
অফিস কলিগ বন্ধু আহমেদ আমজাদের স্ত্রী শম্পা পারুলের গানের গলাও ভালো। রেডিও টিভিতে গায় না, পারিবারিক অনুষ্ঠানে গেয়ে থাকেন। বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করতে করতে অফিসের কাজের চাপে ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিল কামরুল জাহান। আবার মনে করিয়ে দেয় আমজাদ, কিরে তোর ভাবীর কাছে আমাকে ছোট না করলেই নয়?
মানে?
শম্পা তোকে না যেতে বলেছে। চলে আয় আগামী পরশুর বন্ধের দিনে।
দেখি।
দেখি না, আয়। তোর জন্য বাজার করে রাখব।
হাসে কামরুল, আমার জন্য বাজার?
নয় কেন? তুই তোর ভাবীর স্পেশাল মানুষ, বাজার করবো না! 
রাতে খাবার সময় স্ত্রী নির্মলা নীরুকে বলে কামরুল, কী করি বলো তো!
বলার কী আছে? নিশ্চয়ই ভাবীর কোনো প্ল্যান আছে, যাও। শোনে আসো।
তুমি বলছ?
না বলার কি আছে! মানুষটা খুবই ভালো। যাও।
বৌয়ের সমর্থন পেয়ে পরের ছুটির দিনে সকালে কলাবাগানের বাসায় হাজির কামরুল জাহান। ড্রয়িংরুমে বসতে না বসতেই হাত ধরে আমজাদ, এখানে না। চল ভেতরের ঘরে যাই।
বিস্মিত কামরুল, এখানেই বসি। ভাবী কই?
তোর ভাবী রান্না ঘরে। চল ভেতরের রুমে যাই। আরে ব্যাটা তুই তো ভেতরের মানুষ, ড্রয়িংরুমে তোমাকে মানায়? চল—জোর করে টেনে বেডরুমে নিয়ে ঢোকে আমজাদ। সুন্দর পরিপাটি সাজানো রুম। রুচির ছাপ ঠিকরে পরে চারদিকে। বিছানার উপর দু’বন্ধু মুখোমুখি বসতে না বসতেই ঢোকে শম্পা পারুল, শেষ পর্যন্ত এলেন?
কি যে বলেন না ভাবী! আপনি নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন, না এসে পারি?
এলেন তো অনেক সাধনার পর... শম্পা পারুলের কথায় শম্পাসহ তিনজনে হাসে। শম্পা তাকায় স্বামী আমজাদের দিকে, তোমাকে বাজারে যেতে হবে কিন্তু।
দ্রুত বসা থেকে দাঁড়ায় আমজাদ, যাচ্ছি।
বাজার কেন আবার? বিস্মিত কামরুল জাহান। আমাকে দাওয়াত দিয়ে বললি বাজার করে রেখেছিস। 
হাসে আমজাদ, সবই কিনেছি তোর ভাবীর আদেশ অনুসারে কিন্তু একটা জরুরি কেনা বাদ রয়েছে, তুই বসে শম্পার সঙ্গে গল্প কর, আমি যাবো আর আসব, সব মিলিয়ে দশ পনেরো মিনিট। 
রুমে দুজনকে রেখে চট করে বের হয়ে যায় আহমেদ আমজাদ।
দুপুরে খুব যত্ন করে খাওয়ায় শম্পা পারুল। খাওয়ার পর বেডরুমে ঘুমিয়ে যায়। পাশে শম্পা পারুল। প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে চোখ মেলে তাকায় কামরুল জাহান। সুন্দর কমনীয় বিম্বিত মুখ পারুলের। ঘুমন্ত মুখ আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে চোখের তারায়। তাকিয়েই থাকে কামরুল, স্নিগ্ধ মখমলের কবোষ্ণ ঠোঁট...। আঙুল ছোঁয়ায় কামরুল, চোখ মেলে তাকায় শম্পা। মৃদু হেসে জড়িয়ে ধরে ওকে, জড়িয়ে ধরে কামরুলও। বিকেলে বারান্দায় চা পান করে দুজনে। অসম্ভব অলৌকিক দিন কাটে কামরুল জাহানের। চায়ে চুমুক দিয়ে বাইরে তাকায়, বারান্দার বাইরে একটা দীর্ঘ চালতা গাছ। চালতা গাছের লম্বা সবুজ পাতার ফাঁকে একটা টুনটুনি উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায় আর চিরিক চিরিক ডাকে। ভিন্ন শরীরের স্বাদ এতো ভয়ংকর মধুর, জানত না কামরুল। চায়ের কাপে চুমুকের সঙ্গে সঙ্গে পাশে বসা শম্পা পারুলের শরীরের গন্ধ, রূপ, মাধুর্য পানের পর এই মুহূর্তগুলোকে মনে হয় রাজকীয়, স্বপ্নের, মেঘের দেশ থেকে উড়ে আসা ঘটনাবলীর দৃশ্যকল্পনা।
রাজা বাদশারা এমন ধরনের সুখ কখনো পেয়েছে? আমি কামরুল জাহান কি একজন সম্রাট? শম্পা পারুলের বাসার বারান্দায় বসে কোনোভাবে নিজেকে নিজের মধ্যে রাখতে পারছে না কামরুল। সুখের অলৌকিক সৌরভে হাজার হাজার পাখির ডানায় উড়ে বেড়াতে ইচ্ছে করছে। 
কী ভাবছেন?
নিজের ভেতর থেকে ফিরে তাকায় পাশে বসা শম্পা পারুলের দিকে। হাসে দুজনে, হাত বাড়ায় কামরুল। চেয়ারসহ এগিয়ে আসে শম্পা। জড়িয়ে ধরে ওকে, যখনই সময় পাবেন চলে আসবেন। আমি প্রস্তুত থাকব আপনার জন্য। সত্যি বলতে কী, আপনি মহাপুরুষ।
সত্যি! মুখে গর্বিত হাসি কামরুল জাহানের। 
সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় ফেরে আমজাদ। প্রস্তত হয়েই ছিল কামরুল জাহান। দুজনে মুখোমুখি, পাশে দাঁড়িয়ে শম্পা পারুল। দুজন দুজনকে এড়িয়ে যেতে চায় কিন্ত সম্ভব হয় না। সময় এবং ঘটনার পরম্পরায় একজন নারীর গর্ভ কেন্দ্র করে দাঁড়িয়ে দুই পুরুষ। দুজনকে দেখে একজন নারী শম্পা পারুল।
এতো দেরি করছে যে! নির্ভার প্রশ্ন শম্পা পারুলের।
দুজনকে পাথর চাপা সময়ের বলয় থেকে বিযুক্ত করে শম্পা। কামরুল জাহান তাকায় বন্ধু ও কলিগের মুখের ওপর। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে জবাব দেয় আমজাদ, একটা কাজে আটকা পড়েছিলাম। তাকায় কামরুলের দিকে, কিরে যাচ্ছিস?
হ্যাঁ, যাচ্ছি...। 
দরজা পার হয়ে বের হয়ে যায় কামরুল জাহান। খোলা দরজা বন্ধ করে শম্পা পারুল। ফিরে তাকায় দরজা বন্ধ করে, অপেক্ষায় নেই আহমেদ আমজাদ। সামনের রুম পার হয়ে বেডরুমে ঢোকে শম্পা, নেই আমজাদ। বাথরুমেও নেই। বারান্দায়ও পায় না। পিছনের ছোট্ট রুম, যেখানে একটা খাট আর পড়ার টেবিল, সংসারের টুকিটাকি রাখা—সেই রুমে খাটের উপর শুয়েছে আমজাদ।
তুমি এখানে? 
কপালের উপর ডান হাতটা তুলে চোখ ঢাকে আমজাদ, সারাটা দিন রাস্তায় রাস্তায় হেঁটেছি। খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু বিশ্রাম নিই।
পাশে বসে বুকের উপর হাত রাখে শম্পা, আমি জানি তোমার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কি করতে পারি? সব আয়োজন তো তুমিই করেছ। আমি আমাকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছি। এখন তো আর ফিরে আসা যাবে না। আমজাদের কপালের উপর থেকে ওর হাতটা সরিয়ে দেয় শম্পা, তাকাও আমার দিকে।
উল্টো দিকে শরীরের মোড় নেয় আমজাদ, তুমি যাও। তোমার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না। যাও তুমি...।
যায় না শম্পা পারুল। কামরুলের শরীরের উপর থেকে হাতটা বিযুক্ত করে বসে থাকে খাটের উপর। অনুভব করে—নিজেকে! আমি কে? কেন  আমি ডুবে গেলাম কামরুলের করতলে? সামনে কি কেনো দুর্যোগ বা সর্বনাশের বিউগল বাজছে? একটা সন্তানের জন্য এতসব না-ও করলে পারতাম। কেন করলাম? কিন্তু শরীরের সুখ তো আমাকে নিমজ্জিত করছে। কী করব আমি? আমি কি বারবণিতা হয়ে যাচ্ছি? আমি কি মাতৃত্বের মুখোশে শরীর মন্থনের স্রোতে ভেসে যাচ্ছি? না, আমি পারব না... নিজের ভেতরে নিজেকে আবিষ্কারের চেষ্টা করে শম্পা পারুল, আমি কামরুলকে না করে দেব।
কিন্ত জীবনের গতি ও গল্প বিচিত্র বেলুনের বিবিধ ধারায় এগিয়ে চলে। 
কামরুল জাহান পেয়েছে শরীরের গন্ধ তুমুল জলের মধুর স্বাদ, বন্ধুর স্ত্রী—নিজেকে সম্রাটের প্রতিচ্ছায় প্রতিস্থাপন করে। পরের দিন, অফিস থেকে চলে আসে বন্ধু কলিগ আহমেদ আমজাদের বাসায়, লাঞ্চের আগে আগে। কলিং বেল বাজালে রান্নাঘর থেকে এসে দরজা খোলে শম্পা। সামনে অপেক্ষায় কামরুল জাহান। হাতে দামি হোটেলের লাঞ্চ প্যাকেট। বিস্মিত হতে হতে নিজেকে সামলে নেয় শম্পা পারুল, আমিই তো আসতে বলেছিলাম, নিষেধ তো করিনি।
কামরুল ভেতরে ঢুকেই জড়িয়ে ধরে শম্পাকে, তুমি আমাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গেছ। খুন হতে এসেছি তোমার কাছে।
অফিসে দুই কলিগের মধ্যে আগের মতো দেখা হয় না। গল্প হয় না। আড্ডা হয় না। দুজনের চোখাচুখিও হয় না। মনে হয়, কেউ কাউকে চেনে না। আমজাদ বেশিরভাগ সময় বাসায় থাকে না। ফেরে অনেক রাতে। সুযোগের সন্ধানে কামরুল জাহান লোভী কুকুরের লালায় নিজেকে নিবেদন করে শম্পা পারুলের শরীরে। শম্পা পারুল নিজেকে হারায় মাতৃত্বের আড়ালে শরীরের নতুন দিগন্ত রচনার রসনায়। 
তিন মাস পরে শম্পার শরীরে মাতৃত্বের চিহ্ন দেখা দেয়। সফল একটা যাত্রা সম্পন্ন করে দুজনে—কামরুল জাহান আর শম্পা পারুল। দুজনার  সংসারে একজন তৃতীয় এসেছে আমন্ত্রিত ভ্রমর। ভ্রমরের গুঞ্জনে নিজের ঘরে প্রথমজন হয়ে যায় দূরের পরিব্রাজক। চতুর্থজনের আগমনে তৃতীয় আর দ্বিতীয় এতটাই ঘনিষ্ঠ যে, প্রথমজন নিজের সংসারে পরিত্যক্ত ঠোঙ্গার মতো পড়ে থাকে এখানে সেখানে, অন্ধ কুঠরিতে। প্রায় প্রতিদিন আসে কামরুল জাহান নিজের সন্তানের তথ্য তালাশ নেয়ার প্রয়োজনে শম্পা পারুল আর আহমেদ আমজাদের সংসারে। দুজনে মেতে ওঠে খুনসুটিতে। ছোট্ট রুমটার মধ্যে গুটিয়ে যায় আহমেদ আমজাদ নিজের বাসায়। সারা দিনে একবার খবরও নেয়ার সময় হয় না শম্পা পারুলের প্রিয় স্বামীর। 
ব্যস্ত শম্পা আসছে সন্তান আর সন্তানের পিতার ব্যাৎসল্যের বাহুডোরে।


মনি হায়দার কথাসাহিত্যিক। ১৯৮৬ সালে অধুনালুপ্ত দৈনিক ‘বাংলার বাণী’র ‘শাপলা কুঁড়ি’র পাতায় ‘চোর’ গল্প দিয়ে যাত্রা শুরু। লিখছেন গল্প, উপন্যাস, নাটক। প্রকাশিত বই সত্তুরেরও অধিক। পুরস্কার : অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরষ্কার : ২০১০, ২০১৮। এম, নূরুল কাদের শিশু সাহিত্য পুরস্কার : ২০১২। শ্রীপুর সাহিত্য পরিষদ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০১৯। বগুড়া লেখক চক্র কথাসাহিত্য পুরষ্কার ২০২১। তিনি বাংলা একাডেমিতে কর্মরত।  

menu
menu