সাবাস বাংলাদেশ

এই সংখ্যাটি প্রকাশ হওয়ার সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব চলছে। যেকোনো দেশের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এমন একটা মাইলফলকে দাঁড়িয়ে পঞ্চাশ বছরের অর্জনকে মূল্যায়ন করার তাগিদ থাকে। স্বভাবতই এই নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে চারপাশে, তথ্য উপাত্ত উঠে আসছে দেশের ও বিদেশের নানা সূত্র থেকে। অনেকেই এই অর্জনকে বিস্ময়কর বলে আখ্যায়িত করছেন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারে উপমহাদেশে তো বটেই, বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের প্রথম দশটি দ্রুত বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির একটি, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের সবচেয়ে অগ্রগামী। ১৯৭৫ সালে যখন বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় ঢোকে, তখন আমাদের দারিদ্রতার হার ছিল ৮৩%। ১৯১৯ সালে আমাদের দারিদ্রতার হার ২০.৫%। উন্নয়নশীল বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের তালিকায়, বলা হচ্ছে উন্নয়নের এই হার অব্যাহত থাকলে ২০৩১ সালের ভেতরে আমরা উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করব, আর ২০৪১ সালের দিকে উন্নত দেশের তালিকায় নাম উঠতে পারে। শুধু অর্থনীতিতে নয়, অবকাঠামোগত উন্নয়নেও আমাদের অগ্রগতি যথেষ্ট সম্মানজনক। আমাদের প্রতিটি গ্রাম সড়ক যোগাযোগের আওতায়, প্রতিটি গ্রামে অন্তত একটি স্কুল আছে, প্রতিটি থানায় হাসপাতাল আছে, ৮০% গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ আছে। বাংলাদেশে ৫ কোটি লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, ১৭ কোটি মোবাইল ফোন লাইন, আর ৪.৫ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী (২০২০ সালের হিসাব)। তৃতীয় বিশ্বের নিরিখে এই উপাত্তগুলো অনেকের দৃষ্টি কেড়েছে।

অর্থনীতির তথ্য উপাত্তের ঘোরপাকে না ঢুকে সাদামাটা ভাষায় বলা চলে স্বাধীনতার ঊষালগ্নে আমাদের অর্থনীতি ছিল পুরোপুরি আমদানি নির্ভর, বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর। তখন অন্ন বস্ত্র থেকে শুরু করে সুঁইসুতা পর্যন্ত আমদানি করতে হতো। পরবর্তীকালে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে নানাবিধ লাগসই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলশ্রুতিতে দেশের কৃষি এবং মৎস্য খাতের চমকপ্রদ অগ্রগতি মাছে-ভাতে বাঙালির খাদ্য ঘাটতি মিটিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এনে দিয়েছে। অর্থাৎ এই খাতে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়েছে বিপুল পরিমাণে। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রার আয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নানা কারণে আমাদের পাটশিল্প, তৎকালীন প্রধান রফতানিযোগ্য পণ্য, সত্যিকার অর্থেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু এর স্থলে দেশের জায়মান অর্থনীতিতে নতুন নতুন শিল্পের আবির্ভাব ঘটে, যার একটি হচ্ছে পোশাক শিল্প। বস্তুত এই একটি শিল্পখাত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একটি সম্মানজনক পর্যায়ে উন্নীত করে। বস্ত্রশিল্পে বাংলার অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একে একটি চমকপ্রদ প্রত্যাবর্তন হিসাবেই গণ্য করা যেতে পারে। 

পোশাক শিল্পের পাশাপাশি পরবর্তীকালে ওষুধ, তথ্য প্রযুক্তি ও চামড়া শিল্পের মতো আরও অনেক নতুন শিল্পখাত রফতানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় এসে যোগ হয়। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সোপানে এই সব খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু ভারি শিল্পখাতে আমাদের অবস্থান এখনো শৈশবে। ভারি শিল্পের জন্য প্রয়োজন হয় বড় পুঁজি এবং কারিগরি দক্ষতার। এই দুই বিবেচনায়, অনেকের মতো আমারও মনে হয় বাংলাদেশে এখন বৃহৎ শিল্প গড়ে ওঠার অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক ফোরামে ইদানীং বাংলাদেশের জাহাজ শিল্প নিয়ে কথা হচ্ছে। এই খাতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশ অতি সম্প্রতি, কিন্তু ইতোমধ্যেই আমাদের রফতানি শিল্পখাতে এর অবস্থান দ্বিতীয়। 

এক হিসাবে বলা হয় বিশ্বব্যাপী জাহাজ শিল্পের বাজার প্রায় ১৬০০ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অপ্রতুল। বর্তমানে বিশ্ববাজারের মূল সরবরাহকারী চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের জাহাজ নির্মাণ কোম্পানিগুলো আগামী দশ বছরের জন্য অগ্রিম চুক্তিবদ্ধ। এই তিনটি দেশ মূলত অতি বড় জাহাজ (৫০ হাজার টনের ঊর্ধ্বে) নির্মাণের দিকে মনোযোগী, এবং ছোট ও মাঝারি জাহাজে এদের আগ্রহ কম। অন্যদিকে বাংলাদেশের উৎপাদন এখন ছোট ও মাঝারি আকারের জাহাজে (১০ থেকে ১৫ হাজার টন), যদিও বলা হচ্ছে প্রযুক্তিগত দিক থেকে আমরা ২৫ হাজার টন পর্যন্ত নির্মাণে সক্ষম। ছোট ও মাঝারি সমুদ্রগামী জাহাজের বাজার প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার, এর ১-২% যদি বাংলাদেশের হাতে আসে তাহলে রফতানি হবে প্রায় ৪-৮ বিলিয়ন ডলার। জাহাজ-ভাঙা খাতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানে। ২০১৮ সালে জাহাজ নির্মাণ খাতে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ০.৮৪%, কাজেই অনেকের মতে ১-২%, এমনকি ৫% অংশীদারিত্বের লক্ষ্যমাত্রা মোটেও অযৌক্তিক কিছু হবে না, কারণ উৎপাদন সক্ষমতা ও বাজার বিশ্লেষণে বাংলাদেশের অবস্থান এখন যথেষ্ট অনুকূলে।

যে বস্ত্রশিল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে একটি সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছে এবং যে জাহাজ শিল্পের হাত ধরে ভারি শিল্পখাতে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে—এ দুটো খাতেই বাংলার ইতিহাস অত্যন্ত উজ্জ্বল। দুর্ভাগ্যবশত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের আওতায় আমাদের এই দুইটি খাতকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়। কালের পরিক্রমায় আবার এর পুনর্জীবন ঘটছে এবং এই পুনরুজ্জীবিত গৌরবকে সুসংহত করার দায়িত্ব এখন স্বাধীন বাংলাদেশের।  

বাংলার ঐশ্বর্যের কথা একসময় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিল প্রবাদের মতো। গ্রিক-রোমান নাবিকদের লগ বই থেকে প্রাপ্ত তথ্যে ইরিত্রিয়া ও মিসরের বন্দরগুলোতে আরব ও গ্রিক সওদাগরদের সঙ্গে বাংলার সওদাগরদের বাণিজ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। মুঘল আমলে বাংলার পণ্য রফতানি হতো বিশ্বব্যাপী। মার্কো পোলো’র লেখা থেকে জানি বস্ত্র শিল্পে বাংলার অবস্থানের কথা, তৎকালে বাংলার মসলিন কাপড়ের জন্য মুখিয়ে থাকত সারা দুনিয়ার ব্যবসায়ীরা। নথিপত্র ঘাটলে দেখা যায় একসময় পুরো এশিয়া থেকে ওলন্দাজদের আমদানির ৪০% ভাগই আসত বাংলা থেকে। ভারত থেকে ইংল্যান্ডে আমদানির ৭০% ভাগ আসত বাংলা থেকে।

অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বাংলায় মুঘল শাসন দুর্বল হতে শুরু করলে বাংলার নবাবরাই প্রকৃত শাসক হিসাবে আবির্ভূত হন। ওই সময়টা ছিল বাংলার স্বর্ণযুগ। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এ্যাঙ্গোস মেডিসনের মতে ১৭০০ সালে ভারতের অর্থনীতি ছিল সারা বিশ্বের অর্থনীতির ২৪.৪%, একই সময় ব্রিটিশ অর্থনীতি ছিল বিশ্ব অর্থনীতির ২.৯%। অর্থনীতির ইতিহাসবিদ প্রসন্ন পার্থসারথীর মতে অষ্টাদশ শতাব্দীতে তাবৎ ইউরোপের ভেতর প্রকৃত আয় আর জীবনযাত্রার মানের সূচকে সবচেয়ে উপরে ছিল ইংল্যান্ড। হিসাবে দেখা যায় ওই সময় পূর্ব ভারতের বাংলা এবং দক্ষিণ ভারতের মহিশূরের আয় ও জীবন যাত্রার মানের সূচক ছিল ইংল্যান্ডের সমান। ভারতের রফতানি খাতে বস্ত্রশিল্প ছিল শীর্ষে এবং তুলনামূলক মূল্যমানে তৎকালীন বাংলার বস্ত্র শিল্পের কর্মীদের আয় ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকদের চেয়ে বেশি ছিল। ঢাকার মসলিনের কথা আমরা অনেকেই জানি, যার খ্যাতি কিংবদন্তির মতো। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সারা বিশ্বের বস্ত্রশিল্পে বাংলার অবদানের কথা আমরা অনেকেই মনে করি না এখন। আজকাল বিভিন্ন গবেষণায় উঠে আসছে চমকপ্রদ তথ্য। জানা যায় খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকেই রোমে ভারতীয় মসলিনের ব্যবহার ছিল। জে জে এ কেমপুস-এর বইতে পাই, ‘একসময় ঢাকার মসলিন সাতগাঁও থেকে জাহাজে চড়ে রোমান নারীদের গায়ের ভূষণ হতো...’। ১৫১৭ সালে পর্তুগিজরা প্রথমবারের মতো বাংলায় পদার্পণ করার পর কালক্রমে চট্টগ্রাম ও সাতগাঁওয়ে কুঠি স্থাপন করে। এরও প্রায় একশো বছর পরে একইভাবে আগমন ঘটে ডাচ ও ব্রিটিশদের। এইসব ভাগ্যান্বেষী বাণিজ্য লোভীদের কারণেই পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের বস্ত্র আর মসলার বাণিজ্য লোভনীয় হয়ে ওঠে ইউরোপের উপনিবেশবাদী দেশগুলোর কাছে। বস্তুত সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ব্রিটেনে বস্ত্রশিল্পের তেমন পসার ঘটেনি, বেশভূষায় কাপড়ের চাকচিক্য তেমন ছিল না। ভারতীয় উন্নত কাপড় ও পোশাকের আমদানি এর পরিবর্তন ঘটায়। উচ্চবিত্তদের গায়ে দামি ও রুচিকর ভারতীয় কাপড় কিংবা টেবিলে চীনা পরসেলিন শোভা পেতে শুরু করে মর্যাদার প্রতীক হিসেবে। আমদানিকৃত ভারতীয় সিল্ক, মসলিন, কেলিকো—রাতারাতিই লন্ডনের ফ্যাশন পরিবর্তন করে দেয়। ১৬৬৪ সালের এক হিসাবে উল্লেখ করা হয় প্রায় আড়াই লক্ষ পিস ভারতীয় কাপড় আমদানি করা হয় ইংল্যান্ডে, যার বেশিরভাগই ছিল বাংলার চালান। তখনকার পত্রিকাগুলোতেও এ নিয়ে লেখালেখি হতো। ১৭০৮ সালের ৩১শে জানুয়ারি উইকলি রিভিউ  পত্রিকার একটা লেখায় পাওয়া যায়, ‘ভারতীয় কাপড় আমাদের বাড়িতে ঢুকে গেছে, আলমিরায়, শোয়ার ঘরে; পর্দায়, কুশনে, চেয়ারে, বিছানায়...’।

পর্তুগিজদের আগমনের অনেক আগে মার্কো পোলো, ইবনে বতুতা এবং বিভিন্ন চীনা পরিব্রাজকদের বর্ণনাতে বাংলার মসলিন আর বস্ত্রশিল্পের গৌরবগাঁথার কথা উঠে এসেছে। ব্রহ্মপুত্রের কূল ঘেঁষে ময়মনসিংহ থেকে বরিশাল পর্যন্ত বিস্তৃত একটা ছোট এলাকায় উৎপন্ন হতো বিশেষ ধরনের তুলা, যার সুতা দিয়েই ঢাকার আশেপাশের ৮০ হাজার তাঁতে তৈরি করা হতো জগৎ বিখ্যাত মসলিন। বিশেষ তুলার মসলিন ছাড়াও সাধারণ তুলার মাধ্যমে উৎপন্ন ঢাকাই কাপড়ও ছিল উন্নত মানের। বিপুল চাহিদার এই বস্ত্র শিল্পকে ঘিরে ঢাকা হয়ে ওঠে সারা ভারতের অন্যতম বিপণন কেন্দ্র। ইউরোপ ও এশিয়ার দূর দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা আসত এখানে, ঢাকাকে তখন বলা হতো প্রাচ্যের ভেনিস। শায়েস্তা খাঁর আমলে শহরটি ছিল নব্বই বর্গমাইলের মতো, অধিবাসী ছিল প্রায় দশ লক্ষ। ওই সময়ে লন্ডন শহরের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ছয় লক্ষ। বস্ত্র ছাড়াও নগরীর আশেপাশে ছিল জাহাজ নির্মাণের কারখানা। জাহাজে জাহাজে ঢাকার কাপড় পৌঁছে যেত অটোমান ও পারস্যের রাজধানীতে, পৌঁছে যেত রোমান রাজধানীতে। পরে পর্তুগিজ এবং ওলান্দাজদের আগমনের পর এই রফতানি বিস্তৃত হয় ইউরোপের অন্যান্য শহরে। আরও পরে ইংরেজদের আগমনের পর মূল রফতানি শুরু হয় ইংল্যান্ডে।

সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে বিশ্বের বস্ত্র বাজারের ২৫% যোগান দিত ভারত, এর ভেতরে সুবে বাংলাই ছিল প্রধান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথিপত্র থেকে দেখা যায় কোম্পানির বাণিজ্যের প্রথম দিকে ভারত থেকে আমদানির প্রায় ৭০% ছিল বাংলার বস্ত্র। তখন ইংল্যান্ডের অধিবাসীদের পোশাক ছিল মূলত চামড়া অথবা পশমের তৈরি। অন্যদিকে ভারতীয় পোশাক ছিল হালকা বস্ত্র। ইংল্যান্ডের বাজারে, বিশেষত গ্রীষ্মকালীন পরিধেয় হিসেবে এর জনপ্রিয়তা এতো বৃদ্ধি পায় যে ১৭০০ সালে আইন করে ভারত, পারস্য ও চীন থেকে ইংল্যান্ডে বস্ত্র আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এতে করে লন্ডনের ফ্যাশনপ্রিয় উচ্চবিত্তদের ভেতরে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিলে পরবর্তীকালে এই আইনে সামান্য পরবর্তন আনা হয়। তাতেও জন অসন্তোষ না কমলে ১৭২১ সালে পুরো আইনটি তুলে নেয়া হয়। 

এর কাছাকাছি সময়ে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের সূত্রপাত হয় এবং সুতাকলের উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্রশিল্পে ইংল্যান্ডের অনুপ্রবেশ ঘটে। ততদিনে বাংলার শাসন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুক্ষিগত এবং বাংলার কোষাগারও কোম্পানির হাতে। বিভিন্ন বর্ণনায় দেখা যায় পরাজিত নবাবের লুট করা রাজকোষ একশোটি নৌকায় বোঝাই করে নেয়া হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়ামে। বাংলার ধনাঢ্য বণিক ও ভূস্বামীদের কাছ থেকেও সুবিধার বিনিময়ে প্রচুর টাকা আদায় করা হয়। এইভাবে বৈধ ও অবৈধ উপায়ে কোম্পানি আহরিত বিপুল অর্থ পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করে ইংল্যান্ডের বস্ত্র শিল্পকে দ্রুত প্রসারিত করা হয়। পাশাপাশি ভারতীয় বস্ত্রের ওপর ব্যাপক হারে কর আরোপ এবং ইংল্যান্ড ছাড়া অন্যত্র রফতানি নিষিদ্ধ করার কারণে কিছু দিনের ভিতরেই বাংলার বস্ত্রশিল্প প্রকৃত অর্থে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এক হিসাবে দেখা যায় ১৭৪৭ সালে, পলাশীর যুদ্ধের দশ বছর আগে, বাংলার বস্ত্র রফতানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২৮ কোটি আটশো রুপি। এর পঞ্চাশ বছর পর, ১৭৯৭ সালে সেটা নেমে আসে ১৪ কোটি আটশো রুপিতে। এবং এর কিছুদিন পরে রফতানি নেমে আসে প্রায় শূন্যের কোঠায়, ততদিনে ইংল্যান্ড থেকে ভারতেই বস্ত্র আমদানি শুরু হয়।

জাহাজ নিয়ে ভারতে পৌঁছানো প্রথম ইউরোপিয়ান ছিলেন ভাস্কো দা গামা, ১৪৯৮ সালের ২০ মে তিনি কালিকট বন্দরে এসে জাহাজ ভিড়ান। 

ভাস্কো দা গামা ১৪৯৮ সালে পর্তুগাল থেকে পূর্বদিকে যাত্রা করে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল ধরে ধরে কেপ অফ গুড হেভেনে পৌঁছান। ওখান থেকে ভারতে পৌঁছাতে হলে আড়াআড়ি সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে। অপরিচিত মহাসাগরে হারিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল প্রচুর। ভারতীয় বাণিজ্য জাহাজ তখন আফ্রিকায় যাতায়াত করত কাপড় আর মশলা নিয়ে। মালাবারের কাছাকাছি মধ্যসাগরে এমনি কয়েকটি ভারতীয় জাহাজের দেখা পান ভাস্কো দা গামা, আর তাদের পিছু পিছু পশ্চিম ভারতের মালাবার এসে পৌঁছান। জাহাজগুলোর গঠন দেখে খুবই অবাক হয়েছিলেন তিনি। এই নিয়ে ডায়েরিতে নিজের জবানিতেই লিখে গিয়েছেন চমৎকার বিবরণ। ওই সময়ে পর্তুগালের তথা ইউরোপের সবচেয়ে বড় জাহাজটি নিয়ে সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন তিনি, কিন্তু ভাস্কো দা গামার মতে—‘ভারতীয় জাহাজগুলো ছিল তার জাহাজের প্রায় দশগুণ বড়’। 

আমরা অনেকেই হয়তো জানি না যে জাহাজ নির্মাণে বাংলা সারা বিশ্বেই অগ্রণী ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ কারখানায় অটোমান সাম্রাজ্যের যুদ্ধজাহাজ উৎপাদিত হতো। এক হিসাবে দেখা যায় সপ্তদশ শতাব্দীর দিকে সুবে বাংলায় যে পরিমাণ জাহাজ তৈরি হতো, তা ছিল পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশের চেয়েও বেশি। তখন বাংলার বার্ষিক জাহাজ উৎপাদন ছিল মোট ২২৩২৫০ টন, আর ওই একই সময় সারা আমেরিকার সবগুলো কলোনি মিলিয়ে জাহাজ উৎপাদন ছিল ২৩০৬১ টন। সম্রাট আকবরের আমলে বাংলায় তিন হাজার জাহাজের এক নৌবহর ছিল, যার সদর দফতর ছিল ঢাকায়। মুঘলদের পতনের পর ব্রিটিশ শাসন শুরু হলে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভির অনেক জাহাজ তৈরি হয় চট্টগ্রামে। জানা যায় বিখ্যাত ট্রাফালগার নৌযুদ্ধের বেশ কিছু জাহাজ তৈরি হয়েছিল চট্টগ্রামে।

বাংলার জাহাজ শিল্প প্রযুক্তিগত দিক থেকেও বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে এগিয়ে ছিল। বিশেষত বাংলার জাহাজ নির্মাণ বিষয়ক একটি আবিষ্কার সারা দুনিয়ার জাহাজ শিল্পে বিবর্তন আনে। কৃষি সমৃদ্ধ বাংলার চাল পাঠানো হতো মুঘল সাম্রাজ্যের নানা জায়গায়। এই চালের জাহাজের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রয়োজনে বাংলার প্রকৌশলীরা উদ্ভাবন করেন ‘ফ্লাসড ডেক (Flushed Deck) নামের এক বিশেষ ডিজাইন যা জাহাজের কাঠামোকে মজবুত করে, অতিরিক্ত ঘর্ষণজনিত ফুটো নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই ডিজাইনটি নিয়ে যায় ব্রিটেনে, পরবর্তীকালে ব্রিটেনের শিল্প বিপ্লবের সময়ে এই ডিজাইনটিই সকল সমুদ্রগামী জাহাজে প্রয়োগ করা হয়। আধুনিক এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার কিংবা ডেস্ট্রয়ারগুলোতেও এই ডিজাইন ব্যবহার করা হয় এখন।

বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর বয়সকালে ইতিহাসের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ এখন আর মুঘল শাসনাধীনে নেই, ব্রিটিশ উপনিবেশে নেই, পাকিস্তানি উপনিবেশেও নেই। তবে একটা বিষয় প্রাণিধানযোগ্য যে ঔপনিবেশিক শক্তির বিদায় ঘটলেও দ্রুতই তার স্থান দখল করে নেয় নব্য উপনিবেশবাদ।   

বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় একসময় সাম্রাজ্যবাদের স্থলাভিষিক্ত হয় উপনিবেশবাদ—শিল্প বিপ্লবোত্তরকালে যার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল পুঁজির সংগ্রহ, বিনিয়োগ ও বিস্তারের অভিলাষ। পুঁজি নিয়ে মার্ক্সীয় আলোচনায় মূলত জাতীয় পর্যায়ের বিশ্লেষণ থাকলেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুঁজিবাদি শক্তির পারস্পারিক যোগসাজসের বিষয়েও যথেষ্ট আলোকপাত ছিল। ধনবাদী সমাজে শ্রেণির স্বার্থ ও পুঁজির স্বার্থের সমান্তরাল অবস্থান। নানা অসিলায় সাম্রাজ্য বিস্তার কিংবা উপনিবেশ স্থাপন এই স্বার্থেরই রক্ষাকবচ। লেনিনের ১৯১৭ সালের পুস্তিকা Imperialism, the Highest Stage of Capitalismতে এই নিয়ে আরও আলোচনা আছে।১০ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে উপনিবেশগুলোর পতন আর দেশে দেশে জাতীয়তাবাদের উত্থানের সঙ্গে বাজার ও পুঁজি স্বার্থের প্রচলিত রক্ষাকবচ হুমকির মুখে পড়ে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদি অর্থনীতির অবস্থান অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সূত্রপাত ঘটে নব্য-উপনিবেশবাদ বা ‘নিও-কলোনিয়ালিজম’এর, যার ছোবল সরাসরি উপনিবেশের শোষণ-নিয়ন্ত্রণের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। বিষয়টি সমাজ চিন্তকদের দৃষ্টি এড়ায়নি, ফরাসি দার্শনিক জাঁ পল সাত্রে ১৯৬৪ সালে তার Colonialism and Neocolonialism নামের বইতে ‘Neocolonialism’ বা ‘নব্য-উপনিবেশবাদ’ বাক্যটি চয়ন করেন প্রথমবারের মতো, যেখানে আলজেরিয়ায় ফরাসি আধিপত্যবাদের স্বরূপ তুলে ধরে তিনি এর তীব্র সমালোচনা করেন।১১ সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র আলজেরিয়ায় প্রথাগত উপনিবেশের সমাপ্তি ঘটলেও নানামুখী নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশটির সামাজিক-অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি ফ্রান্সের বুর্জোয়া পুঁজিপতিদের হাতেই রয়ে যায়। এই তত্ত্বটি ইউরোপের বুদ্ধিজীবী মহলে প্রচুর প্রভাব বিস্তার করে এবং বিষয়টি খুব দ্রুত বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদী চেতনার সম্পূরক রাজনৈতিক মতাদর্শের অন্তর্ভুক্ত হয়। আফ্রিকার সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র ঘানার প্রথম বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট নক্রুমা ১৯৬৫ সালে Neocolonialism the last stage of Imperialism বইতে নব্য-উপনিবেশবাদের নানা ফন্দিফিকির বিশ্লেষণ করে দেখান যে এ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে মারাত্মক স্তর।১২ নব্য উপনিবেশবাদ বিষয়ে নক্রুমার বিশ্লেষণ এবং এর কবল থেকে উদ্ধারের ফর্মুলা হিসাবে জনপ্রিয় ‘প্যান-আফ্রিকান’ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। নক্রুমা ঘানার শিল্প কারখানাগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং এক পর্যায়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এর এক বছরের মাথায় সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন নক্রুমা এবং কিছুদিনের মধ্যেই ঘানার সকল রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে বেসরকারিকরণ এবং অন্যান্য বিধিব্যবস্থার মাধ্যমে পুনর্গঠিত অর্থনীতির নব্য-উপনিবেশিক চরিত্রকে পাকাপোক্ত করা হয়।

এই ঘটনার সঙ্গে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের বেশ মিল পাওয়া যায়। ১৯৪৭ সালে উপনিবেশ হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশকে হারালেও উপনেবিশবাদী শক্তি এর পালটা প্রতিশোধ নেয় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ঘিরে এতদঞ্চলে নব্য-উপনিবেশের মডেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এতদঞ্চলে এই শক্তির প্রভাব বৃত্তের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। শুধু পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া নয়, মার্কিন জোট সেন্টো ও সিয়াটোকে বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দেন, পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বদলে সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে গ্রহণ করেন, কৃষি বান্ধব ভূমি সংস্কার শুরু করেন, ব্যাংক, বীমা ও বৃহৎ শিল্পকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং অবশেষে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বদলে একদলীয় শাসন কায়েম করেন। আমরা দেখি, এর কয়েকমাস পরেই তিনি এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন। পরবর্তীকালে একে একে সকল রাষ্ট্রায়ত্ত খাত বেসরকারি হাতে ন্যস্ত হয়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি প্রায় হুবহু পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতির পথে হাঁটতে থাকে এবং অচিরেই দেশ আবার মার্কিন প্রভাব বলয়ে ফিরে আসে। 

উপরের উদাহরণটি পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের পক্ষে বিপক্ষে নয়, বরং যেকোনো অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশের ওপর সবল দেশের প্রভাবের বিষয়টি তুলে ধরার উদ্দেশ্যে বলা হলো। পুঁজিবাদের সঙ্কটগুলো যেভাবে মার্ক্সীয় অর্থনীতির আলোচনায় স্পষ্ট উঠে আসে তেমনি বাজার অর্থনীতির আলোচনায় সমাজতন্ত্রের সঙ্কটগুলোর কথাও উঠে আসে সমানভাবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আমরা এখন সোভিয়েত পদ্ধতির ত্রুটিগুলো আরও বিশদ জানতে পারি। পার্টি নিয়ন্ত্রিত শাসনব্যবস্থার বিপজ্জনক দিকগুলো জানতে পারি। গত শতাব্দী জুড়ে দেশে দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে, আদর্শগত অবস্থানের ওঠানামা হয়েছে, কিন্তু বিশ্বময় বঞ্চনার ইতিহাসের পরিবর্তন ঘটেনি। মানুষে মানুষে যেমন শোষণ হয়, জাতিতে জাতিতেও শোষণ হয়। অনেক সময় পদ্ধতিগত কারণেও এই শোষণ অব্যাহত থাকে। দুঃখজনক হলো, মানব কল্যাণের আদর্শকেও শোষণের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার নজিরের কমতি নেই ইতিহাসে।  

আমরা দেখেছি, এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন তার বলয়ের দেশগুলোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন বাজার হিসেবে ব্যবহার করেছে, ঠিক যেমনটা উপনিবেশের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। এখন দেখছি কমিউনিস্ট শাসিত চীন বিশ্বব্যাপী প্রভাব বাড়িয়ে চলেছে ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে, ঠিক নব্য-উপনিবেশবাদের মডেল অনুসরণ করে। সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট ধর্ম ও পেট্রোলিয়ামকে ব্যবহার করে, এখানেও ঠিক নব্য-উপনিবেশের মডেলে। বস্তুত বাজার অর্থনীতির চলমান বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের এই মহামারি থেকে নিস্তার নেই, একে সহনীয় পর্যায়ে রাখাটাই যেন সবার লক্ষ্য। 

নক্রুমা বলেছিলেন নব্য উপনিবেশ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের সর্বশেষ স্তর। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ নয়, আমরা এখন নব্য-সাম্রাজ্যবাদের শিকার, যেখানে এই কথাটা হয়তো সর্বাংশে খাটে না। জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নব্য উপনিবেশবাদের প্রচলিত পদ্ধতিগুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। বাজার অর্থনীতির কারণে পুঁজিতে পুঁজিতে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, নানাবিধ কারণে বৃহৎ শক্তিগুলোর নিজস্ব সঙ্কট তৈরি হচ্ছে, ‘Dependancy Theory’ বা নির্ভরশীলতার তত্ত্ব’ নির্ভর অর্থনীতির এখন বিকল্প সূত্রের প্রয়োজন। এই অবস্থায় পুঁজির নিরাপদ বিস্তারের জন্যই গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের সূত্রপাত, যা পুঁজি বাজারে বৃহৎ শক্তির প্রভাব অব্যাহত রাখার জন্য নব্য-উপনিবেশের পরবর্তী স্তর। এটা বিশ্বব্যাংক কিংবা আইএমএফ-এর ঋণের মতো খোলামেলা প্রভাব  নয়, বরং অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন অথচ কার্যকরী প্রভাব।১৩

বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমাদের অর্জনকে মূল্যায়নের সময় আন্তর্জাতিক প্রভাবের এই বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক। কারণ রাজনৈতিক স্বাধীনতার পরে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হলো সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। বিশ্বায়নের চুম্বক একটি জাতির সংস্কৃতিকে পালটে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। বর্তমান অগ্রগতির ধারা অব্যাহত থাকলে পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা অর্জনের মাধ্যমে খুব শিগগিরই বাংলাদেশ কোনো প্রকার বৈদেশিক খবরদারি ছাড়া রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি খাতে নিজস্ব পুঁজির পুরোপুরি যোগান দিতে সক্ষম হবে, এবং বহিঃশক্তির অর্থনৈতিক আগ্রাসনকে স্থিমিত করতে সক্ষম হবে। কিন্তু গোড়া থেকেই সচেতনভাবে সচেষ্ট না থাকলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিহত করার কাজটি দূরূহ। বিশ্বায়নের ধারাটিই এমন যে বাণিজ্য অর্থনীতির বিকাশের অজুহাতে এর সাংস্কৃতিক প্রভাবটিও জনজীবনে প্রবিষ্ট হয়ে পড়ে। শুধু জনসচেতনতার আহ্বান করে এই প্রভাবকে অতিক্রম করার জো নেই, এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও নীতিমালা। আমার মনে হয় আর দেরি না করে রাষ্ট্রীয় খাতে আমাদের লগ্নির অন্তত একটি ক্ষুদ্র অংশ এই লক্ষ্যে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। 

অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিঃসন্দেহে মানব উন্নয়ন ও সামাজিক উন্নয়নের নিয়ামক, কিন্তু সমার্থক নয়। লক্ষণীয় যে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেলগুলোর প্রায় সবই পাশ্চাত্যের মডেলের অনুসরণ। কিন্তু সামাজিক, মানবিক ও সাংস্কৃতিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের মডেল আমাদের সতত পূজনীয় হওয়া উচিত কিনা তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সামাজিক সঙ্কট এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে, বিষয়টি আর রাখঢাক না করেই বহুল আলোচিত বিষয়। আমাদের উচিত এর বিশ্লেষণ করা, সঙ্কটগুলো নির্দিষ্ট করা এবং আমাদের নিজস্ব প্রেক্ষাপটে এর বিধানকল্পে প্রণালিবদ্ধ উপায়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। উন্নত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক সঙ্কটগুলো বিবেচনা করলেই ‘উন্নত বিশ্বে’র সম্ভাব্য সঙ্কটগুলোর ধারণা পাওয়া যায়। ‘উন্নয়নশীল দেশ’ থেকে ‘উন্নত দেশ’ অভিমুখে আমাদের অভিযাত্রায় উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের নিজস্ব সমাজ ও সংস্কৃতির নিরিখে অবক্ষয়-নিরোধক প্রয়োজনীয় রক্ষাকবচ নির্মাণে রাষ্ট্রকে মনোযোগী হতে হবে।


তথ্যসূচি

১.     Maddison, Angus. Development Center Studies The World Economy Historical Statistics; Historical Statistics, OECD Publishing, pp261. (2003).
২.     Parthasarathi, Prasannan. Why Europe Grew Rich and Asia Did Not: Global Economic Divergence, 1600–1850, Cambridge University Press, pp. 38–45. (2011). 
৩.     Campos, J. J. A.  History of the Portuguese in Bengal. University of Michigan Library 1919.
৪.     Furguson, Niall. EMPIRES: HOW BRITAIN MADE THE MODERN WORLD. sand piper Books Reprint edition 2012.
৫.     Graner, Elvira et al. State of Cities: Urban Governance in Dhaka. BIGD, BRACUniversity. May 2012 
৬.     Ray, Indrajit. Bengal Industries and the British Industrial Revolution (1757-1857). Routledge.pp. 57, 90, 174. (2011). 
৭.     Ahmedullah, M. Bengal To Britain: Re-creating Historic Fashions of the Muslin Trade. Chapter: History of Bengal Textiles.    Publisher Stepney Community Trust.
৮.     Ray, Indrajit. Bengal Industries and the British Industrial Revolution (1757-1857). Routledge.p. 174. (2011). 
৯.     Zakaria, NM Golam. Prospects of shipbuilding industry in Bangladesh, New Age Saturday, December 17, 2011
১০.     Lenin,V.I. Imperialism, the Highest Stage of Capitalism. Original 1917. Penguin Great Ideas 2010.
১১.     Sartre, Jean-Paul.Colonialism and Neocolonialism. Routledge Classics. 2006. 
১২.     Nkrumah, Kwame. Neocolonialism the last stage of Imperialism. Panaf  Books.1987
১৩.     Martins, Carlos Eduardo.Translated by Lagnado, Jacob. Dependency, Neoliberalism and Globalization in Latin America. Haymarket Book, Reprintedition 2020.
১৪.     Siddique, P.M.K Hassanet al. Shipbuilding: A Gateway for Bangladesh to Achieve Economic Solvency. BMJ Vol 4 Issue 1 

menu
menu