বঙ্গবন্ধুর রাজনীতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিকতা : উপাদানসমূহ

(“সময়ের কাছে সাক্ষ্য দিয়ে চলে যেতে হয়”। এটাই ক্ষণিক পৃথিবীর নিয়ম। মানুষ বাঁচতে চায় হাজার বছর কিংবা তারও অধিক। রক্ত মাংস শত বর্ষেই ক্ষয়ে যায়। কিন্তু মানুষের মাঝে হাজার বছর কেন? অনন্ত কাল বেঁচে থাকা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনই এক নাম যিনি বাংলাদেশের সমার্থক। প্রদীপ যেরকম আলো বিলিয়ে আলোকিত করে জনপথ। তিনি প্রাণের আলোয় জাগিয়েছেন বাঙালির হৃদয়। তার ডাকেই বাঙালি হাসি মুখে বিলিয়ে দেয় প্রাণ। ৯ মাস যুদ্ধের পর বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করে। মুজিববর্ষে ঘুংঘুর-এর শ্রদ্ধাঞ্জলি মেহেদী হাসানের প্রবন্ধটি ৩ পর্বে প্রকাশিত হবে। আজ প্রকাশিত হলো ১ম পর্ব)

এক.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-৭৫) রাজনৈতিক উত্থান পূর্ব-বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিকতা থেকে। এ প্রান্তিকতা প্রধানত কৃষক চৈতন্য থেকে উৎসারিত। বাংলার অর্থনীতি তখন ছিলো প্রধানত কৃষি-প্রধান। এর নিয়ন্ত্রণ ছিলো জমিদার-মহাজনের ওপর, আর উৎপাদক কৃষক-প্রজা। সে সময়ের এ অঞ্চলের  কৃষি-অর্থনীতির ক্ষমতা-কাঠামোর পরিচয় তুলে ধরতে হারুন-অর-রশিদ বলছেন [হারুন (২০২০, ১)] : ‘জমিদার-মহাজন বা শাসক শ্রেণির অধিকাংশ ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বি। আর কৃষক-প্রজা বা শাসিত-শোষিত শ্রেণির সিংহভাগ ছিল মুসলমান।’  এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ-রাজের শাসন-শোষণ। এ ক্ষমতাকাঠামোর স্বরূপ ধরা পড়েছে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে (২০১২)। আমাদের বর্তমান আলোচনার প্রধান অবলম্বন বা উৎস হবে এ মূল্যবান গ্রন্থটি। এ গ্রন্থের শুরুর দিকে পূর্ব-বাংলার একটি অবস্থাপন্ন গ্রামীণ পরিবারের নিঃস্বকরণের যে ছবি মেলে তার ভেতর থেকে তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতার সৃষ্টি। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে গড়ে ওঠা এই নিঃস্বকরণের প্রক্রিয়া তাঁকে সচেতন করেছে, ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার বিষয়ে। তাঁর  পরিবারটির পূর্ব-পুরুষদের অবস্থাপন্ন জীবন থেকে ছিটকে পড়া যে পরিণতি,  সেটাই পূর্ব-বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি সমাজের প্রবঞ্চনা বিষয়ে তাঁকে অনুভূতিপ্রবণ করে তুলেছে।  তিনি জন্মেছিলেন এই কৃষি-প্রধান অঞ্চলের গ্রামীণ সমাজে। পিতা শহরে চাকরি করলেও সন্তানদের নিয়ে তাঁর মা গ্রামে থাকতেন। তাঁর পরিবারের গ্রাম-কেন্দ্রিকতা কতটা মাটি-সংলগ্ন ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুনের একটি উক্তিতে। বঙ্গবন্ধু বলছেন [শেখ মুজিবুর (২০১৪ , ৮)] : ‘আমার মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। তিনি কোনোদিন আমার আব্বার সাথে শহরে থাকতেন না। তিনি সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন আর বলতেন, “আমার আব্বা আমাকে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন যাতে আমি তাঁর বাড়িতে থাকি। শহরে চলে গেলে ঘরে আলো জ্বলবে না, বাবা অভিশাপ দেবে”।’ এ চেতনা একান্ত গ্রামীণ। এ চেতনা তিনি পরিবার থেকে পেয়েছেন। প্রধানত ছোটবেলায় মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন। 

ব্রিটিশ-রাজের বিদায়ের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপরই ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিবুর রহমান ও নঈমউদ্দিন আহমদ প্রচারিত “পূর্ব-পাকিস্তানের দুর্ভাগা জনসাধারণ’ শিরোনামের লিফলেটে  বলা হয়েছে [Ahmed (2016, 28)], পূর্ব-পাকিস্তানের কৃষিজীবীরা ঔপনিবেশিক আইন-আদালতের প্যাচে পড়ে রাস্তার ভিক্ষুকে পরিণত হয়ে চলেছে। তাঁরা জানতে চেয়েছেন [Ahmed (2016, 53)], সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের ‘ধান বাজেয়াপ্ত’ করার কারণ এবং অতিরিক্ত ধান উৎপাদকদের ধানের যে দাম প্রস্তাব করা হয়েছে তার যৌক্তিকতা সম্পর্কে।  একই লিফলেটে তাঁরা পাকিস্তানি কর্তৃত্ববাদী আমলাতন্ত্রকে ‘ব্রিটিশ-সৃষ্ট দালাল’ বলে অভিহিত করে দাবী করেন যে, [Ahmed (2016, 225)] এই মাথাভারী প্রশাসনকে ছাঁটাই করতে হবে, অপ্রয়োজনীয় বিভাগীয় কমিশনার, যুগ্ম-সচিব, উপ-সচিব এবং প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্টারি সেক্রেটারিদের পার্শ্বচরদের পদগুলো অবলুপ্ত করে সরাসরি জনতার  সঙ্গে সরকারের সচিবদের সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। এ লিফলেট যখন তিনি প্রচার করেন তখন তাঁর বয়স ২৮ বছর। এ সময়েই তিনি পুর্ব-বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের সংকট সম্পর্কে কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে পাকিস্তানি-ঔপনিবেশিককালের শুরুর দিকে ( ১৯৪৮-৪৯) একটি স্মৃতিচারণ আছে এমন [শেখ মুজিবুর (২০১৪, ১০৪)]  : 

দাওয়ালরা যখন ধান কাটতে যায়, তখন সরকার কোনো বাধা দিল না। যখন তারা দুই মাস পর্যন্ত ধান কেটে তাদের ভাগ নৌকায় তুলে রওয়ানা করল বাড়ির দিকে তাদের বুভুক্ষ মা-বোন, স্ত্রী ও সন্তানদের খাওয়াবার জন্য, যারা পথ চেয়ে আছে, আর কোনো মতে ধার করে সংসার চালাচ্ছে—কখন তাদের, স্বামী, ভাই, বাবা ফিরে আসবে ধান নিয়ে, পেট ভরে কিছুদিন ভাত খাবে, এই আশায়—তখন নৌকায় রওয়ানা করার সাথে সাথে তাদের পথরোধ করা হল। ‘ধান নিতে পারবে না, সরকারের হুকুম’, ধান জমা দিয়ে যেতে হবে, নতুবা নৌকাসমেত আটক ও বাজেয়াপ্ত করা হবে। … এ খবর পেয়ে আমার পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব হল না। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করলাম। … এই লোকগুলি দিনমজুর। দুই মাস পর্যন্ত যে শ্রম দিল, তার মজুরি তাদের মিলল না। আর মহাজনদের কাছ থেকে যে টাকা ধার করে এনেছিল এই দুই মাসের খরচের জন্য, খালি হাতে ফিরে যাওয়ার পরে দেনার দায়ে ভিটে মাটিও ছাড়তে হল। 

এ ঘটনাগুলো তাঁর রাজনীতির এদিকটাই নির্দেশ করে যে, তাঁর মনোজগতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র জনতারই অধিষ্ঠান। ওপরের ঘটনা থেকে আমরা দুটো সংবাদ পাচ্ছি, ব্রিটিশ-রাজের বিদায়ের মধ্য দিয়ে আমরা যে পাকিস্তান পেলাম সে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণি কত দ্রুত পূর্ব-বাংলার সাধারণ কৃষকদের মন থেকে উঠে যাচ্ছিলো। আর এই কতৃত্ববাদী রাজশক্তির বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান কত দ্রুত জন-আকাঙ্ক্ষার কাছে নিজেকে সমর্পণ করছেন। তাঁর সহানুভূতি এবং মনোযোগ পাচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রান্তিকতা। আহমেদ কামাল এ সময়ের পূর্ব-বাংলার আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন [Ahmed (2016, 167-203) ,পাকিস্তান সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে প্রান্তিক মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো। এভাবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে মুসলিম লীগ তার জনপ্রিয়তা হারায়। (চলবে)


  ড. মো. মেহেদী হাসান, অধ্যাপক এবং প্রাবন্ধিক, কোটবাড়ি, কুমিল্লা

menu
menu