ধারাবাহিক উপন্যাস সোলেমন (৬ কিস্তি)

মহদং যা বলতে চায় সে বিষয়ে সোলেমনের জানার আগ্রহ থাকলেও এমন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলা আখেরে ওর জন্য বিপদজ্জনক হতে পারে। সোলেমন নীরব থাকাই যুক্তিসঙ্গত মনে করে।        

পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে জন্ম গ্রহণকারী যে কোনো ব্যক্তি জন্মসূত্রে সে দেশের নাগরিক হয়। আমেরিকা ইউরোপেও একই আইন। জন্ম নেয়া ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হয় না যে, ওর পিতামাতা সে দেশের নাগরিক। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই নাগরিকত্ব আইনের বিধান যে, কয়েক বছর বসবাস করলে আর নাগরিক হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে আবেদন করলে সে দেশের নাগরিক হতে পারে। কিন্তু রোহিঙ্গারা হাজার বছর ধরে এখানে বসবাস করলেও নাগরিকত্ব পায় না। রাষ্ট্র ১৯৪৮ থেকে কৌশলে তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। মায়নমারের ১৩৪টি নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তার স্বীকৃতি দিলেও রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে আসছে। 

মহদং বলে, কতযুগ আগে থেকে এদেশে মুসলমান বসবাস করছে তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না।

রোহিঙ্গা জাতিসত্তার অস্বীকৃতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সোলেমন জানে। তবু সে চুপচাপ বসে আছে। ওর চোখ বাইরে। সে জানে, দশম শতকেই এদেশে মুসলমানদের আগমনের অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেই আরব বণিকরা যে রেঙ্গুন হয়ে চীন পর্যন্ত বাণিজ্যতরী নিয়ে যাতায়াত করত সে সাক্ষ্যও ইতিহাসে আছে। বার্মিজরা ১৭৮৪ সালে আরাকান দখলের সময় রাজার হয়ে মুসলমান সৈন্যরা যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছে। রাখাইনদের সঙ্গে পেলে আরাকানের স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখা যেত বলে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন। আর আরাকানকে হারানোর সন্দেহের অবকাশ থেকেই শাসন ক্ষমতা পাওয়ার পরই বার্মিজরা ইংরেজদের তৈরি ধর্মীয় দ্বিজাতি—নীতি ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ গ্রহণ করেছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের বার্মার সঙ্গে থাকতে রাজি করাতে তেমন সমস্যা হয়নি। রোহিঙ্গাদেরও তখন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছিল বলে কথিত আছে। আর এতে ফলাফল যা হবার তাই হয়েছিল, রোহিঙ্গারা সেটা মেনে নিতে চায় নি। কোথাও কোথাও দাঙ্গাও লেগে গেল। সেনাবাহিনী দিয়ে দাঙ্গা দমন করার অজুহাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকেই দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হলো। এর পর রোহিঙ্গারা বহিরাগত বাঙালি এটা প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এর পর থেকে কোনো একটা অছিলায় রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করা রেওয়াজে পরিণত হলো। কোনো একটা অজুহাতে বারবার রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয়া হয়েছে। জানবাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, সেখান থেকে ফিরে গ্রামে এলে অত্যাচার করেছে, কাউকে কাউকে ধরে জেলে পুরেছে। বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে। টিকতে না আবার কেউ কেউ বাংলামুল্লুকে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। যারা বনেজঙ্গলে আশ্রয় নেয় তাদের বিদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করে তালিকাভুক্ত করা হয়। গ্রাম ছেড়ে গেলে প্রতিবারই তাদের ঘরবাড়ি সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছে অথবা সেখানে মগদের বসতি গড়ে উঠেছে। ফিরে এসে রোহিঙ্গা পরিবারগুলো আর তাদের জমিজমা এমনকি বসতবাড়ি ফিরে পায় নি। তাদের আবার ওকাডাকে টাকা দিয়ে বসতবাড়ির জন্য জায়গা আর অনবাদী জমিতে আবাদ করার অনুমতি নিতে হয়েছে। কবছর পর আবার তাদের নতুন বসতি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কখনো কোথাও তাদের স্থায়ী হতে দেয়া হয়নি। এমনটা কেন করা হচ্ছে তারা হয়তো জানে না। কিন্তু সোলেমন আন্দাজ করতে পারে।                           

আমরা পুরোনো বসতি এলাকা দিয়ে যাচ্ছি। ভাবলাম, পুরোনো বসতির সঙ্গে তোমার কিছুটা পরিচয় করিয়ে দিই। কিছু মুসলমান এখানে বাস করে। যা কিছু আগের বসতি আছে, রোহিঙ্গা বলো মুসলিম বলো, সে এখানে তার কিছু চিহ্ন তুমি দেখতে পাবে। অবশ্য ঘরবাড়ি আগের থাকলেও সে মানুষ হয়তো নেই, মুসলিমদের হটিয়ে দিয়ে মূল বার্মার জনগোষ্ঠী বামার জাতি এসে দখল করেছে। এই এলাকার বাইরে নতুন নতুন বহুতল ভবন যা দেখতে পাবে সবই সম্প্রতি সেনাবাহিনীর লোকজন গড়ে তুলেছে।

—সেনাবাহিনী আবাসিক ভবন নির্মাণ করে না কি? 
—কোন ব্যবসাটা তারা না করে?  
—তুমি অতকিছু কী করে জান?

মহদং এবার চুপ করে যায়। হয়তো সচেতন হয়েও যায়। একজন বিদেশির কাছে দেশের শাসকদের সম্পর্কে কতটুকু বলা যায় সে কথাও ভাবে। 

আমার গাড়িতে যারা চড়ে তারাই এসব বলাবলি করে। আমি আর কী জানি!

সোলেমন ভাবে, মহদং যা বলছে আসলে তা সাধারণ মানুষেরই অভিমত। ওর গাড়িতে তো সমাজের নানান পেশা আর মতাদর্শের লোকজনই চড়ে। তারা নিজেদের মধ্যে কতরকম কথাই তো বলে থাকতে পারে। আর একটা গাড়িতে বসে নিজেদের মধ্যে ভাববিনিময় করা কম ঝুঁকিপূর্ণ। মহদং-এর অভিজ্ঞতা আসলে চলতিপথেরই অভিজ্ঞতা।   

—এসব ভবনে কারা বসবাস করে? 
—যাদের পয়সা আছে তারা থাকে। কেউ ভাড়ায় কেউ বা নিজের বাড়িতে থাকে। ওসব না দেখলে তুমি ভাবতে পারতে না সিতোয়ে কতখানি বদলে গেছে।
—পৃথিবীর সকল শহরই কালের পরিবর্তনে বদলে যায়। শহরের সঙ্গে সঙ্গে শহরের মানুষও বদলায়। 
—পৃথিবীর অন্যান্য শহরের মানুষও বদলেছে! প্যারিস কিংবা লন্ডনে আগে যেমন ছিল এখনও কি সেরকম আছে? 
—তুমি বুঝতে পারছ না আমি কী বলতে চাইছি।  
—কী বলতে চাইছ?  
—যারা এখন এখানে বাস করছে তারা আরাকানের কেউ নয়। বার্মার অন্য কোন রাজ্য থেকে এসেছে।  

সোলেমন জানে, ইউরোপ আমেরিকার শহরগুলোতে আদি অধিবাসীরা থাকতে পারেনি, অভিবাসীদের দ্বারা উচ্ছদ হয়ে গেছে। কোনো একটা শহর যখন আধুনিক হয়ে উঠে তখন আর সে শহরের আগের লোকগুলো কাচা পয়সাওয়ালা নতুন বসতিস্থাপনকারীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারে না।

—আমি বলতে চেয়েছি, এ শহরে আগে যারা বাস করত তারা বসবাস করছে না।     

এ শহরের ইতিহাস সোলেমন জানে। কী করে আকিয়াব প্রাচ্যের একটি অন্যতম বন্দর হয়ে উঠেছিল সে জানে। তবু সে মনে মনে ভাবে, এখনকার আরাকানের হাল-হকিকত সম্পর্কে সে আর কতটা জানে? সোলেমন ভাবে, মহদং কি আরো কিছু বলতে চায়? সে ওকে থামিয়ে দিতে চায় না। ওর কাছে এখনকার আরাকান সম্পর্কে কিছুটা ধারণা হয়তো পাওয়া যাবে। 

এটা তো অস্বাভাবিক নয়, পৃথিবীর সব শহরেই এমনটা ঘটে।
আমাদের দেশটাকে দখল করে নিয়েও ওদের সাধ মেটেনি।  
বুঝতে পারলেও সোলেমন মন্তব্য করল না। কিন্তু মহদং যেন ওর মনের কথা শোনাবার মতো কাউকে পেয়েছে। সে থামবে না।  
—তুমি কখনো ভাবতে পার, কোন এলাকার বাসিন্দাদের বাড়িঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের জমিজমা সব কেড়ে নেবে? 
সোলেমন ভাবছে মহদং যখন বলতে চাইছে বলুক। এদেশে এমন কথা কাকে সে শোনাবে?     
—কারা কেড়ে নিয়েছে? 
—মগ ছাড়া আর কে? 
একজন সাধারণ মানুষ রেডিঙ্গাদের দুর্দশাকে কীভাবে বর্ণনা করে সেটা জানাও জরুরি। সোলেমন সরল মানুষের মতো মহদং-এর সঙ্গে কথা বলতে থাকে।   
—কাদের তাড়িয়ে দিয়েছে বাড়িঘর থেকে?

কাদের আবার! এখানে যাদের বসতি ছিল তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে। সেই সব মুসলিম আজ আর এখানে নেই। তুমি তো জান না এখানে একসময় মুসলমান ছাড়া আর কেউ বাস করত না। বাস করবে কি, এদেশের মানুষ কি সভ্য ছিল? তারা তো সব বনজঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। পশু শিকার করে কাচা মাংস খেত। শিকার করতে না পারলে বনের ফলমুল খেত। মাটির তলের আলু, কচুঘেঁচু এসব তুলে খেত। তারা তো ধান চাষ করতেও জানত না। আর যাদের জমি আছে, ঘরবাড়ি আছে তারা কেন সে সব ফেলে রেখে এখানে এসে বসবাস করবে? যাদের এখানে এনে, ঘরবাড়ি বানিয়ে দিচ্ছে, জমি দিচ্ছে তারা চাষ করতে পারত না বলে তারাও তো মুসলমানদের দিয়েই জমি চাষ করাত। ঐ জমিও তো মুসলমানরাই চাষের উপযোগী করেছিল। বলতে গেলে এ দেশটাকে তো মুসলমানরাই সভ্য করেছিল। স্বাধীন আরাকানের রাজারা তো মুসলমানদের সহযোগিতা নিয়েই রাজ্য শাসন করত। আর সেটাই আরাকানের মুসলমানদের আজকের দুর্দশার কারণ।

মহদং-এর কথা শুনতে শুনতে সোলেমন অতীতের কথা ভাবতে থাকে। বার্মিজরা আরাকান দখলেরর সময় এখানকার অধিবাসীরা অসভ্য ছিল তা সত্য নয়। ভারতীয় সভ্যতার আলো এখানে আগেই এখানে এসে পৌঁছেছিল। সমৃদ্ধ বৈশালী রাজ্যের কথা সকলেই জানত। আর মধ্যযুগের আরাকানের সভ্যতার বিকাশে মুসলমানদেরও অবদান আছে। স্বাধীন আরাকানে রাজ্য শাসন করতে রাজাদের মুসলমান আমাত্যগণ সহায়তা করতেন বলে বার্মিজ শাসকরা মুসলমানদের ওপর জুলুম করছে তা নয়। সে জানে, ১৭৮৪ সালে বোধপায়া আরাকান দখল করতে এলে আরাকান রাজের যে সৈন্যরা তাঁর বিরুদ্ধে জীবনপণ লড়াই করেছিল তাদের অধিকসংখ্যকই ছিল মুসলিম, যারা ছিল রাজা নরমিখলার রাজ্য উদ্ধারকারী সৈন্যদের উত্তরসূরী। ইতিহাস সাক্ষী, নরমিখলা মুঘল সম্রাটের প্রেরিত মুসলিম সৈন্যদের দ্বারা হারানো রাজ্য উদ্ধার করেছিলেন। রাজা সেসব সৈন্য আর দেশে ফেরত পাঠান নি। পুনর্বার বার্মিজ আগ্রাসনের আশঙ্কা ছিল তাঁর। তিনি রাজ্য উদ্ধারে সহায়তাকারী সৈন্যদের রাজধানী ম্রোহং-এর পাহারার জন্য রেখে দিয়েছিলেন। তাদের জন্য ভূমি বন্দোবস্ত আর বাড়িঘর করার অনুমতিসহ আরাকানি নারী বিয়ে করে সংসার করারও অনুমতি দিয়েছিলেন। এসব সৈন্য রাজা আর রাজ্যের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকায় রাজার দেয়া তাদের জমি চাষ রার জন্য কৃষি শ্রমিকের দরকার ছিল। সে শ্রমিক আসত বাংলামুলক থেকে। শ্রমিক তো আর পরিবার নিয়ে আসে নি। তাদের কেউ কেউ আরাকানে এসে বিয়ে করে সংসারি হয়েছে। আর সংসার ফেলে রেখে অনেকেই নিজদেশে ফিরে যায় নি। এ দেশটাকে আপন করে নিয়ে এখানকার সমাজের মানুষ হয়ে এখানকার সংস্কৃতি ধারণ করে বংশপরম্পরায় এদেশে বসবাস করে আসছে। তাদের উত্তরসূরিগণ সকলেই তো আর সৈনিকের পেশা গ্রহণ করে নি, নানান কর্ম ও নানান পেশা গ্রহণ করেছে। ভিনদেশ থেকে এলেও এসব বহিরাগত মানুষকে আরাকানের আদিবাসীরা আপন করেই নিয়েছিল, তারা তো জানত বিপদের সময় রাজাকে সাহায্য করতেই তারা এসেছিল। এমনকি আরাকান দখল করে নিলে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, তার বিরুদ্ধে যারা রুখে দাড়িয়েছিল, যে সৈন্যরা প্রাণ দিয়েছিল, তাদের বেশিরভাগই ছিল মুসলিম। বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী রাখাইনরাও তখন প্রাণ বাঁচাতে বাংলামুলুকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের বেশিরভাগই আরাকানে আর ফিরে আসেনি। বাঙালিরা তাদের তাড়িয়ে দেয়নি, তাড়িয়ে দেবার কথা কখনো ভাবেনি। বাঙালি উদার জাতি একথা সোলেমনের চাইতে কে আর বেশি জানে? নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় সে যা জেনেছে অনুভব করেছে ইতিহাস পড়ে সেটা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। যদি সেদিন সেই উদার মানুষটা কাদাজল থেকে ওকে টেনে না তুলতেন, নিজ বাড়িতে আশ্রয় না দিতেন, তাহলে কী যে হতো ওর! নাফ নদীর কাদাজলে ডুবে মরত না কি? সোলেমনের মনে হয়, মুঘল বাহিনীর সৈন্যরা আরাকানকে যেমন রক্ষা করেছিল তেমনি সেদিন টেকনাফের হাকিম সাহেব ওকে রক্ষা করেছিলেন।


ধারাবাহিক উপন্যাস সোলেমন (৫ কিস্তি)

menu
menu